কোথাকার অস্ত্র কোথায় যায়! কোথাকার মাছ কোথায় আসে! | রূপান্তরের গল্প ১৭১ | Rupantorer Golpo 171 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭১ : দুপুর হয়ে যাচ্ছে। এখনও রান্নার জোগাড় শেষ হয়নি? ভাতও তোলেনি কেউ চুলায়। পুরো নৌকা বহরের লোকজনদের বকাঝকা করে শেষ করছেন বেলায়েত সরদার। পালোকাটি খালে ফিরে এসেছে তাদের নৌকা। আর এসেই শুরু করেছেন বকাঝকা।
কালো রঙ এর প্যাকেট রাখা আছে নৌকার পাটাতনে। টেপ আর দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। কাঁদা লেগে আছে। ট্রলারের সাথে নৌকা ভিড়লো। এক লাফে বেলায়েত সরদার নামলেন ট্রলারে, সোজা গেলেন রান্নাঘরে। দস্যুনেতা মজনু বললেন, খুব কষ্ট হইছে প্যাকেটটা খুঁজে বের করতে। বললেন, যেখানে পুঁতে রাখছিলাম সেখানে এক হাঁটু পানি। যখন রাখলাম তখন ভাটা ছিলো। ভাগ্যিস খালে ভাঙ্গন ধরেনি। তাহলে আর অন্ত্রগুলো পাওয়া লাগতো না। বললাম, সবাই তো অর্ধেক ভিজে গেছেন। কাপড় বদলে খেয়ে নেন। সকালের নাস্তা সেরে নেন। আপনাদের সাথে আরেক দফা কাজ করবো। মানে শ্যুটিং করবো, সাক্ষাতকার নিবো।
নাস্তায় বসলো সবাই। বেলায়েত সরদারকেও বসালাম। আধা ভাটা পার হলো। নৌকা ভাসানো তখনও। একটি কাঁকড়ার নৌকা পাশে এসে ভিড়ালো। বললো, সেও কাঁকড়া খাওয়াবে। বলেই নৌকার পাটাতনের তক্তাগুলো সরালো। দেখি খেলের ভিতরটা কাঁকড়ায় ভর্তি। বললাম, দুপুরে কাঁকড়া রান্না হচ্ছে তো। আর খাবো না। কিন্তু ওই জেলে নাছোড়বান্দা। বলে, রাতে খাবেন। বললাম, রাতে উঠে যাবো। এবার বললো, বিকালের নাস্তা হিসাবে খাবেন কাঁকড়া। বলতে বলতে কেজি পাঁচেক কাঁকড়া তুললো একটা টুকরিতে, সবগুলো বড় বড়।
এবার নেমে গেলাম নৌকা। বড় কাঁকড়াগুলো ঢেলে দিলাম নৌকার খোলে। তারপর বেছে বেছে কয়েকটি মাঝারি সাউজের কাঁকড়া নিলাম। বললাম, বিকালে ভেজে খাবো। ধন্যবাদ দিলাম। বিনিময়ে জড়িয়ে ধরলো লোকটি। বললো, একজন মানুষকে দেখলাম ত্রিশ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিতে। তার জন্য এইটুকু না করলে হয়? বললাম, শুধু দোয়া করবেন আপনারা। বলছি আর ভাবছি ঠিক পথেই আগাচ্ছি আমি। এদের ভালোবাসাটা ধরে রাখতে হবে। এরা বেঈমানী করবে না।
একটা মজার কথা মনে পড়ছিলো তখন। মাস্টার বাহিনীকে যখন RAB-এর লঞ্চে তুলে দেই, তখন তাদের শুরুতেই এককন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মোহসীন উল হাকিমকে কতো টাকা দিছো”? বিরাট শক ছিলো বিষয়টি। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাইনি। ভাবতাম, ডাকাতেরা আমাকে টাকা দিয়েছে কী না জিজ্ঞেস করুক, সাথে অবৈধ অস্ত্র-গুলির উৎসের কথাও জিজ্ঞেস করুক! সেটা করেনি, করলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখিনি। যাই হোক, এসব ভেবে কাজ নাই। সুন্দরবনটা পরিস্কার হোক।
ভাটায় আমাদের ট্রলারের তলা ঠেকে গেছে একটু কাত হয়ে গেছে। দ্রুত কাঁদায় নেমে মাঝ খালে টেনে নামালাম ট্রলার। তা না হলে চুলাও বাঁকা হয়ে থাকছে। বাঁকা চুলার উপর কাত হয়ে থাকা হাঁড়ি পাতিলে রান্না করা যায়? এছাড়া আজকের শ্যুটিং এর মূল কাজটি করবো আমাদের ভাড়া করা সেই ট্রলারের উপর।
