ডাকাতি করতে আসছি, মানুষ মারতে আসিনি | রূপান্তরের গল্প ১৭২ | Rupantorer Golpo 172 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭২ : আপনি দেখা করে যাওয়ার পর থেকে জোনাব ফোন দিচ্ছে। ইন্ডিয়ান নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়। বলে, তার অস্ত্রগুলো যেন সরকারের কাছে জমা না দেই। দস্যু জীবনের শেষ দিনে সুন্দরবনে বসে কথাগুলো বলছিলেন মজনু। পাশ থেকে একজন বললো, ভুলটা চেঙ্গিসই করছে। ওকে বাঁচায়ে রাখাই ভুল হইছে। চেঙ্গিস মানে রবিউল। জোনাবকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অস্ত্রগুলো কেড়ে এনেছিলো সে। পাশে বসে অস্ত্র পরিস্কার করতে করতে বললো, ডাকাতি করতে আসছি, মানুষ মারতে আসিনি!
এই জঙ্গলে রক্তপাতের ইতিহাস আছে। তবে ঠান্ডা মাথায় খুণের ঘটনা হাতে গণা। জিম্মি জেলেদের হত্যারর ঘটনা নাই বললেই চলে। বনদস্যুরা অস্ত্র বহন করে নিজেদের জীবন বাঁচাতে, অন্যদের ভয় দেখাতে। বন্দুকের মালিকানার ওপর দস্যু দলের মালিকানা নির্ভর করে। তাই অবৈধ অস্ত্রের বাজার থেকে বন্দুক-গুলি কেনাকাটা করে তারা। সুযোগ পেলে কেড়ে নেয় অন্যের অস্ত্র। দস্যি সম্রাট রাজু শতাধিক অস্ত্রের মালিক ছিলো। যার অধিকাংশ অন্য বাহিনীকে পরাস্ত করে, ধোঁকা দিয়ে কেড়ে নেওয়া।
জোনাব তাহলে এখন সুন্দরবনে নাই? ওরা বললো, অস্ত্র কেড়ে আনার পর সে ইন্ডিয়া চলে যায়। ওদিকে সে ভুয়া পরিচয় দিয়ে রেশন কার্ড নিয়েছে। এদেশে ফেরারি বলে বেশির ভাগ সময় হয় জঙ্গলে থাকে, না হলে ভারতে থাকে। এই দেশে নিজের এলাকায় থাকার উপায় নাই। তার অস্ত্রগুলো কেড়ে আনছি আমরা। আবার সেগুলো সারেন্ডারে দিয়ে দিচ্ছি। তাই মাথা নষ্ট তার। বললাম, টেনশনের কিছু নাই, আপনারা সারেন্ডার করেন। ওর সাথে আমি কথা বলবো পরে। জোনাবকেও তো আত্মসমর্পণ করতে হবে। ওরা বললো, ওই ডাকাত জীবনেও সারেন্ডার করবে না।
আমাদের ট্রলারের ছাদে তখন বন্দুকের মেলা বসেছে। মাস্টার বাহিনীতে যেমন সুলতান কাকা ছিলেন, তেমনি মজনু বাহিনীতে আছে রবিউল। পশ্চিম বাদায় যার পরিচিতি চেঙ্গিস বা চেঙ্গুস নামে। ট্রলারের ছাদে বসে একটার পর একটা বন্দুক জোড়া লাগাচ্ছে, পরিস্কার করছে। বললাম, এতো ঘষা-মাজার দরকার নাই। কাল তো সব জসা হয়ে যাবে। বললো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে ময়লা অস্ত্র জমা দেওয়া যায়? পলিথিনের প্যাকেট থেকে বের করা বন্দুকগুলো পরিস্কার করে জোড়া লাগানো শেষ। সেগুলো বেঁধে রাখা হলো ট্রলারের নিচে।
তারপর সশস্ত্র দস্যুদের অস্ত্রগুলো একে একে পরিস্কার করা হলো। এসময় বন্দুকের গুলিগুলো বের করে রাখলাম। জঙ্গলের কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না। এই কথাটি মাথায় নিয়ে ঘুরি। তাই প্রতি পদক্ষেপে ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করি। তারই অংশ হিসাবে গুলিগুলো আলাদা করে ট্রলারের ভিতরে জমা করছিলাম। শুধু দস্যুনেতা মজনু ও এনামুলের সাথে গুলি রেখে বাঁকী সবাইকে গুলিশূণ্য করে ফেললাম। এই কাজে সহযোগিতা করলেন আমার সহকর্মীরা। ক্যামেরা বের করলেন আমাদের ভিডিওগ্রাফার পলিন।
