বনদস্যু-মহাজন-সূদের কারবারী, চক্রে বাঁধা জেলেদের জীবন | রূপান্তরের গল্প ১৬৭ | Rupantorer Golpo 167 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৬৭ : আপনারা এমন কেন ভাই? এতোবার করে বলেছি এখানে টাকা খরচের কোনো ব্যাপার নাই! মজনু ভাইকে বার বার বলেছি। ইলিয়াসও জানে ব্যাপারটা। সেই রাজু বাহিনীর সময় থেকে বনের দস্যু জগতে আসা যাওয়া। টাকা দূরের কথা, কেউ আমাকে মাছ পাঠাতে পারছেন? ২০১৩ সালে ইলিয়াসের ওখানে গেছিলাম। সেবার ওদের কাছে আটক এক মধুর নৌকা থেকে মধু কিনে নিয়েছিলাম। সেই টাকাটাও কড়ায় গন্ডায় পরিশোধ করে এসেছিলাম। ভুলে গেছেন?
ইলিয়াস বললো, ভুলিনি। আর আপনাকে তো গত সাত বছর ধরে চিনি। কিন্তু লোকে বলাবলি করছে যে সারেন্ডার করতে টাকা লাগে। হয়তো আপনার লাগে না। কিন্তু কোথাও হয়তো লাগে। মজনু বলেন, টাকাটা তো অন্যভাবে দিতে চাচ্ছি না ভাই। উপহার হিসাবে দিতে চাই। বললাম, সারেন্ডারের পর আপনাদের অনেক খরচ। জেলখানা, উকিল-মুহুরির খরচ আছে। এসময় তো কাজেও থাকবেন না, ইনকাম থাকবে না। সেই কাজে ব্যবহার করেন।
মজনুর কাছে সবশেষ অস্ত্র ও গুলির হিসাব জানতে চাইলাম। বললেন ১৫টি অস্ত্র সাথে আছে। আরও কয়টা অস্ত্র চাপানো আছে নিচের দিকে। নিচের দিকে মানে এখান থেকে আরও দক্ষিণে। বললাম কে যাবে আনতে? মজনু বললেন, সুবিধাজনক সময়ে নৌকা নিয়ে যাবে বাবু। বললাম, সাথে আমাদের কেউ থাকবে। উনি বললেন, বনের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। আপনাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। বললাম, বনে হাঁটতে পারা কাউকেই পাঠাবো।
রান্নাঘর থেকে হাঁক দিলেন বেলায়েত সরদার। বললেন, আমি যাবো ভাই। জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি কোনো ব্যাপার না। বললাম, আগে সকালের নাস্তার ব্যবস্থাটা করেন। সরদার বললেন, শুধু সকাল না, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে ভাই। বললাম, কী খাবো দুপুরে? বললেন, কাঁকড়া ভুনা আর মাছের তরকারি। বড় মাছ আছে।
বড় মাছ কোত্থেকে আসবে এখন? হিসাব মিলছে না। বলতে বলতে পাশের এক জেলে ভাইয়ের ডিঙ্গি নৌকায় হেঁটে গেলেন সরদার। পাটাতনের নিচ থেকে বড়ফের বাক্স বের করলেন। তার ভিতর থেকে বের হলো বড় একটা মাছ, মেধ মাছ। সাথে ভেটকি মাছও আছে। আছে দাতিনা আর মোচন মাছ। বললাম, রাতে তো উনারা বললেন মাছ নাই। এখন কোত্থেকে বের হলো? ওই নৌকার মাঝি মাছটি হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, আমরা গরীব মানুষ। কিন্তু মনটা বিরাট বড়।