কালো প্যাকেট কাটতেই গড়িয়ে পড়লো লুব্রিক্যান্ট। কালো রঙ হয়ে গেছে সেই মবিলের। ভিতরে কয়েকটি অস্ত্রের যন্ত্রাংশ। সবগুলো একনলা ও দোনলা বন্দুক। বললাম, গুলির প্যাকেট কই? মজনু বললেন, গুলির প্যাকেট আগেই তোলা আছে। বললাম, এখন সবকিছু গুছিয়ে ফেলেন। প্যাকেটের অস্ত্রগুলো বের করে পরিস্কার করছিলো রবিউল। এবার আরও দুইজন হাত লাগালো। সবগুলোই ১২ বোর-এর বন্দুক। অবশ্য সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত ও সহলভ্য এই অস্ত্র।
রবিউলকে জিজ্ঞেস করলাম, বাইরে থেকে অনেকে বলে একে-৪৭ বা ওই ধরনের আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেন আপনারা। আবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ বলতেন, সুন্দরবনের ডাকাতদের কাছে হাতে বানানো কিছু অস্ত্র ছাড়া কিছুই নাই। জঙ্গলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই দুটি তথ্যই ভুল। এই জঙ্গলে অনেকগুলো ডাকাত দলের সাথে দেখা হলো। কারও কাছে সেরকম কোনো অস্ত্র দেখলাম না। সর্বোচ্চ অটোমেটিক শর্টগান ১১৪৭, অটোমেটিক পয়েন্ট টুটু বন্দুক। এছাড়া সাধারণ বন্দুক। পাইপ গান বা হাতে বানানো অস্ত্র হাতে গনা। বললাম, আপনারা তো চাইলে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কিনতে পারেন।
সুন্দরবনে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকা লাগে। কিন্তু সব সময় গোলাগুলি করা লাগে না। হাতে কতোগুলো অস্ত্র আছে, পর্যাপ্ত গুলি আছে কী না, সেটাই এই জঙ্গলের বনদস্যুদের শক্তি। এই শক্তি যার যতো বেশি সেই দস্যুদলের দাম ততো বেশি। অন্যরা ভয় পায় কারণ যুদ্ধ শুরু করলেই হবে না, গুলি ফুরিয়ে গেলে সেই যুদ্ধে পরাজিত হতে হবে। ইলিয়াস ও মজনু এখন আমার সামনে বসা। তারা বললো, সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের মালিক ছিলো রাজু, তারপর মোতালেব, জুলফিকারের অস্ত্র ছিলো বেশি। মাঝে মাঝে নামে আকাশ বাবু নামের এক বনদস্যু দল আছে। তাদের কাছেও অস্ত্র আছে অনেকগুলো। বললাম, সবই তো এই বন্দুক, অন্য কিছু নাই? বললো, জঙ্গলে দুইটি দলের কাছে স্টেনগান ছিলো। তার একটা ছিলো রাজুর কাছে। তবে গুলি ছিলো না।
আকাশ বাবুর ট্রলারে একটা কামানের মতো বানানো অস্ত্র আছে। ট্রলারের আগায় সেটা সেট করা থাকে। গুলি করলে বিকট শব্দ হয়। এর বাইরে কয়েকটি থ্রি নট থ্রি আছে। নোয়া মিয়ার কাছে আছে একটা ভারতীয় বিশেষ বন্দুক। থ্রি নট থ্রির মতোই। কিন্তু গুলিগুলো একটু মোটা আর বড়। ইলিয়াস বললো, অস্ত্র যাই থাকুক সেটার গুলি তো থাকা লাগবে। আমরা অবৈধ বাজারে যে গুলি পাই তার সবই ১২ বোর-এর বন্দুকের গুলি। আগে প্রতি পিস ৫০০ টাকায় কিনতাম। এখন তার নাম হাজারের ওপর। ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায় কিনতে হয় এক একটা গুলি। মনে পড়লো, থ্রি নট থ্রি’র এক একটা গুলি মাস্টার বাহিনী কিনেছিলো তিন হাজার টাকা পিস।
