আত্মসমর্পণ করলো মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১৭৫ | Rupantorer Golpo 175 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৫ : আকাশটা মনে হয় ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে চারপাশ। সুন্দরবন থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু ঘন্টা দুই পর জেগে গেলাম। মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুম হয়? সকাল সকাল বৃষ্টি দেখে মনটা আরও খারাপ হলো। কারণ এই বৃষ্টি চললে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে কী করে? ফোন খুলে দেখলাম কোনো বার্তা আছে কী না! না! কিচ্ছু নাই। RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদকে মেসেজ দিলাম। উত্তর পেলাম না। মেজর আদনানকে মেসেজ দিতেই উত্তর পেলাম। তবে তাতে কোনো আশার আলো নাই। বৃষ্টি হলে বা আকাশে ঘন মেঘ থাকলে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার উড়বে না, এটুকু নিশ্চিত। এদিকে কথা বলারও কেউ নাই। সহকর্মীরা সবাই গভীর ঘুমে। আবার বিছানায় গেলাম।
কারা জানি দরজায় কড়া নাড়ছে। নাম ধরে ডাকছে। তখন সকাল ৯টা। দরজা খুলে দেখি মংলার দুইজন সোর্স। বললাম, অনুষ্ঠান তো সকাল এগারোটায়। এতো সকালে কেন? ওরা বললো, কীসের অনুষ্ঠান সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ঘরে এনে বসালাম। বললাম, ঘটনা তো ঘটে গেছে আবার, খবর পাননি?
এই সোর্সরা বেশ সহযোগিতা করেন আমাকে। তবে একই সাথে তারা সবারই সোর্স। সমস্যা হলো, এখানকার খবর ওখানে, ওখানকার খবর এখানে পৌঁছে দেয় তারা। গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকে না। বললাম, বৃষ্টির মধ্যে সাত সকালে কেন এসেছেন? অনুষ্ঠান স্থলে গেলেই দেখা হবে। আমরা দশটার মধ্যে ফুয়েল জেটিতে যাবো। ওখানে হবে আত্মসমর্পণ।
সারেন্ডার করবে কারা? তাদের এই প্রশ্ন শুনে ভালো লাগলো। তার মানে ভিতরের খবর এখনও করউ জানতে পারেনি। এখানকার বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হর্তা-কর্তারাও জানতে পারেননি বিষয়টি। বললাম, কাজগুলো এমন ভাবে করছি যাতে কেউ জানতে না পারে। ওরা বললো, তাই বলে আমাদেরও জানাবেন না? বললাম, আপনারা তো অন্য কারও পক্ষ্যে জানতে আসছেন, তাই না? বললাম, বসেন। তারপর সহকর্মীদের ডেকে তুললাম।
বৃষ্টি কমেছে কতোক্ষণে। সারেন্ডার অনুষ্ঠান হোক না হোক, অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে হবে। সকাল দশটার সংবাদে সরাসরি যুক্ত হবো। তখনই ব্রেক করবো সারেন্ডারের খবর। হোটেল থেকে বের হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর সবাই মিলে পৌঁছে গেলাম পশুর নদীর পাশে ফুয়েল জেটিতে। সেখানেই আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সকালের বৃষ্টির সাথে ঝড়ও হয়েছে। অনুষ্ঠান স্থলের প্যান্ডেল উড়ে গেছে। RAB সদস্যরা আবার নতুন করে সাজাচ্ছেন সবকিছু। তদারকি করছেন বরিশাল RAB-এর অ্যাডজুটেন্ট এএসপি জসীম উদ্দীন। বললেন, মন্ত্রী আসবেন কী না জানি না। তবে সদর দপ্তর থেকে আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। বললাম, যাক, সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল এগারোটায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দিলাম আবার। ফোন ধরেই বললেন, কোনো চিন্তা করবে না। হেলিকপ্টার না উড়লে সড়ক পথে আসবো। সব প্রস্তুতি রাখা আছে। সারেন্ডার হবেই। বললেন, সুন্দরবনের দস্যুতা দমনে সরকারের অবস্থান পরিস্কার। এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও পরিস্কার নির্দেশনা দিয়েছেন। বললাম, তাহলে সকাল দশটার খবরে খোলসা করে দিচ্ছি।
