রূপান্তরের গল্প ১৭০ | Rupantorer Golpo 170

লুকানো অস্ত্র নিয়ে ফিরলো মজনু | রূপান্তরের গল্প ১৭০

লুকানো অস্ত্র নিয়ে ফিরলো মজনু | রূপান্তরের গল্প ১৭০ | Rupantorer Golpo 170 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৭০ : বাচ্চুর কথা মনে আছে ভাই? বললাম, কোন বাচ্চু? ইলিয়াস বললো, নানি বাচ্চু। বললাম, রাজু’র দেখাশোনা করতো যে ছেলেটা? বনদস্যু ইলিয়াস বললো, কতো যে রক্তপাত হইছে সুন্দরবনে! এ ওকে মারে, সে তাকে মারে! জঙ্গলে একের পর এক ক্রসফায়ার হয়। এক দস্যু আরেক দস্যুকে ধরিয়ে দেয়।

ইলিয়াসের মুখে শুনছিলাম সুন্দরবনের দস্যু জগতের গোপন সব কথা। বিশেষ করে মধ্য সুন্দরবনের নৃশংসতার ঘটনাগুলো শুনলে গা-এ কাঁটা দেয়। রাজু’র ঘনিষ্ট সেই বাচ্চু আর বনদস্যু মান্নান ডাকাতের মধ্যে যোগসূত্রটি অন্য রকম। দুই জনেরই ভয়ঙ্কর মৃত্যু হয়েছে সুন্দরবনে।

ঘটনাটি আগেও শুনেছি। আজ ইলিয়াসের মুখে শুনছি নতুন করে। সে তখন রাজু’র দলে কাজ করতো। মজনু’র ফিরে আসার অপেক্ষা করছি। সাথে বেলায়েত সরদারও আছে। দুশ্চিন্তা বেশি হচ্ছে তাকে নিয়ে। কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো কিছুই করার নাই। মনের ভিতরে উৎকণ্ঠা নিয়ে শুনছিলাম বাচ্চু আর মান্নানের কাহিনী।

পশ্চিম সুন্দরবনে মান্নানের আস্তানায় হামলা করেছিলো রাজু বাহিনী। সেই হামলার নেতৃত্বে ছিলো মোস্তফা শেখ অর্থাৎ মাস্টার। অস্ত্রসহ মান্নানকে ধরে নিয়ে যায় তারা। তারপর বেশ কয়েকদিন বেঁধে রাখে। তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কয়েকটি অস্ত্র বের করে রাজু। কিছুদিন পর তাকে উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মান্নান তাতে রাজি হয়নি। সে থেকে যায় রাজু’র দলে। এসময় বাচ্চু ও আরিফ নামের দুই তরুন খাবারের মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে দেয়। রাজুসহ দলের সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে একটি টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় বাচ্চু ও আরিফ। এদের দুইজনই ছিলো দস্যুনেতার সবচেয়ে বিশ্বস্ত। আরিফ ছিলো লিডারের দুঃসম্পর্কের ভাগিনা।

আদাচাই ফরেস্ট অফিসে ছিলো রাজু’র আস্তানা। দুই তরুণ বনদস্যু টাকার ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দেয়। হেঁটে লোকালয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। সেভাবেই চলছিলো। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাঘের ভয়ে তারা একটি উঁচু গাছে উঠে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সাথে খাবার ছিলো না, পানিও নাই।

এদিকে সন্ধ্যার মধ্যে জেগে ওঠে রাজুসহ অন্য দস্যুরা। ঘটনা বুঝতে পেরে ওই দুইজনকে ধরে আনার নির্দেশ দেয়, বড় অংকের পুরস্কারও ঘোষণা করে। দলে দলে ভাগ হয়ে যায় দস্যুরা। কিন্তু সারা রাত চেষ্টা করেও তাদের ধরতে পারেনি কেউ। ভোর রাতে মান্নান বলে, সে যাবে বাচ্চু আর আরিফকে ধরতে। অনুমতি মিললো। দু’জন বিশ্বস্ত সদস্যকে তার সঙ্গে দিলো রাজু। মান্নানের হাতে একটি দোনলা বন্দুক, দুইটি গুলি। বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে ভেবে বাড়তি একটি গুলিও দেওয়া হয়নি মান্নানকে।

