রূপান্তরের গল্প ১৬৯ | Rupantorer Golpo 169

নতুন দুশ্চিন্তা! ছয় ঘন্টা হলো, ফিরছে না দস্যুনেতা | রূপান্তরের গল্প ১৬৯

নতুন দুশ্চিন্তা! ছয় ঘন্টা হলো, ফিরছে না দস্যুনেতা | রূপান্তরের গল্প ১৬৯ | Rupantorer Golpo 169 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬৯ : কান খাড়া করে বসে আছি। পাশের সরু খাল থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে। কারা জানি নৌকা বেয়ে এদিকে আসছে। ভরা জোয়ারে থৈ থৈ করছে খালের পানি। ছোট ছোট খাল ও ভাড়ানী দিয়ে নৌকা চলাচলের সময় এখনই। সবাই চুপ করে গেলো। ফিসফিস করে বললাম, মজনু ভাইদের নৌকা? পাশে বসা দস্যু রবিউল বললো, না ভাই। অন্য কেউ। তবে ভয়ের কিছু নাই। এই ছোট ভাড়ানী দিয়ে সন্দেহজন কেউ আসবে না। বলতে বলতে একটি নৌকা খুলে দু’জন বেয়ে গেলো ওদিকে। বন্দুক তাক করে খালের মুখে অবস্থান নিলো। এদিকে রবিউল বললো, সাধারণ জেলে না হলে এভাবে কথা বলতে বলতে আসবে না। ওরা কাঁকড়ার জেলে।

কথাবার্তা এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এদিক থেকে একজন হাঁক দিলো, কারা তোমরা? ওরা চুপ হয়ে গেলো। নৌকা বাওয়াও থামিয়ে দিলো। এদিক থেকে আবারও জিজ্ঞেস করলো একজন, এই তোমরা কারা? জবাব দাও না কেন? আগায়ে আসো। না হলে গুলি করে দিবো! এবার ফিরতি আওয়াজ এলো। বললো, কাঁকড়ার জেলে আমরা, আসতিছি। তারপর নৌকা বেয়ে বের হয়ে আসলো নৌকা।

ছোট্ট একটি নৌকা। সামনে-পিছনে দুইজন বৈঠা হাতে। আর মাঝখানে বসা এক শিশু, বয়স আট বছর হবে। চেহারায় আতঙ্ক। ভাবছে এই দিনের বেলা পালোকাটি খালে তো ডাকাত থাকার কথা না। উঠে দাঁড়ালাম। ডাকলাম আমার কাছে। তারা বললো, কাঁকড়া ধরতে নেমেছে দুই দিন আগে। কিন্তু লোকালয় থেকে কেউ তাদের ফোনে জানিয়েছে যে জঙ্গলে RAB ঢুকেছে ডাকাত ধরতে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য তারা ছোট খাল ধরে বাড়ি ফিরছিলো। বললাম, বাড়ি যাওয়া লাগবে না। এখানে থাকেন, সন্ধ্যার পর আবার কাঁকড়া ধরতে যাবেন। ওরা নৌকাটি নিয়ে অন্য নৌকাগুলোর পাশে ভিড়লো।

এতো টেনশন করতে ভালো লাগে না! কই গেলো ওরা? নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে? দস্যুদের একজন বললো, চলে আসবে মামা। চিন্তা করবেন না। মনে মনে বললাম, মজনু বাহিনীকে সারেন্ডার করানোর জন্য পাশের নদীতে অপেক্ষা করছে RAB। এখন সেই মজনু যদি না আসে, কেমন করে হবে? রবিউল বললো, মজনুকে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না। কিন্তু এখন এসে সে ঝামেলা করবে না। জোয়ার চলে আসার কারণে মনে হয় জায়গা চিনতে সমস্যা হচ্ছে।

অস্ত্রগুলো সে নিজে পুঁতে রাখছে ভাই। সময় লাগলেও খুঁজে পাবে। আর খুঁজে না পেলেও ফিরে আসবে নিশ্চিত। বললাম, অন্য দস্যুদের সামনে পড়ে গেলে? বললো, শুধু জোনাব থাকলে সমস্যা হতো। অন্য কোনো দস্যু মজনুকে আক্রমণ করবে না। এছাড়া তাদের কাছে তিনটা দোনলা বন্দুক আছে। ঝামেলা হলে গোলাগুলি করে ফিরে আসবে। পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে অস্ত্র আছে। কিন্তু পর্ডাপ্ত গুলি নাই। তাই বন্দুক যুদ্ধ শুরু করার আগে হাজার বার ভাববে তারা।

জোনাবকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার অস্ত্রগুলো তো আপনি আনছিলেন। রবিউল বললো, এই জগৎটাই তো ভাই বেঈমানীর। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। আবার বিশ্বাস না করেও উপায় নাই। ভাবছিলাম, জোনাবের অস্ত্রগুলো এনে দিলে ভালো টাকা পয়সা পাবো। ডাকাতি ছেড়ে ওই টাকা নিয়ে চকোরিয়া চলে যাওয়ার কথা ছিলো। ওদিকে আমার পরিচিত লোকজন আছে। বললো, দুই লাখ টাকা দিতে চাইছিলো। টাকা নিতে আসলাম জঙ্গলে। তারপর টাকাও দেয় না, আমি যেতেও পারি না। মজনু কাউকে ঠিকমতো টাকা পয়সা দেয় না ভাই। যাই হোক, আপনি আসছেন। ভাবলাম, ওই হারামের টাকা না দিক। সারেন্ডার করে বাড়ি ফিরি।

জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলো। ট্রলারের রান্নাঘর তখনও ব্যস্ত মাছ-কাঁকড়া কাটা-বাছা নিয়ে। বললাম, আমাদের বেলায়েত সরদার থাকলে এতোক্ষণ রান্না শুরু হয়ে যেতো। আলমগীর ভাই রান্নাঘর থেকে ফিরলেন। বললাম, মজনু ভাইদের আসতে মেলা দেরি হচ্ছে। সময় কাটছে না। এখানে কি বড়শিতে মাছ হয়? বললেন, সাথে কি বড়শি আছে ভাই?

