রূপান্তরের গল্প ১৭৬ | Rupantorer Golpo 176

তোলপাড় চলছে সুন্দরবনে, অখুশি অনেকেই | রূপান্তরের গল্প ১৭৬

তোলপাড় চলছে সুন্দরবনে, অখুশি অনেকেই | রূপান্তরের গল্প ১৭৬ | Rupantorer Golpo 176 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim

রূপান্তরের গল্প ১৭৬ : ওই সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসে এসব করে কী করে? তোমরা কী করো? তোমাদের টাকা পয়সা দেই কি এমনি এমনি? জঙ্গলের ভিতরে এতো কিছু ঘটে যায়! খবরটাও দিতে পারো না! আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা তাঁদের সোর্সদের ডেকে এসব বলেছেন। সেই ভয়ে আমার সোর্সরাও সিঁটিয়ে গেছেন। ফোন করে তাদের নাগাল পাচ্ছি না। কেউ গেছেন বরিশাল, কেউ চট্টগ্রাম! একজন ফোন বন্ধ করে ঢাকায় চলে আসছেন। সোজা আমার আমার অফিসে। বললেন, কোথায়, কী ভাবে ফেঁসে যাই বলতে পারি না ভাই। অভয় দিয়ে বললাম, আমার কথা মতো চলবেন। আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। কাছাকাছি একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। বললাম, যতোদিন নিজেকে নিরাপদ মনে না হবে, ততোদিন থাকেন। পাশাপাশি সুন্দরবনের খোঁজ রাখেন। সোর্স বললেন, ছোট ছোট দস্যুদলগুলো যোগাযোগ করছে। কথা বাড়ালাম না।

এদিকে ইলিয়াস ও মজনুর আত্মসমর্পণ নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনে। বিশেষ করে গডফাদারদের মাথায় কিছুই আসছে না। তাদের কাছে এবিষয়ে কোনো তথ্য ছিলো না। দস্যুরাও জানায়নি। বাহিনীগুলোর লিডার অথবা সদস্যদের কেউ না কেউ তাদের সোর্স হিসাবে কাজ করে। ভিতরের খবরগুলো সচরাচর তারাই দেয়। মাস্টার বাহিনীতে ছিলো তাদের দুইজন সোর্স। আগেভাগে টের পেয়েছিলাম বলে তারা কোনো অঘটন ঘটাতে পারেনি। মজনু বাহিনীর সদস্যদের সেভাবে চিনতাম না। তবে চতুর দস্যুনেতা মজনু আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন। তাই অবিশ্বস্ত কাউকে শেষ পর্যায়ে দলে রাখেননি। বিশেষ করে গডফাদারদের বিশ্বস্ত যারা ছিলো, তাদের সবাইকে আমি যাওয়ার আগেই সরিয়ে দেন। তাই সবকিছু গোপন ছিলো। জানাজানি হলে এমন এমন জায়গা থেকে ঝামেলা আসে, চিন্তাই করতে পারি না।

খুলনার এক অবৈধ অস্ত্রের কারবারীর সাথে কথা হতো তখন। ভিতরের অনেক ঘটনা জানাতো সে। কিন্তু মাঝে একটি মামলায় বেশ কিছুদিন জেলখানায় ছিলো সে। জামিনে বের হয়েই ফোন দিলো। জানালো, আমাকে নিয়ে নাকী খুলনার একটি সিন্ডিকেট বেশ আলোচনা করছে। সতর্ক থাকার অনুরোধ করলো সে। বললো, অপরাধ জগতের মানুষ হলেও আপনাকে ভালোবাসি। বললাম, ভবিষ্যতে যখন আপনাদের গায়ে হাত দিবো, তখনও থাকবে ভালোবাসা? হাসি দিয়ে ছেলেটি বললো, ততোদিন যদি বাঁচি!