আমরা বন্দুক-গুলি কিনি ব্ল্যাক মার্কেট থেকে। এমনিতেই অবৈধ অস্ত্রের দাম বেশি। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে দুই গুন, তিন গুন বেশি দামে অস্ত্র বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। কয়েক হাত বদল হয়ে একটা পুরনো একনলা বন্দুকের দাম পড়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। দোনলা বন্দুকের কোয়ালিটি অনুযায়ী দাম তিন লাগের ওপর পড়ে। শর্টগানগুলো কিনতে হয় ৭/৮ লাখ টাকায়। লেটেস্ট এইট শ্যুটার বন্দুকের দাম ১৪/১৫ লাখ টাকাও দাম ওঠে। ইলিয়াস বললো, আমরা জেলেদের ওপর অত্যাচার করে যে টাকা কামাই, তার বড় অংশই নিয়ে যায় অবৈধ অস্ত্র-গুলির ব্যবসায়ীরা। শুধু অস্ত্র না, পানি, চাল, ডাল থেকে শুরু করে সবকিছুই আমাদের ডাবল দামে কিনতে হয়।
তার মানে তো সবাই ব্যবসা করছে! যারা বাজার সদা কিনে পাঠায় তারাও ব্যবসা করছে? মজনু বললেন, নাম শুধু আমাদের, আর টাকা ঢোকে অনেকের পকেটে। বললেন, অনেক সাংবাদিকেও টাকা নেয় আমার কাছে। কতোজনকে মাসোহারা দেই, তাদের নাম শুনলে বিশ্বাস করবেন না। বললেন, শুধু টাকা না, মাছ, কাঁকড়া, মধু পাঠাতে হয় নিয়মিত। ঢাকায় বড় বড় নেতা, হর্তা-কর্তাদের কাছে যে বড় বড় মাছ যায়, সেগুলো কি কিনে পাঠায় কেউ? সব আমাদের কাছ থেকে নেয়।
দস্যুরা বলছে, ধরেন, সাগর থেকে একটা ইলিশের ট্রলার ধরে আনলাম। কেবিন ভরা মাছ থাকলে কখনও ১৫/২০ হাজার পিস মাছও থাকে। সেই মাছ আমাদের বিশ্বস্ত কোনো মাছ ব্যবসায়ীর হাতে দেই। এতো মাছ আড়তে তুললে জানাজানি হবে। তাই বিভিন্ন মহলে উপহার হিসাবে পাঠানো হয় এ মাছ। আপনারা ঢাকায় বসে যে উপহারের মাছ খান, সেগুলো আমাদের ডাকাতি করা মাছ। কারও বড় বড় শাপলা পাতা মাছ খুব পছন্দ, কেউ বড় বড় পাতাড়ি, লাক্ষা মাছ খেতে পছন্দ করে। নানা জাতের চিংড়িও উপহার হিসাবে পাঠানোর জন্য আমাদের কাছে বলে, আমরা পাঠিয়ে দেই।
ইলিয়াস একটা কথা বলছিলো, আপনার এই সারেন্ডারের উদ্যোগে জেলেরা একটু শান্তি পাবে কিন্তু অনেকে পছন্দ করবে না। বললাম, তা টের পাচ্ছি অনেক আগে থেকে। তা না হলে আমাবে নিয়ে অপপ্রচারে নামবে কেন মানুষ? দস্যু নির্মূলের এ উদ্যোগে সুন্দরবনের একজন মাছ ব্যবসায়ীকেও খুশি হতে দেখলাম না। অবশ্য তাতে কিছু আসে-যায়ও না। জেলেদের জীবনে একটু স্বস্তি আসলেই সন্তুষ্ট আমি।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন সরদার। হাতে স্টিলের প্লেটে মেধ মাছের তরকারি। বললেন, ও ভাই, একটু টেস্ট করে দেখেন কেমন হলো রান্না! অসাধারণ স্বাদ! চেখে দেখতে দেখতে আলমগীর ভাই নিয়ে আসলেন কাঁকড়া ভুনা। এটাও টেস্ট করলাম, দারুণ স্বাদ।
আকাশের অবস্থা মনে হয় ভালো না। শেষ ভাটায় বৃষ্টি হবে। মনে হচ্ছে বড় বৃষ্টি আসবে। বড় মানে ভারী বৃষ্টি, হবেও লম্বা সময়ের মধ্যে। দস্যুদেরকে বললাম, হাতে সময় আছে খুব বেশি হলে তিন ঘন্টা। বরিশাল RAB-এর মেজর আদনান আসলেই তাঁর হাতে তুলে দিবো আপনাদের। মনে মনে ভাবছি, পরিকল্পনা মতো এই রাতটা পার করতে পারলে নতুন সফলতা আসবে। বিলুপ্ত হবে সুন্দরবনের আরও দুইটি জলদস্যু দল।
(ছবি: মজনুর ডেরা, জুলাই ২০১৬)