ট্রলারের ভিতরে রাখা ব্যাগ থেকে হুইল-বড়শি বের করলাম। আধার হিসাবে মাছের নৌকা থেকে কয়টা চিংড়ি নিয়ে বসে পড়লাম মাছ ধরতে। বড়শির আধার হিসাবে সুন্দরবনে চিংড়ি সহজলভ্য। ট্রলারের গলুই-এ বসে পড়লাম। এখানে মাছ পাবো বলে হয় না। কিন্তু দস্যুনেতা মজনুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটাতে আপাতত মাছ ধরতে বসলাম। এর মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পাশে এসে বসলো ইলিয়াস। বললো, ওই প্যাকেট তুলতে এতোক্ষণ লাগে? রবিউল বললো, মজনু সাহেব তো সাহেব মানুষ। জঙ্গলে হাঁটার বিষয়ে সে দুর্বল। সেজন্য সময় লাগছে। তার ওপর বন্যা জোয়ার এখন। পানি উঠে গেছে জঙ্গলের ওপর। পানি না সরা পর্যন্ত ওরা ওই জিনিষ উঠাতে পারবে না। অপেক্ষা করেন ভাই। ঘন্টা তিন এর মধ্যে ফিরে আসবে ওরা। বললাম আরও তিন ঘন্টা?

বলতে বলতে বড়শিতে টান পড়লো। হ্যাঁচকা টান দিলাম। কিছু একটা আটকেছে, বড় কিছু। আমি তো মহা খুশি। মাছের সাথে যুদ্ধ চললো। কেউ বলছে ভেটকি, কেউ বলছে সাতহাতি আবার কেউ বলছে বড় সাইজের কুঁচিয়া। সবার ধারণাই ভুল। সূতা গোছাতে গোছাতে যখন কাছে চলে এলো, তখন দেখলাম বেশ লম্বা কিছু একটা। কিন্তু কুচিয়া না। পিছনে দাঁড়ানো আলমগীর ভাই চিৎকার করে বললেন, বাউশ মাছ! বেশ কসরৎ করে উঠালাম। প্রায় তিন হাত লম্বা মাছটি তুলতে তুলতে ঘেমে গেছি। বাবুর্চি বললো, দুপুরে রান্না করে খাওয়াবো ভাই!

এই জঙ্গলে কতো জাতের মাছ যে আছে! বাউশ মাছ প্রথম দেখলাম। খেতে কেমন হবে জানি না। তবে দেখতে দারুণ! বললাম, দুপুরে খাওয়ার জন্য বাচ্চু আমাদের একটা মেধ মাছ দিয়েছে, কিন্তু দাম দেয়নি। এই মাছটা তাই বাচ্চুকে দিবো। সে বললো, দেন ভাই। রাতে আপনাদের বিদায় দিয়ে রান্না করে খাবোনে। ইলিয়াস বললো, আপনার মাছ ধরার শখের কথা শুনছি অনেক। আজকে দেখলাম। বললাম, মাছ ধরার শখ তো হয়েছে জঙ্গলে এসে। আগে বনদস্যুদের খুঁজতে জঙ্গলে নাম মাঝে মাঝে। তখন মাছ ধরার অভিনয় করতাম। মানে কেউ যাতে সন্দেহ না করে সেজন্য বড়শি হাতে আসতাম। বনরক্ষীরা ভাবতেন এই লোকটি পাগল, মাছ ধরার নেশা আছে। আপনারা ডাকাতেরাও শুনতেন আমার কথা। ভাবতেন মাছ ধরার নেশায় জঙ্গলে আসছি। কিন্তু আসলে তো আমি আসি আপনাদের খুঁজতে।

কুকু পাখি ডেকে উঠলো পাশের জঙ্গল থেকে। মানে ভাটা শুরু হয়েছে। বনদস্যু আর জেলেদের এই বহরে বসে সময় কাটানো তেমন কোনো ব্যাপার না। গল্পে গল্পেই কেটে যাবে। একটু পর পর দুধ চা আসছে। আমরা আড্ডা দিচ্ছি। জেলেদের কথায় ঘুরে ফিরে মান্নান ডাকাতের নাম আসছে। সেই ভয়ঙ্কর বনদস্যুকে দেখা হয়নি আমার। তার আগেই ধরা পড়েছিলো রাজু বাহিনীর হাতে। পরে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়।

প্রায়ই ফোনে কথা হতো তার সাথে। বেঁচে ফিরে আসার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু ভাগ্য তার পাশে ছিলো না। যেভাবে জুলফিকার, মর্তুজা, শীষ্য রেজাউল, গামা, কাশেমসহ ক্রসফায়ারে যারা মারা গেছে, মান্নানের মৃত্যুও তেমনই ছিলো। তবে শেষ সময়টি ছিলো বেশ ঘটনাবহুল। রাজু’র আস্তানায় বন্দী ছিলো সে। তারপর একটি ঘটনায় খুশি হয়ে মান্নানকে মুক্তি দেয় দস্যুনেতা রাজু। তার পরের ঘটনাগুলো সিনেমাকেও হার মানাবে!

(ছবি: পালোকাটি খালে দস্যুনেতা ইলিয়াসের সঙ্গে.. ১১ জুলাই ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top