অঝর বৃষ্টির মধ্যে বিলুপ্ত হলো দু’টি দস্যু দল | রূপান্তরের গল্প ১৭৩ | Rupantorer Golpo 173 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৩ : পশ্চিম সুন্দরবনের খাল পালোকাটি। একটু ভিতরে নোঙ্গর করে আছি। মেজর আদনান কবীরদের ট্রলার বহর নোঙ্গর করা মালঞ্চ নদীর মাঝখানে। এদিকে বৃষ্টি নেমেছে খুব। ঝড়-বৃষ্টিতে আকাশ-বাতাস অন্ধকার! সুন্দরবনে মাঝে মাঝে এমন হয়। বর্ষা কালে কখনও একটানা বৃষ্টি হয় দিনের পর দিন। আজকের বৃষ্টিটাও বাড়বে।
সুন্দরবনের ভিতরে বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। ভারী বৃষ্টি আরও পছন্দের। কষ্ট হলেও মনে হয় ক্লান্তি-শ্রান্তি ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। নৌকার ছইয়ের ভিতরে বসে বা শুয়ে এই বৃষ্টি উপভোগ করার মতো। যদি কেউ এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে তবে তা আনন্দের। না পারলে এই বৃষ্টি শুধু ভোগান্তির। যাই হোক, সামনের কয়েক ঘন্টার বৃষ্টি আমাদের জন্য ভোগান্তির। তবে কষ্টের মধ্য দিয়ে যে কাজটুকু করবো আমরা সেটি স্বস্তির, ভালো লাগার।
বৃষ্টির প্রস্তুতি আমার ছিলো। কিন্তু RAB সদস্যদের জন্য এটা বেশ ঝামেলার। সুন্দরবনের ভিতরটা এমনিতেই অপরিচিত, তার ওপর এমন উথাল-পাথাল বৃষ্টিতে নাকাল হয়ে যাওয়ার কথা। বড় নদীতে একটু ঝড় উঠলে তো আরও বিপদ।
দেখতে দেখতে জোয়ার হয়ে গেলো। সামনের খালে পানি ঢুকেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভাসবে আমাদের ট্রলার। মাঝি-মাল্লাদের বললাম, বৃষ্টি কি কমবে? ওরা বললো, এ বৃষ্টি থামার না। বললাম, তাহলে সবাই তৈরি হন। খালে পানি ভরলেই রওনা দিবো আমরা। কিন্তু এই অবস্থায় ট্রলার চালাতে রাজি না সুকানি। বৃষ্টিতে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া বাতাস বাড়ছে। মালঞ্চ নদীতে গেলে ডুবে যাবো আমরা। বললাম, কেবল জোয়ার হলো। ডুবলে সাঁতরে কূলে চলে যাবো। তবুও রাজি না। এবার সরদারের দিকে তাকালাম। চোখে চোখে কথা হয়ে গেলো।
ইঞ্জিন চালু হলো। সুকানিতে দাঁড়ালেন বেলায়েত সরদার। বৈরী পরিবেশে সুন্দরবনে চলাফেরায় অভিজ্ঞ তিনি। তাই ট্রলারের মূল মাঝিকে অনুরোধ করে ভিতরে বসালাম। উনি শুধু বললেন, ট্রলার ভাঙ্গলে আবার গড়ে দিতে হবে। মালিক কিন্তু কোনো কথা শুনবে না। বললাম, সেই চিন্তা আমার। বলতে বলতে নোঙ্গর তোলা হলো। আহ্নি ঘুরিয়ে আমরা চললাম ছোট খাল ধরে মালঞ্চের দিকে।
আধা ঘন্টার মতো লাগলো। বড় নদীতে বের হয়ে দেখি RAB-এর ট্রলার দুটি ভেসে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে। কাছাকাছি গিয়ে তাদের ইঞ্জিন চালাতে বললাম। আমাদের পিছে পিছে আসার ইশারা করলাম। এখানে নেটওয়ার্ক থাকলে সুবিধা হতো। কিন্তু না থাকলেও কাজ চালিয়ে নিতে হবে। এই মুহুর্তে প্রথম কাজ হলো কাছাকাছি কোনো মাঝারি খালে ঢুকতে হবে। জোয়ার হচ্ছে, কাজে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। বনদস্যু রহমতকে বললাম, বেলায়েত সরদারের পাশে দাঁড়াও, পথ দেখাও।
কালির খালের আগেই মাঝারি একটি খালে প্রবেশ করলাম। নোঙ্গর করলাম কূল ঘেঁষে। বৃষ্টি হলেও এখানে বাতাসের ঝাপটা নাই, খালের পানিও একদম ঠান্ডা। একে একে অন্য ট্রলার দুটো পাশে এসে নোঙ্গর করলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পার হলাম। বললাম, বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নাই। যা কিছু করার এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে করতে হবে। সেখানে বসে আমাদের শ্যুটিং এর পরিকল্পনা জানালাম। বললাম, বনের ভিতরে বনদস্যুদের হস্তান্তর করবো।
সন্ধ্যা নামার আগে সব কাজ শেষ করবো আমরা। কাজ বলতে, মজনু ও ইলিয়াস, এই দুই দস্যুনেতাকে তাদের সদস্যদের নিয়ে RAB হেফাজতে যাবে। এই দৃশ্য ধারণ করবো আমি। সাক্ষাতকার নিবো, পুরো প্রক্রিয়া কাল সকাল থেকে প্রচার করবো যমুনা টেলিভিশনে। ঘটনাটি ঘটবে একটু পর। তবে সকাল পর্যন্ত পুরো বিষয়টি গোপন রাখবো।