গত রাতে যখন আমাদের আটকালেন তখন ভাবলাম, ডাকাতে আটকেছে। তাই মিথ্যা বলছিলাম। পরে এই ভাইয়ের কাছে শুনলাম কী কাজে আসছেন আপনারা। সুন্দরবনের ডাকাত উঠায়ে নিতে আসছেন। এটা যে কী কাজ হচ্ছে আপনিও জানেন না। বললাম, ডাকাতদের সারেন্ডার করালে আপনাদের উপকার হবে? এরপর উনি যা বললেন, তা আমার সারা জীবনের পুরস্কার।
জেলে ভাই বললেন, সুন্দরবন ডাকাতমুক্ত হলে আমাদের সারা জীবনের উপকার হবে। এদের কারণে আমাদের কারও ঘুম হয় না। এই যে জঙ্গলে আসি, এক রকম চির বিদায় নিয়ে আসি বাড়ি থেকে। মনে মনে বলি, বাঘ-কুমির যেন না ধরে। আল্লাহকে বলি, এই জঙ্গল করেই আমার পরিবারের সবার পেট চলে। আমি মরে গেলে ওরা না খেয়ে থাকবে। তাই জীবনের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে দিয়ে নেমে পড়ি।
জঙ্গলে আগের মতো বাঘ নাই। পশ্চিম বাদায় কুমিরও কমে গেছে। কিন্তু বেড়েছে বনদস্যু দল। চাঁদা দেই প্রতি গোনে নামার সময়। কিন্তু কয়জনকে দিবো? দেখা যাচ্ছে মজনু সাহেবকে টাকা দিলাম গোনে তিন হাজার। আরও পার্টি আছে, তাদেরও দিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নতুন আরেকটা পার্টি এসে ধরলো। অপহরণ করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চাইলো। তখন কী করবো? হাতে পায়ে ধরে হয়তো টাকা কিছু কমাই। তারপর বউ যায় সূদের মহাজনের কাছে। চড়া সূদে ধরেন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে মুক্তিপণ দিলো। আমি ছাড়া পেলাম। কিন্তু বোনাস হিসাবে মারপিট খেলামম ওদের হাতে, আর নতুন করে পঞ্চাশ হাজার টাকা সূদের ঋণে পড়লাম। এই ঋণ আর জীবনে শোধ হয় না। সূদ যদি হাজারে ৪০০ টাকা হয় তাহলে আসল দিবো না সূদ?
পাশ থেকে এক বনদস্যু বললো, সূদের টাকা দিতে দিতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। সূদের কারবারীরা তিনটি ব্ল্যাংক চেক রেখে দেয়। সেটা দিয়ে মামলা করে দেয়। দেখা যাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার টাকার সূদ এক লাখ টাকা দিয়ে ফেলার পরও আসলটা থেকেই যায়। বললাম, তোমরা ডাকাতি করো, অপহরণ করো বলেই তো জেলেদের সূদে টাকা নেওয়া লাগে। বনদস্যু যুবক বললো, আমি নিজেও সূদের টাকা শোধ করতে না পেরে মামলা খাইছি ভাই। তারপর থানার ওয়ারেন্ট হলো।
ভয়ে ডাকাতি করতে চলে আসলাম। ভাবছিলাম, মাস ছয় ডাকাতি করে যে টাকা পাবো তা দিয়ে ঋণ শোধ করবো। কিন্তু আর উঠতে পারলাম কই? আগে শুধু চেকের মামলার আসামী ছিলাম। এখন দস্যুতা, অস্ত্র মামলার আসামী হইছি। আর নাম হয়ে গেছে ডাকাত। কী করে ফিরবো? বললাম, ফিরতে হবে তোমাদের। তোমরা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছো। আবার জীবনে ফিরতে হবে। এই পথ বেশ কঠিন, কষ্ট হবে, সময় লাগবে। তবে দেখবে একদিন ফিরতে পারবে ঘরে।
