রূপান্তরের গল্প ১৬৮ | Rupantorer Golpo 168

খালে ডাকাত, নদীতে RAB, অস্ত্র ফেলে গভীর ঘুমে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১৬৮

খালে ডাকাত, নদীতে RAB, অস্ত্র ফেলে গভীর ঘুমে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১৬৮ | Rupantorer Golpo 168 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬৮ : একবার মান্নানের হাতে ধরা পড়লাম ভাই। ২০১১ সালের কথা। সেবার জোয়ারে বাড়িঘর ভেসে গেলো। বউ-বাচ্চা নিয়ে ভেড়ি বাধের উপর থাকতাম। হাতে টাকা-পয়সা নাই। ডাকাতের চাঁদা দিবো কী করে? আবার পেটও তো চালাতে হবে। বিরাট ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। কারণ ডাকাতে ধরলে মুক্তিপণ না দিয়ে ছাড়া পাবো না। আর মান্নান ডাকাতে ধরলে যে নির্যাতন করবে! জলদস্যু মজনুর ডেরায় বসে কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে গেলো কাঁকড়ার জেলে বাচ্চু।

প্রচন্ড মারপিট করে ভাই! ওর মার খেলে হাড়গোড় ঠিক থাকে না। পরের এক মাস আর হাঁটা-চলার অবস্থা থাকে না! জিজ্ঞেস করলাম, বাঁচতে পারছিলে সেবার? হাত আর পায়ের কয়েকটি পুরনো ক্ষত দেখিয়ে সে বললো, মান্নানেই ধরছিলো আমাকে। মুক্তিপণ চাইলো কুড়ি হাজার টাকা। পকেটে তখন কুড়ি টাকাও নাই। কী করবো?

প্রতিদিন অকথ্য নির্যাতন করতো ভাই। মান্নান নিজে মারতো। হাত-পা বেঁধে ফেলায়ে রাখছিলো একুশ দিন। শুধু খাওয়া আর বাথরুম করার সময় খুলতো। জিজ্ঞেস করলাম, একুশ দিন পর কি মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাইছো? বললো, না ভাই। সেদিন তো আরও বড় বিপদ গেছে। আমাদের নিয়ে মান্নান ছিলো গেওয়াখালী। হঠাৎ করে রাজু বাহিনী এসে আক্রমণ করে। বিরাট গোলাগুলি হলো সেবার। মান্নান ডাকাতেরা পালিয়ে গেলো জঙ্গলের ভিতরে। আমরা দুইজন বাঁধা জেলে সেখানেই পড়ে থাকলাম। ভাগ্যিস ওরা পালালো। না হলে ওই পার্টির গুলি আমাদের ওখানে আসতো।

বাচ্চু বলছে, জঙ্গলের ভিতর থেকে মান্নান ডাকাতকে ধরে আনলো তারা। এরপর নৌকায় এসে কয়েকটা বন্দুক আর গুলি নিলো। আমাদের বাঁধন খুলে দিলো। বললো, নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে। মান্নানকে বেঁধে ফেললো ওরা। অস্ত্র-গুলিসহ তাকে নিয়ে গেলো। সেবার প্রাণে বেঁচে ফিরছিলাম। কিন্তু এই ক্ষতগুলো রয়ে গেছে। বনদস্যুদের নির্যাতনের এমন বর্ণনা প্রায়ই শুনি জেলেদের মুখে। সেই ভোরবেলা এদের সাথে বসেছি। গল্প শুনছি, গল্প করতে ভালো লাগছে।

আধা জোয়ার হয়ে গেছে। পালোকাটি খালের ভিতরে আমাদের নৌকাগুলো ভেসে গেছে। একটি নৌকা নিয়ে মজনু রওনা হবেন চাপানো অস্ত্রগুলো আনতে। সাথে দুই বনদস্যু এনামুল আর গুটগুটে বাবু যাবে। বেলায়েত সরদারকেও পাঠাতে চাইলাম সাথে। মজনু বললেন, শুধু শুধু কষ্ট করার দরকার নাই। বলতে বলতে বেলায়েত সরদার একটা শর্টস পড়ে হাজির। বললেন, কষ্ট হয় হোক। চোখের ইশারায় কথা হলো। বেলায়েত সরদার উঠে বসলেন মজনুর নৌকায়। দস্যুদের সঙ্গে তাঁকে পাঠানোর কারণ, অস্ত্র ও গুলিগুলোর মধ্যে একটি গুলিও যেন হাতছাড়া না হয়। নৌকা বেয়ে রওনা দিলো ওরা।