অস্ত্রসহ দস্যুদের নিয়ে আমরা নেমে গেলাম সুন্দরবনে। এই নেমে যাওয়াটা এক লাইনে লিখে ফেললাম। কিন্তু নামার প্রক্রিয়াটি এক লাইনের না। বনদস্যুরা নামার আগেই আমরা নামবো। ট্রলার থেকে নামতেই প্রায় এক কোমড় কাঁদা। তারপর চর ধরে হেঁটে উঠলাম তীরে। পিছনে পিছনে নেমে পড়লো বনদস্যুরা। বনের ভিতরে ঢুকে পড়লাম বড় ঝামেলায়। কাঁদার ভিতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। শ্বাসমূলে লেগে কেটে-ছিঁড়ে গেলো শরীরের কয়েক জায়গা। একটার পর একটা কাঁটা ঢুকলো পায়ের তালুতে।
কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে কাঁটাগুলো তুলবো সেই উপায় নাই। বৃষ্টি যেন বিদ্রোহ করেছে। দম নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। বেলায়েত সরদার আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, কাঁটা ফোটে ফুটুক, কাজ শেষ করে তুলে দিবোনে। ব্যাথা তার মতো করে করুক, ওরে পাত্তা দিলে চলবে না। জঙ্গল থেকে ফিরে তেল গরম করে দিবোনে। দেখবেন ব্যাথা রাতের মধ্যেই গায়েব হয়ে যাবে।
সেখানেই একটু খালি জায়গা বের করলাম। এদিকে বহরের সদস্যদের নিয়ে নেমে আসলেন মেজর আদনান কবীর। জঙ্গলের ভিতরে হেঁটে আসার জন্য একটা পথের মতো করা হয়েছে। সেদিক দিয়ে আসলেন তাঁরা। ইউনিফরমগুলো ভিজে একাকার। তাঁদের অস্ত্রগুলো ভিজছে বৃষ্টির পানিতে। ওই এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে দিয়ে কসরৎ করে হেঁটে আসলেন তাঁরা। বুঝতে পারছি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সদস্যদের চোখে মুখে বিরক্তি। কিন্তু তাদের স্যার যখন নেমে হাঁটছেন, তখন অন্যদের কিছু বলার থাকে না। স্যারের পিছু পিছু হাঁটলো তারা। এই দলের নেতৃত্বে মোস্তাফিজ মামা। বরিশাল RAB-এর মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দাদের প্রধান। সৈনিকদের বেশ বকাঝকা করতে থাকলেন। সেই চাপে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হলো সবাই।
আমার একপাশে বনদস্যুরা প্রস্তুত সারেন্ডারের জন্য। আরেক পাশে তাদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত RAB। কিন্তু বিপত্তি বাধলো অন্য জায়গায়। আমাদের ক্যামেরা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। পলিন মনে হলো বৃষ্টির মধ্যেও ঘামছে। ক্যামেরার ওপর ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে রাজীব। ওই বৃষ্টির মধ্যে প্রত্যেকেই কাঁকভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে।
১১ জুলাই ২০১৬। মজনু আর ইলিয়াসের দস্যু জীবনের শেষ দিন। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো দস্যুরা। এমন দৃশ্য দেখবো সেই ভাবনা ছিলো মাথায়। কিন্তু সেটি বাস্তব হবে, চোখের সামনে ঘটবে, কল্পনাও করিনি। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে এতো মানুষ কাজ করছে! বছরের পর বছর ধরে সেই প্রতিরোধ সামলানোর চেষ্টা করছি। বৃষ্টিতে ভিজছি একটানা, পা দুটো ক্ষত-বিক্ষত, রাতে ঘুমাইনি, দিনের বেলাতেও এক মুহুর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে পারিনি। সব মিলিয়ে অবসাদে ভরা আমার চারপাশ। তবুও দাঁড়িয়ে আছি মনের শক্তি দিয়ে। এতো ক্লান্তি ভর করে আছে, আমাকে দেখে কারও বুঝার উপায় নাই। ভাবনার ভিতরে হারিয়ে গেলাম।
পলিনের ডাকে স্বস্তি ফিরলো। ক্যামেরা ঠিক হয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে ছবি ভালো হবে না। বললাম, যেটুকু হয় তাতেই চলবে। মাইক্রোফোনটি ঢেকে নিয়েছিলাম পলি ব্যাগ দিয়ে। সেটি হাতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রথমে দস্যুনেতা মজনু ও ইলিয়াসকে হেফাজতে নিলো RAB। তারপর একে একে অস্ত্র জমা দিলো অন্য বনদস্যুরা।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবাই মিলে কাজ শেষ করলাম। তারপর বনদস্যুদের উঠানো হলো RAB-এর ট্রলারে। অস্ত্রগুলো বুঝিয়ে দিলাম। এরপর বৃষ্টি কমার অপেক্ষা। জোয়ার হচ্ছে। পানি বাড়ছে নদীতে। জোয়ারের স্রোত থাকতে থাকতে রওনা দিবো লোকালয়ের উদ্দেশ্যে। বৃষ্টিতে নাকাল সবাই। তবে সেই কষ্টকে ছাপিয়ে গেছে আজকের ঘটনা। সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে আরও দুটি দস্যু বাহিনী- মজনু ও ইলিয়াস।
(ছবি: আমার ডান পাশে দস্যুনেতা মজনু, বাম পাশে মেজর আদনান কবীর)