মেধ মাছটি হাতে নিলাম। চার/পাঁচ কেজি হবে। বেলায়েত ভাইকে বললাম, দুপুরে কাঁকড়া ভুনা’র সাথে মেধ মাছের ঝোল করবেন। সরদার বললেন, মেধ মাছের ভুনা ভালো লাগবে ভাই। বললাম, তাই হোক। সবাই মিলে খাবো দুপুরে। সরদার বললেন, সকালের নাস্তায় ভাত থাকবে, ডাল থাকবে আর কী করবো? বললাম বেশি ঝামেলা করার দরকার নাই। শুকনো মরিচ আছে না? পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ঝাল ভর্তা করেন। আমার তাতেই চলবে।
মাছের দাম কতো দিবো ভাই? জেলে ভাইকে বলতেই হাত জোড় করে বসলেন। বললেন, আপনি ওই ডাকাতদের ত্রিশ লাখ টাকা ফিরায়ে দিলেন। আর আমি সামান্য একটা মাছের দাম নিবো আপনার কাছে? বললাম, আপনার সংসার চলে এ মাছ বিক্রি করে। বাজার দর ধরে দামটা দেই? বললেন, এই মাছের দাম তো বেশি না। মহাজনের কাছে দিবো। সে যা দেয়। মানে কী? মহাজন যা দেয় মানে? বললেন, দাদন নেওয়া আছে। মহাজনকেই মাছ দিতে হয়। এই মাছের দাম দিবে খুব বেশি হলে চারশ’ টাকা। বললাম, খুলনার সন্ধা বাজারে এটা বিক্রি হয় ছয়শ’ থেকে আটশ’ টাকা কেজি। সেই হিসাবে এর দাম অন্তত আড়াই হাজার টাকা। উনি বললেন, এসব বলে লাভ নাই। মহাজনে যা দেয় তাই নিতে হবে। এখানে কোনো দর কষাকষি চলে না।
মাছের দাম কিছুতেই নিলেন না। উপহার হিসাবেই নিতে হলো সেটি। এসব দেখে ইলিয়াস বললো, ডাকাত বলে আমাদের উপহার নিলেন না ভাই? বললাম, সারেন্ডার করেন, বাড়ি ফিরেন। একবেলা খেতে আসবো। একটা রাজহাঁস খাওয়াবেন আমাকে। ইলিয়াস বললো, যদি বেঁচে যাই তবে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবো। ছোট একটা ঘের আছে। শুধু রাজহাঁস না, পারশে, পাতাড়ী মাছও খাওয়াবো। বললাম, সেই দিন আসুক।
মনে মনে ভাবছিলাম ডাকাতেরা খুব খারাপ মানুষ। ওরা অস্ত্র ধরে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়, মুক্তিপণ নেয়। কিন্তু মহাজনেরা কী করছে এদের সাথে? সরদার বললেন, এদিকে তো ভাই চারশ’ টাকা দিবে মাছের দাম। আমাদের ওদিকে বড় পাঙ্গাসের দাম দেয় খুব বেশি হলে ৭০/৮০ টাকা কেজি, চিংড়ির দাম ধরে ৫০/৬০ টাকা, তাও আবার ৫৪ কেজিতে মণ।
ইলিয়াস বললো, আমরা ডাকাতি করি, খারাপ মানুষ। আমাদের নামে মামলা হয়। এখন ধরা পড়লে ক্রসফায়ারে জীবনটা যাবে। কিন্তু ডাঙ্গার এই দাদনের মহাজন, সূদের কারবারীরা আমাদের চেয়ে বেশি নির্যাতন করে। তাদের কিছু হয় না ভাই। বললাম, ওদের কথা পরে ভাববো। আপাতত আপনারা সারেন্ডার করেন।
জোয়ার ততোক্ষণে এক পোয়া হলো। সকালের নাস্তা হতে হতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। বললাম, ট্রলারে প্রচুর বিস্কিটের প্যাকেট আছে। বের করে সবাইকে দেন। মজনু বললেন, ট্রলারের কেবিনে এসে একটু বিশ্রাম নেন। বললাম, আপনাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে তারপর বিশ্রাম নিবো।