যাওয়ার সময় আমাদের খেয়ে নিতে বললো ওরা। বললাম, খেয়ে নিবো। আপনারা তাড়াতাড়ি ফিরেন। খুব টেনশনে থাকবো কিন্তু! আসলে এই জঙ্গলে প্রতিটি মুহুর্তেই মৃত্যু ঝুঁকি অপেক্ষা করে। কখন কোন বিপদ সামনে আসে বলা যায় না। বিশেষ করে বনদস্যুদের সাথে থাকার সময়টা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির। যে কাজে নেমেছি, ঝুঁকি নিতেই হবে।

সবাইকে নিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। আলমগীর ভাইয়ের নেতৃত্বে রান্নার প্রস্তুতি শুরু হলো। মাছ আর কাঁকড়া দিয়ে হবে দুপুরের খাবার। কাটা-বাছার কাজ শেষ করে রাখবে তারা। বেলায়েত সরদার ফিরে রান্না করবেন। এদিকে কাঁকড়ার জেলে বাচ্চুকে নিয়ে নাও ভাসালাম আমরা। বললাম, বড় নদীতে চলো। বাচ্চু বললো, ওদিকে তো প্রশাসনের ট্রলার আছে! বললাম, ওই ট্রলারেই যাবো। বৈঠা বেয়ে চললাম আমরা। সামনে আমি, পিছনে বাচ্চু। যাচ্ছি RAB-এর ট্রলারে। গত রাতে এই খালে প্রবেশের সময় তাদের ওখানে রেখে এসেছিলাম।

মাঝ নদী থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে ওই ট্রলার। সম্ভবত নোঙ্গর করতে করতে নেমে গেছে একটু নিচে, নদীর অপর পাশে। আমাদের দেখে নড়ে চড়ে বসলেন তাঁরা। কাছে যেতেই দেখি টিম লিডার এএসপি জসীম উদ্দীন উঠে দাঁড়ালেন। নৌকা ভিড়িয়ে উঠে পড়লাম। এদিকের সবকিছু বিস্তারিত জানালাম। উনি বললেন, পরদিনের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। তদারকি করে সেখান থেকে রওনা দিবেন মেজর আদনান কবীর। বিকালের মধ্যে এসে দস্যুদের হেফাজতে নিবে RAB। পরদিন ১২ জুলাই, ২০১৬ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ করবে মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী। বললাম, সারাদিন থাকতে হবে এখানে, রোদ বাতাসে কষ্ট হলে একটু আগে বা পিছে গাছের ছায়া দেখে ট্রলার রাখবেন। দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকবেন যাতে খাল থেকে বের হয়েই আপনাদের দেখতে পাই।

এক কাপ চা খেয়ে নেমে পড়লাম নৌকায়। আসতে আসতে বাচ্চু বললো, নদীতে RAB আর খালে দস্যু বাহিনী। এমন দৃশ্য কখনও দেখিনি ভাই। আল্লাহ দেখালো। বেড়ে গেলো নৌকার গতি। তরতর করে ছোট্ট সেই ডিঙ্গি ছুটলো মালঞ্চ ধরে। খালের ভিতরে ঢুকে দারুণ একটা হাঁসি দিলো বাচ্চু।

পালোকাটি খালটি অসম্ভব সুন্দর। রাতের বেলা এতোটা বুঝতে পারিনি। কেওড়া, গড়ান, বাইন, হেঁতাল, গোল গাছগুলো সুন্দর করে সেজে আছে। পানি বাড়ছে একটু একটু করে। পাশের চর ধরে মাড স্কিপারগুলো কাঁদার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর পারশে মাছের ঝাঁক পানিতে ঝাপটা মারছে। রুছো মাছ আর পায়রা মাছের ছুটোছুটি দেখতে পাচ্ছি নৌকায় বসে। বাচ্চু বললো, সামনের ভাটা পর্যন্ত থাকলে আপনাকে চিংড়ি মাছ ধরে খাওয়াবো। বললাম, আজকে অনেক কাজ। পরে একবার আসবো, একসাথে থাকবো কয়েক দিন। সে বললো, আপনারা শহরের মানুষ। কবে আসবেন জানি না। তবে এবার কিছু একটা নিতেই হবে আপনাকে। না হলেও কয়টা দাতিনা আর পায়রা মাছ নিয়ে যাবেন।