খুলনার রূপসা ঘাটের একটি ঘরে আড্ডা বসে। কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্রের কারবারী, তাদের কয়েকজন সোর্স সেখানে নিয়মিত বসেন। ওই আড্ডায় কয়েকজন সাংবাদিকের আসা যাওয়া আছে, বনকর্মীদের কয়েকজনও বসেন সেখানে। নিরেট আড্ডা নয়, সুন্দরবনের মাছের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক এরাই। বনদস্যু দলগুলো কারা কোন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে তারাই নির্ধারণ করে। অবিশ্বস্ত দস্যুনেতাকে সরিয়ে দেওয়া, রদবদল, সবই ঠিক করে দেয় তারা। সুন্দরবন সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা খুব বেশি না। গত কয়েক বছর ধরে হেঁটে হেঁটে তথ্য সংগ্রহ করেছি। মানুষের সাথে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করেছি আসলে কোথায় বসে কারা নিয়ন্ত্রণ করে বনদস্যু-জলদস্যুদের।

মজনু ডাকাতের আত্মসমর্পণে খুলনাতেও সাড়া পড়েছে। নানা রকম হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছেন গডফাদাররা। কিন্তু একই সঙ্গে ইলিয়াসের সারেন্ডারের হিসাবটা নাকী মিলছে না কিছুতেই। পলাতক দস্যুনেতা রাজুও ফোন দিলো। হিসাব মিলছে না তারও। ইলিয়াস কী করে ওখান থেকে বাংলাদেশে আসলো? কী করে আমার কাছে আসলো? কী করে সারেন্ডার করে ফেললো? বললাম, আপনাদের জানালে কি ইলিয়াসকে আসতে দিতেন?

রাজুকে মনে করিয়ে দিলাম নিকট অতীতের কথা। সে চলে যাওয়ার পর তার বাহিনীতে কী কী ঘটেছিলো! শহীদুলকে ধরিয়ে দেওয়া, তারপর ইলিয়াসকে নেতৃত্বে আনার ঘটনার মধ্যে ছিলো রক্তপাতের ঘটনা। বললাম, আমি যখন ইলিয়াসের সাথে দেখা করতে গেলাম, তখনও আপনি আমাকে ফোন করে না করেছিলেন। কিছুতেই যেন আত্মসমর্পণ না করে সেজন্য কতো হুমকি-ধামকি দিলেন! রাজু বললো, ভুল করেছি ভাই। এবার আমাকে কি সারেন্ডার করিয়ে দিবেন? বললাম, যোগাযোগে থাকি আমরা। ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

সুন্দরবনের সবশেষ সফরে পায়ে অনেকগুলো কাঁটা ঢুকেছিলো। ১৭/১৮টি কাঁটা বের করেছেন বেলায়েত সরদার। কিন্তু ক্ষতগুলো রয়ে গেছে। জুতা পড়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তাই ডাক্তার দেখালাম। আরও ৩/৪টি কাঁটা থেকে গেছে পায়ের তালুতে। ডাক্তার সাহেব সেগুলো তুলে দিলেন। বললেন, এই পাগলামীর কারণ কী? বললাম, আপনি বুঝবেন না। আসলে আমার শুভাকাঙ্খীদের অনেকেই তখন পাগল বলতেন আমাকে। যারা পছন্দ করতেন না তাঁরা বলতেন, ধান্দাবাজ। মনে মনে বলি, এই ধান্দা থেকে আপনাদের ধান্দা বন্ধ হবে, শুধু সময়ের ব্যাপার।

আমার সেই সোর্স প্রতিদিন সকালে অফিসে আসেন। সারাদিন বসে থাকেন, আবার সন্ধ্যায় চলে যান হোটেলে। এভাবে চললো তিন/চারদিন। তারপর একদিন ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে অফিসে আসলেন। বললেন, স্যারদের সাথে কথা হয়েছে। উনারা বলেছেন, শুধু মাত্র তাঁদের সোর্স হিসাবে কাজ করতে হবে। আর আমার সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না একদম! সেই সোর্স বিদায় নিলেন। যেতে যেতে বললেন, সামনে আপনাকে আবার আসতে হবে ভাই। ছোট ছোট ডাকাত বাহিনীগুলো মাথা খেয়ে ফেলছে। ওরা সারেন্ডার করতে চায়। বললাম, এই কথা তারা যেন আর কাউকে না বলে। ডাঙ্গার দস্যুরা জানতে পারলে কিন্তু লিডারদের খেয়ে দিবে। খুব সাবধান!