মন ভালো হয়ে গেলো। ফোন করে শুধু মেজর আদনান কবীরকে জানালাম বিস্তারিত। উনি জানালেন, দুপুরের আগে আকাশ পরিস্কার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি তাই হয় তবে হেলিকপ্টার উড়তে পারবে। মহাপরিচালসহ ঢাকার সবাই প্রস্তুত আছেন। যাক, খুব ভালো খবর। সহকর্মীদের জানালাম। মন মরা ভাবটা কেটে গেলো সবার। অফিসে ফোন করে জানালাম, দশটার নিউজে সরাসরি যোগ দিবো মংলা থেকে।
রাতেই মংলা, বাগেরহাট ও খুলনার সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো RAB। কিন্তু বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠান পন্ড হতে পারে ভেবে কেউ আসেননি। ফুয়েল জেটিতে সাংবাদিক বলতে শুধু আমরা। ১২ জুলাই যমুনা টেলিভিশনের সকাল দশটার সংবাদের শুরুতেই লাইভে যুক্ত হলাম। জানালাম, সুন্দরবনের আরও দু’টি বনদস্যু দল আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। দুর্ধর্ষ জলদস্যু মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী ২৫টি অস্ত্র, শতাধিক গুলি জমা দিবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে। স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ প্রচার শুরু হলো।
সাথে সাথে আগের দিন “RAB হেফাজতে বনদস্যুরা” শিরোনামে সচিত্র সংবাদটি প্রচার হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো এই খবর। একটার পর একটা ফোন আসছে। সাংবাদিক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা। আর লুকানোর কিছু নাই। সবাইকেই সবকিছু জানিয়ে দিলাম। পরের এক ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠানস্থল ভরে গেলো। এগারোটার দিকে রওনা দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হবে দুপুর ১২টায়।
ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিক ফোন দিলেন। বললেন, কী শুরু করলেন আপনি? ভাবলাম, ধন্যবাদ জানাবেন। অবাক করে দিলেন তিনি বললেন, এইসব নাটক না করলে হয় না? নিজেকে সংযত করে বললাম, আপনি আমার এই কাজ নিয়ে নিউজ করেন। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে সন্দেহ থাকলে বের করেন। অনুসন্ধানী সংবাদ করেন। উনি বললেন, দেশে অনুসন্ধান করার মতো অনেক বিষয় আছে। এসব ফালতু বিষয়ে সময় দেওয়ার সময় নাই। ফোন রেখে দিলেন। মনটা খারাপ হলেও কিছু বললাম না। নিজেকে নিজেই সান্তনা দিলাম। মনে মনে বললাম, একদিন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে।
বিবিসি বাংলা’র লন্ডন থেকে ফোন আসলো। বিস্তারিত জানালাম। সন্ধ্যায় বিবিসি রেডিওতে প্রবাহ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। বদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করবেন তাঁরা। টেলিফোনে বিবিসি বাংলায় ইন্টারভিউ দিলাম। মনে মনে ভাবছি সেই লন্ডন থেকে বিদেশি গণমাধ্যম এতো গুরুত্ব দিচ্ছে, অথচ আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো কতো উদাসীন! সুন্দরবনে দস্যুতা হলে জোরেসোরে সংবাদ করেন, অথচ সেই দস্যুরা আত্মসমর্পণ করছে, সেই খবর তাদের কাছে নিতান্তই গুরুত্বহীন। যাক, এসব নিয়ে ভেবে কাজ নাই। সহকর্মী পলিন বললেন, আমাদের কাজ চলতে থাকুক ভাই। একদিন দেখবেন সবাই বুঝবে!