সুন্দরবন তখন কেবল চিনতে শুরু করেছি। মনের নদী খালে কী কী মাছ পাওয়া যায়, কোন পদ্ধতিতে কী ধরতে হয়, কখন ধরতে হয় এসব নিয়ে ধারণা খুব কম। বাচ্চুকে বললাম, কথা যথন দিয়েছি আসবো। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে রেখো। এদিকে খালের ভিতরে গরমটা বেড়েছে। বাতাস নাই, আকাশে মেঘ করেছে বেশ। শেষ জোয়ারে বৃষ্টি নামে সুন্দরবনে।

গল্প করতে করতে আমাদের ট্রলারের কাছে ফিরলাম। সেখানে বনদস্যুদের নৌকা বহরের সাথে জেলেদের নৌকাগুলো মিলেমিশে গেছে। অস্ত্র হাতে জলদস্যুরা বসা জেলেদের নৌকায়। আবার বনদস্যুদের নৌকায় বসে গল্পে মত্ত জেলেরা। বছরের পর বছর এই দুই পেশার মানুষদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো শুধু ভয়ের, আতঙ্কের।

একটু আগে বাচ্চু যে কথা বলছিলো, আমারও সেই কথাই মনে পড়লো। সুন্দরবনের জলদস্যু আর জেলেরা একসঙ্গে বসে আছে। এই দৃশ্য দেখে ভালো লাগছে। মনে পড়ছে বাচ্চুর সাথে মান্নান বাহিনীর অত্যাচারের কথা। এই অত্যাচারের গল্পের রূপান্তরটা দেখছি। জানি না সামনে আরও কতো কিছু অপেক্ষা করছে!

নৌকা ভিড়লো আমাদের ট্রলারে। নেমে দেখি এক বনদস্যু হাত পা ছেড়ে ঘুমাচ্ছে। একপাশে বন্দুকটি রাখা। মনে হয় কতো ঘুমায় না ছেলেগুলো। বনদস্যুদের নিয়ে আমার নিউজ, তাদের সারেন্ডার করানো নিয়ে লেগে থাকা, দৌড়ঝাঁপ করা দেখে অনেকে মনে করেন, দস্যুদের নিয়ে আমি সংবেদনশীল। কেউ কেউ মনে করেন, এদের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছি। যে যেভাবেই দেখুক, আমি জানি জানি কী করছি। এসব শুনে আগে মন খারাপ করতাম। কিন্তু এই জঙ্গলের জেলেদের মুখের হাসি দেখলে মন ভরে যায়। সমালোচনা আর অপপ্রচারকে তুচ্ছ মনে হয়। বললাম, ঘুমাক সে।

রান্নাঘরের খোঁজ খবর নিলাম। দেখি সবকিছুর লেজেগোবড়ে অবস্থা! মেধ মাছ কাটাকুটি চলছে তখনও। দা-এ ধার নাই। সুন্দরবনে এই একটা সমস্যা। লোহায় জং ধরে যায়। দা গুলো ভোঁতা হয়ে যায়। পাশে কাঁকড়া নিয়ে বসেছে দুইজন। কাটাকুটি শেষ করতে সময় লাগবে। আলমগীর ভাইকে বললাম, তাড়াতাড়ি শেষ করেন ভাই। হেঁটে রহমতের কাছে গেলাম।

মজনু বাহিনীর মূল নৌকায় বসেছে খাতা-কলম নিয়ে। শেষ হিসাবটা হচ্ছে। জানতে চাইলাম, ওরা আসবে কখন? বললো, অস্ত্রের প্যাকেটটা যেখানে পুঁতে রেখেছে সেই জায়গা খুঁজে পেলে দেরি হবে না। ওই জায়গা শুধু সাহেব চিনে। অস্ত্রগুলো সুরক্ষিত রাখতে, নিজের দখলে রাখতে যুদ্ধ চলে এখানে। দস্যু যায়, দস্যু আসে। বন্দুক আর গুলিগুলো থেকে যায় জঙ্গলে। অস্ত্রগুলোর শুধু হাত বদল হয়। অস্ত্রগুলো জঙ্গল থেকে সরানোই আমার লক্ষ্য। কারণ একটি বন্দুক থেকে জন্ম নেয় নতুন দস্যু বাহনী।

মজনুদের নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ মত পাল্টে ফেলবে না তো? ভাবতেই দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো কয়েক গুন। ওই নৌকায় বেলায়েত সরদার আছে। এখন মনে হচ্ছে দস্যুদের সাথে তাকে না পাঠালেও পারতাম। দুশ্চিন্তায় ঘামছি, পিঠ গড়িয়ে দরদর করে বেয়ে পড়ছে ঘাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top