জঙ্গলের ওই দিকটা মান্নানের খুব ভালো চেনা। ভোর রাতে খাল পারি দেয়। তারপর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে। সূর্য ওঠার আগে জায়গা মতো পৌঁছে যায় তারা। গাছ থেকে নেমে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো দু’জন। কোনো কথা বলার আগে গুলি করে বসে মান্নান। অব্যর্থ লক্ষ্য! মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে গেলো বাচ্চুর নিথর দেহ। পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে আরিফ। পিছন থেকে একজন বললো, ওকে মারা যাবে না। রাজুর ভাগ্নে সে। এরপর টাকার ব্যাগ, তিনটি অস্ত্রসহ আরিফকে ধরে আনে মান্নান। ঘটনাটি ২০১১ সালের, ঘটেছিলো খুলনা সুন্দরবনের মোহাম্মদ আলী’র দোয়া’র আশেপাশে।

ডেরায় ফিরে আসলো মান্নান। খুশি হয়ে তাকে আবারও মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয় রাজু। মানে পুরস্কারের বদলে মান্নানকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র করে রাজু। কয়েকদিন পর মান্নানকে লোকালয়ে পাঠিয়ে দেয়। আবার ফোন করে তাকে ধরিয়েও দেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ঘটনাটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। ইলিয়াস বললো, রাজু’র মতো বেঈমান ডাকাত সরদার এই জঙ্গলে আর একটাও নাই। জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো তারপর?

ইলিয়াস বলছে, তখন শীতকাল। দুবলার চরে রাসমেলা হলো। এসময় সুন্দরবনে অনেক মানুষ আসে। এই সুযোগে রাজু তার বউ-বাচ্চাকে নিয়ে আসে সুন্দরবনে। নিশানখালীর ভিতরে বেলমারী খালে ছিলো স্থায়ী ডেরা। সেখানে তীর্থ যাত্রী বেশে আসা বেশ কয়েকজন অতিথিও ছিলো। মেলায় আসা পর্যটকরা চলে যায়। কিন্তু ওই অতিথিরা থেকে যায়। প্রতিদিন হরিণ শিকার করে বেশ আড্ডা জমেছিলো বেলমারীর ওই আস্তানায়। ওদিকে মান্নানকে নিয়ে রাজু বাহিনীকে ধরার অভিযানের ছক আঁকে RAB। সঙ্গে কোস্টগার্ডকে নিয়ে তারা এক ভোরবেলা হামলা চালায় রাজু বাহিনীর ওই ডেরায়।

সেই অভিযানে RAB ও কোস্টগার্ডকে পথ দেখিয়ে আনে মান্নান। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিলো সে। ভেবেছিলো অভিযান চালিয়ে রাজুকে হত্যা করা হবে, অথবা গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু জঙ্গলে সেই বন্দুকযুদ্ধ কি এতো সহজ? ঘটনাস্থল তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গুলি শুরু করার পর যেদিকটা ফাঁকা ছিলো সেদিক দিয়ে পালিয়ে যায় দস্যুরা।

গুলি করতে করতে রাজু’র ডেরায় ঢুকে পড়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেই বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন মারা যায়। সেই লাশের সারিতে মান্নানও ছিলো। এই ঘটনার পর থেকে সুন্দরবনের দস্যুরা স্থায়ী আস্তানা করতো না। যতোগুলো দস্যুদলের সাথে দেখা হয়েছে, সকলেই ট্রলার বা নৌকায় বসবাস করে। প্রতি রাতে জায়গা পরিবর্তন করে তারা। ইলিয়াস বললো, বহু কাহিনী করে জীবনটা বাঁচিয়েছি ভাই। এখন আত্মসমর্পণটা করতে পারলেই হয়। বললাম, সারেন্ডার নিয়ে টেনশন করছি না। দুশ্চিন্তায় আছি মজনুদের নিয়ে। ওরা এখনও আসছে না কেন? যদি কোনো বিপদ হয়?

মজনু বাহিনীর সদস্য রবিউল বললো, অর্ধেক ভাটা থাকতে থাকতে ফিররে তারা। উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। ততোক্ষণে কাঁকড়াগুলো রান্নার জন্য প্রস্তুত। আলমগীর ভাই বসে গেছেন। মসলা মাখিয়ে চুলায় উঠবে কাঁকড়া, হবে ঝাল করে ভুনা। মাছ রান্না করবে সরদার।

অর্ধেক জোয়ার হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের ভিতর থেকে কথা-বার্তার শব্দ পেলাম। বেলায়েত সরদার চিৎকার করে কথা বলছেন, সাথে সেই পরিচিত হাসি। মনে হলো মাথার ওপর থেকে বিশাল বড় পাহাড়টা সরে গেলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top