ইলিয়াস ও মজনু’র ইন্টারভিউ নিলাম। অন্য বনদস্যুদেরও ছবি নিলাম। মোটকথা দু’টি বনদস্যু দল যে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে সেবিষয়ে কাজ করলাম। কথা বললাম জেলেদের সঙ্গেও। সারেন্ডারের আগ মুহুর্তের পরিবেশ তুলে রাখলাম ক্যামেরায়। কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে হলো। কারণ পূর্ব আকাশে মেঘ কালো হয়ে আসছে। জুলাই-আগস্ট মাসে সুন্দরবন উপকূলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। একবার শুরু হলে থামতে চায় না। আবার জোয়ার ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়েও বৃষ্টি নামে। ভাটা শেষ হতে আর ঘন্টা খানেক বাঁকী। শেষ ভাটায় বড় বৃষ্টি নামবে সেকথা জেলে ভাইরা আগেই বলেছিলো।
এবার সব মিলিয়ে আত্মসমর্পণ করবে ১১ জন বনদস্যু। অস্ত্র ২৫টি, গুলি এক হাজারের বেশি। তাদের গোছগাছ শেষ। তাদের সহযোগী আছে আরও ১০ জন। জেলে ভাইরা আছেন প্রায় ১৫ জন। আমার টিমে ৭ জন। সব মিলিয়ে ৪০ জনের বেশি আমরা। এতো জনের রান্না করাটা বেশ কঠিন। বিশেষ করে উপযুক্ত চুলা ও হাঁড়ি পাতিল না থাকলে বেশ ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য নৌকায় নৌকায় ভাত রান্না হয়েছে কয়েকটি পাতিলে। ট্রলারের রান্নাঘরে বড় হাঁড়িতে রান্না হলো মেধ মাছের ভুনা, কড়াই-এ রান্না হয়েছে কাঁকড়া ভুনা।
ট্রলারের ছাদে গোল হয়ে বসে পড়লাম, অন্যরা বসলো নৌকায় নৌকায়। চামচ হাতে কোমড় বেঁধে নামলেন বেলায়েত সরদার। খোন্তা আর কড়াই নিয়ে নামলেন আলমগীর ভাই। দ্রুত চললো চামচ আর খোন্তার বাড়ি। তরকারির হাঁড়িতে ঘন ঘন বাড়ি মারছেন সরদার। বলছেন, সীমিত তরকারি দিয়ে এতো মানুষকে খাওয়ানো সোজা কথা? এমন ভাবে তরকারি দিবো যে সবাই সমান পাবে, আবার কম পড়লেও কেউ অভিযোগ দিতে পারবে না! সেই হাসি দিয়ে দু’জন মিলে সবাইকে খাইয়ে দিলেন দুপুরের খাবার।
এখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না একদম। তাই সব রকমের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমরা। বাচ্চুকে বললাম খালের গোঁড়ায় যাও। বড় নদীটা দেখে আসো। RAB-এর ট্রলারটা জায়গা মতো আছে কী না, আরেকটা ট্রলার আসলো কী না খবর নিয়ে আসো। বাচ্চুর নৌকাটি ছোটখাটো কিন্তু বেশ মজবুত। একাই বেয়ে চলে গেলো মালঞ্চের দিকে। সবাইকে প্রস্তুত হতে বললাম। বরিশাল থেকে RAB-এর উপ-অধিনায়ক আদনান কবীর আসলেই বের হবো আমরা। দস্যুদের RAB হেফাজতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত আমার কাজ। আর সেই মুহুর্তটি ক্যামেরাবন্দী করার দায়িত্ব আমার টিম-এর।
