বৃষ্টিতেও সারেন্ডার হবে! হেলিকপ্টার না উড়লে মন্ত্রী আসবেন সড়ক পথে | রূপান্তরের গল্প ১৭৪ | Rupantorer Golpo 174 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৪ : জোয়ারের তীব্রতা বাড়ছে। প্রচুর স্রোত, আর পানির চাপে টগবগ করছে খালের পানি। মালঞ্চের খালগুলো ভীষণ সুন্দর। বৃষ্টি হলে সেই সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েক গুন। শেষ জোয়ারে পানি ফুলে-ফেঁপে উঠলো। পুরো জঙ্গল ডুবে গেলো পানিতে।
তিনটি ট্রলার একটা সঙ্গে আরেকটা বাঁধা। পানির চাপে ট্রলারগুলো নিজেদের মধ্যে ধাক্বা খাচ্ছে। আবার পাশের জঙ্গলেও উঠে পড়ছে মাঝে মাঝে। বৃষ্টির মধ্যে ট্রলারের মাঝি-মাল্লারা ব্যস্ত সেই চাপ সামলাতে। আমি আছি মেজর আদনানের সঙ্গে, যে ট্রলারে তোলা হয়েছে বনদস্যুদের। আর সহকর্মীরা সব আমাদের ট্র্রলারে। তৃতীয় ট্রলারটি মূলত প্রোটেকশনের জন্য। কিন্তু আপাতত সবাই ব্যস্ত নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে। প্রকৃতির বৈরীতা এখানে তীব্র।
জঙ্গলের মধ্যে একটি বড় ঘটনা ঘটে গেলো। অতি গোপনে, নি:শব্দে। আবহাওয়া খারাপ বলে আমাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু শাপে বর হিসাবে কাজ করলো এই বৃষ্টি। ইলিয়াস আর মজনু RAB হেফাজতে গেলো, কিন্তু কেউ জানতেও পারলো না। সারেন্ডারের অখুশি যারা তারা এই প্রক্রিয়াকে নষ্ট করতে তৎপর। এদের মধ্যে আছেন কয়েকজন সুন্দরবনের ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্রের কারবারী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স, সাংবাদিক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা ঘুরে ফিরে ঊর্ধতনদের বুঝাতে চাচ্ছেন যে সারেন্ডারের বিষয়টি সাজানো। কেউ কেউ বলেন, উৎকোচের বিনিময়ে চলছে এসব। আবার কেউ বলছেন, বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ কোনো কাজে আসবে না। এই অপপ্রচারগুলো সামাল দেওয়া বেশ কঠিন। তাই সবকিছু গোপন রাখার চেষ্টা করি সব সময়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেই কাজ গোপন রাখা সহজ হয়েছে।
দুইজন ডাকসাইটে দস্যুনেতা RAB হেফাজতে। সাথে অস্ত্র-গুলি ও দস্যদলের সদস্যরাও আছে। কিন্তু তার পরও দুশ্চিন্তায় মেজর আদনান। আমার শুধু মনের ভিতরটা খচখচ করছে। কী বিষয় আদনান? উনি বললেন, সবই পরিকল্পনা মতো হলো ভাই। কিন্তু কালকেও তো বৃষ্টি হবে। সারাদিন বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন কী করে? যদি মন্ত্রীসহ ঊর্ধতনরা না আসেন তাহলে মহা বিপদে পড়ে যাবো আমরা।
বনদস্যুদের হেফাজতে রাখার সময় ২৪ ঘন্টা। আইন অনুযায়ী এর মধ্যে তাদের থানায় জমা দিতে হবে। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় একই রকম বিপদে পড়েছিলাম। বললাম, ওই টেনশন আমি নিতে পারবো না। এসব তোমাদের ব্যাপার। যা কিছু হোক, আত্মসমর্পণের এই উদ্যোগ নষ্ট করা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বৃষ্টির কারণে আসতে না পারেন তবে দস্যুদের ফেরত নিয়ে নিবো। আমার কাছে রাখবো তাদের। তোমাদের সবকিছু টিকঠাক হলে বলবে, তখন এই দস্যুদের নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যাবো। আসলে মানষিক চাপ আর নিতে পারছি না।