বললাম, সে দেখা যাবে। আজ না হয় কাল আমাদের এই সংগ্রামের কথা মানুষ বলবে, বুঝবে। এই মুহুর্তে যারা সমালোচনা করছেন, তখন দেখবেন তাদের মুখ বন্ধ হবে। স্বীকৃতি না দিলেও সমালোচনার সাহস পাবেন না তাঁরা। আসলে স্বস্তিটা কোথায়? নামধারী দুটি বনদস্যু দল বিলুপ্ত হওয়া বন-উপকূলের মানুষদের কাছে বিরাট ব্যাপার। আজ থেকে মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর নামে কোনো চাঁদা উঠবে না। সুন্দরবনে ও বঙ্গোপসাগরে দস্যুদলের নামে নামে চাঁদা ওঠার চল আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশ সক্রিয়। দস্যুদের নামে জেলেদের কাছে থেকে টাকা তোলেন তাঁরা। এই অপকর্ম হয়তো আরও অনেক দিন চলবে। যদি সবগুলো বনদস্যু দল সারেন্ডার করে ফেলে, তবে সেই চাঁদা তোলা বন্ধ হবে।
অনুষ্ঠানস্থল ভরে গেছে মানুষে। অতিথিরা এসেছেন। সাংবাদিকরা এসে গেছেন। এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। বনদস্যুদের আনা হয়েছে। টেবিল পাতিয়ে সেখানে সাজানো দস্যুদের জমা দেওয়া হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র-গুলি। দুপুর ১২টার দিকে হেলিকপ্টার নামলো মংলায়। উনারা আসলেন। শুরু হলো আত্মসমর্পণ।
সুন্দরবনের ডাকাতদের চেহারা দেখার জন্য উন্মুখ সবাই। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। ইলিয়াস ডাকাত, মজনু ডাকাতের কথা অনেক শোনেন তাঁরা, কিন্তু চোখে দেখেনি কেউ। তাই নিজের চোখে সুন্দরবনের ডাকাতদের দেখতে আসা মানুষের সংখ্য বাড়তেই থাকলো। ভীড় ঠেকাতে হিমসিম খাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেই ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ, লাইভ চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার হচ্ছে যমুনা টেলিভিশনে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলো বনদস্যুরা। তাদের স্বাগত জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বললেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে দস্যুরা। তাই সরকারও তাদের প্রতি সয়বেদনশীল থাকবে। আইনী সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন তিনি। একই সঙ্গে অন্য দস্যুদের দস্যু ছেড়ে আসার আহ্বান জানালেন। বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ার কারণে অনুষ্ঠানটি দ্রুত শেষ করে ঢাকা ফিরবেন তাঁরা। যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে নিলেন। পিঠে হাত রেখে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিলেন তিনি। হেলিকপ্টারে রওনা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের নামে নতুন এটি অস্ত্র মামলা হলো। এরপর থানা হয়ে জেল হাজতে পাঠানো হবে তাদের। এসব আনুষ্ঠানিকতা সারতে সময় লাগছে। এর ফাঁকে মজনু ও ইলিয়াসসহ বনদস্যুদের সাথে আলাপ করলাম, বিদায় দিলাম তাদের।
অনুষ্ঠান স্থল থেকে বিদায় নিলো সবাই। আমরা সেখানে বসে সংবাদের কাজ শেষ করলাম। শরীরটা ক্লান্ত। গত দুই/তিনদিন অনেক চাপ গেছে। গত রাতেও ঘুম হয়নি। কাল থেকে পায়ের তালুতে বেশ কয়েটি কাঁটা নিয়ে হাঁটছি, দাঁড়িয়ে আছি। কষ্ট হলেও সহ্য করছি। এতো মানুষ আসলো, কতো মানুষকে বসতে দেওয়া হলো, ছিলো না আমার জন্য কোনো বসার ব্যবস্থা। এখন আর মন খারাপ করছি না। সহকর্মীদের বললাম, মন খারাপ করা যাবে না। আমরা কাজ চালিয়ে যাবো। এর শেষ দেখে ছাড়বো।
এবার ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসলেন বেলায়েত সরদার। জুতা খুলে বসলাম সেখানে। পায়ের তালু থেকে ১৭/১৮টি হেঁতাল কাঁটা বের করলেন সরদার। পায়ের তালুর ব্যাথা সহ্য করেছি। কারণ জানি, একদিন এই ব্যাথার বিনিময়ে আমরা সম্মান পাবো। আর কিছু না হোক, এই লবণ জলের মানুষেরাই আমাদের ভালোবাসবে, ভালোবাসবে সাধারণ মানুষ। ভালোবাসার চেয়ে বড় পুরস্কার হয় না। বিকালে ঢাকার পথ ধরলাম।
ছবি: ডান পাশ থেকে প্রথমে দাঁড়ানো মজনু। তার পাশেই ইলিয়াস। ১২ জুলাই ২০১৬। মংলা, বাগেরহাট।)