সারেন্ডারের সময় বনদস্যুদের প্রতি আমার একটাই শর্ত, সবগুলো অস্ত্র-গুলি জমা দিতে হবে। আর আমার কাছে ওদের চাওয়া, পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিও করবো, প্রচার করবো। মূলত বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চায় তারা। আগে যতোবার সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে আসলে তাদের ছবি তোলার বিষয়ে নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা থাকতো। আর এখন তারাই বলে ছবি নিতে। এই জায়গায় দারুণ একটি রূপান্তর হচ্ছে।
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। বাচ্চুর ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি আমরা। মিনিট দশের মধ্যে ফিরলো সে। জানালো, আরেকটা ট্রলার আসলো মাত্র। আগের ট্রলারের পাশে ভিড়েছে সেটি।
ক্যামেরাসহ আমাদের জিনিষপত্র ট্রলারের ভিতরে ঢুকানো হলো। জেলেরা যার যার নৌকার ছই তুলে দিলো। বিছানা-পত্র ঢেকে ফেললো ছইয়ের নিতে। নিজেরাও আশ্রয় নিলো সেখানে। পলিনকে বললাম, ক্যামেরার রেইনকোট পড়িয়ে নেন, আমাদের রেইনকোটগুলো বের করেন, সবাই প্রস্তুত হন, রওনা দিবো আমরা। ইলিয়াস ও মজনু বাহিনীর সবাইকে তুলে নিলাম আমাদের ট্রলারে। এক পোয়া জোয়ার না হলে এই খাল থেকে বের হতে পারবো না। তবে প্রথম জোয়ারে জেলেরা নৌকা ছাড়ে। গত রাত থেকে সঙ্গে থাকা জেলেদের বললাম, কেউ জোয়ার দিতে চাইলে যেতে পারেন।
কাঁকড়ার জেলেরা রওনা দিলো। জাল আর বড়শির জেলেরা সামনের ভাটায় নিচে নেমে যাবে। ওরা সবাই বিদায় নিলো। বৃষ্টির মধ্যে আমরা সবাই ট্রলারের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আরও ঘন্টা খানেক পর ট্রলার ছাড়বো আমরা। ততোক্ষণ চলবে মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে চা-আড্ডা। গল্পে গল্পে ওদের দস্যুতায় আসার গল্প শুনলো। সত্যিই তো, তারা সবাই পরিস্থিতির শিকার। বাধ্য হয়ে ডাকাতি করতে এসেছে, খুনোখুনি করতে না।
তরুণ বনদস্যু রহমত বললো, আমরা কি সত্যি সত্যি বাঁচতে পারবো ভাই? বাড়ি ফিরতে পারবো ভাবতেও পারিনি। এবার মনে হয় বাপ-মায়ের মুখটা দেখতে পারবো! বললাম, মন্ত্রীর কাছে সারেন্ডার করবে তোমরা। কাল সকাল এগারোটার দিকে মংলার ফুয়েল জেটিতে হবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। তোমার বাবা-মাকে সেখানে আসতে বলো। অন্যদেরও একই কথা বলবে। সেখানেই স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারবে তোমরা। এনামুলকে বললাম, এক পোয়া জোয়ার হলেই ট্রলার ভাসাবে, মালঞ্চ নদীতে যেতে হবে। তোমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, শ্যুটিং করতে হবে, রাতেই রওনা দিয়ে মংলা যেতে হবে। অনেক কাজ সামনে। এর মধ্যে বড় বৃষ্টি আসবে। আজকে ভিজে ভিজেই মনে হয় সব কাজ সারতে হবে।