জোয়ার শেষ হলো। সেই সাথে কমলো বৃষ্টি। জোয়ার ভাটার সাথে অদ্ভুত সম্পর্ক এই বৃষ্টির। সন্ধ্যা নামছে। তবে পুরো অন্ধকার হতে সময় লাগবে। হাতে অন্তত এক ঘন্টা সময় আছে। উনাদের বললাম, মজনু বাহিনী ও ইলিয়াস বাহিনীর অস্ত্র-গুলিগুলো একসাথে বেঁধে রাখা আছে। সেগুলো বুঝে নিতে হবে। এখান থেকে রওনা হবো সন্ধ্যার পর, মানে অন্ধকার হলে। রাতের অন্ধকারে পাড়ে উঠবো। সবাইকে নিয়ে সড়ক পথে পৌঁছাবো মংলায়।
গোছগাছ করতে করতে সন্ধ্যা পেরুলো। ভেবেছিলাম সন্ধ্যার পর একটু বিশ্রাম নিবো। কিন্তু সেই সময় আসতে অনেক দেরি। এদিকে ভাটা ঠেলে উজানে যেতে সময় লাগবে। তাই দেরি না করে রওনা দিলাম। মাঝের ট্রলারে বনদস্যুদের নিয়ে থাকবেন মেজর আদনান কবীর। তার একপাশে চলছে RAB-এর আরেকটি ট্রলার। আরেক পাশে আমরা।
মালঞ্চ নদী থেকে চুনা নদীতে উঠতে ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। তারপর স্রোতের অনুকূলে আরও এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম মুন্সিগঞ্জ। বন বিভাগের জেটিতে ভিড়লাম। সেখানে মজনু বাহিনীর সদস্যদের স্বজনরা ভীড় করেছে। এক নজর দেখা করিয়ে RAB-এর গাড়িতে তোলা হলো বনদস্যুদের। রওনা হলো তারা।
ট্রলারের ভাড়া চুকিয়ে আমরাও উঠলাম আমাদের গাড়িতে। RAB-এর গাড়ি বহর চলে যাওয়ার পর আমরাও রওনা দিলাম। গাড়ি ছাড়তেই ফোন দিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। বিস্তারিত জানালাম। বললাম, কাল বৃষ্টি হবে। আগের বারের মতো কালও মনে হয় হেলিকপ্টার উড়বে না। আর আপনি যদি কাল আসতে না পারেন, বনদস্যু দলগুলোর সারেন্ডার প্রক্রিয়া ভেস্তে যাবে। আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে সশস্ত্র বনদস্যুদের তখন থানায় পুলিশের হাতে জমা দিতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, হেলিকপ্টার না উড়লে সড়ক পথে চলে আসবো। তোমরা চিন্তা করো না। ফোন রাখতেই ঢাকা থেকে ফোন করলেন RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান। তিনিও ভীষণ চিন্তার মধ্যে আছেন আবহাওয়া নিয়ে। বললাম, মন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আকাশ পরিস্কার না থাকলে উনি সড়ক পথে আসবেন। আপনারাও সেই প্রস্তুনি নিন। এরপর মেজর আদনানকে জানালাম আদ্যোপান্ত।
মুন্সিগঞ্জ থেকে শ্যামনগর হয়ে সাতক্ষীরা। তারপর চুকনগরে গিয়ে রাতের খাবারের বিরতি নিলাম। সেখানে আব্বাসের হোটেলে চুঁই ঝালের খাশির মাংস দিয়ে ভরপেট খেলাম। এর পর এক টানে মংলা। হোটেলে উঠলাম ভোর চারটার পর। ক্লান্তিতে এবার ভেঙ্গে পড়লো শরীর। কোনো রকমে গোসল করে দিলাম ঘুম। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো আজ। কারণ সবকিছু পরিকল্পনা মতো চলছে। সকাল দশটার মধ্যে আমাদের হাজির হতে হবে পশুর নদীর পাড়ে ফুয়েল জেটিতে। দুর্ধর্ষ বনদস্যু ইলিয়াস ও মজনু অস্ত্র জমা দিবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। মাস্টার বাহিনীর পর সুন্দরবনের দস্যু জগৎ থেকে বিদায় নিবে আরও দু’টি দস্যুদল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
(ছবি: RAB এর হেফাজতে দস্যু সরদার- মজনু। ১১ জুলাই ২০১৬, সুন্দরবন)