সুন্দরবনে তখন দস্যুবাহিনী অনেকগুলো। নতুন পুরাতন মিলিয়ে ১৭/১৮টি বা তারও বেশি। ওদের নিয়ে কাজ করার আগে সারেন্ডার করা দস্যুদের দেখভালে মনোযোগ দিতে হবে। নিয়ম করে মাস্টার, মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর দস্যুদের পরিবারের খোঁজ খবর নিচ্ছি। জেলখানা ও আদালতের বারান্দায় প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে তাদের। সুন্দরবনের নামকরা জলদস্যু বলে কথা! ধাপে ধাপে খরচ! দস্যুপত্নীদের বললাম, এতো বছর জঙ্গলে থেকে অনেক মানুষদের অত্যাচার করেছে তারা, খরচ তো হবেই।

সপ্তাহ খানেক পর সফরে বের হলাম। খুলনা জেলখানায় সাবেক দস্যুদের সাথে দেখা করলাম। মাস্টার বাহিনীর অভিজ্ঞতা থেকে তাদের পরামর্শ দিলাম। বললাম, সারেন্ডার করলেও আপনাদের মামলাটি একটি নিরেট অস্ত্র মামলা। আর খুলনায় অনেক রথী মহারথীরাও জেলখানায় আছেন, তাঁদের মামলাগুলো চলছে। বড় বড় উকিল সাহেবরা সেই মামলাগুলো লড়ছেন। সেখানে আপনাদের মামলাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। চেষ্টা তদ্বির একটু জোর দিয়ে করতে হবে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করবেন না। এই জগতে তাড়া দিলে শুধু খরচ বাড়ে, কাজ কিন্তু তাড়াতাড়ি হয় না। কী বুঝলো তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। আমি যেটুকু বুঝলাম, মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর সদস্যদের জামিন পেতে দেরি হবে। বিদায় নেওয়ার আগে মজনু বললেন, এখনই জামিন নিয়ে বের হলে বিপদ হবে। খুলনার অবৈধ অস্ত্রের কারবারী আর গডফাদাররা তাকে মেরেও ফেলতে পারে। বললাম, থাকেন দুই মাস। তারপর বুঝে শুনে জেলখানা থেকে বের হবেন।

ইলিয়াসের আবার মজনুর মতো এলাকায় ফিরতে সমস্যা নাই। কিন্তু একসাথে মামলা বলে তাকেও থেকে যেতে হলো জেলখানায়। তবে বুদ্ধিমান এই বনদস্যু বাস্তবতা বোঝে। আমাকে শুধু বললো, ফাতেমা আর তার মায়ের খোঁজ খবরটা যেন নিয়মিত রাখি। বললাম, ওদের সাথে দুই তিন পর পর কথা হয়। ভালো আছে ওরা।

খুলনার ডুমুরিয়াতে ইলিয়াসের শ্বশুর বাড়ি। কন্য ও স্ত্রী থাকে সেখানেই। জেলখানা থেকে বের হয়ে মজনুর স্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর চলে গেলাম ডুমুরিয়ায়। ইলিয়াসের স্ত্র-সন্তানদের সাথে দেখা করে ফিরলাম বাগেরহাটে। রাতে থাকবো। পরদিন দেখা করবো মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ-এর সাথে। যাবো সারেন্ডার করা আরও কয়েকজন সাবেক বনদস্যুর বাড়ি বাড়ি।

সুন্দরবন থেকে নিয়মিত ফোন আসছে। বনদস্যুদের কেউ সারেন্ডার করতে চায়। কেউ এমনিতেই খোঁজ খবর নেয়। ফোন দেয় পুরনো সোর্সরা। তাদের বলি, আপাতত আর সারেন্ডার না। আসলে এই মুহুর্তে বিভ্রান্তি ছড়াতে হবে আমাকেই। আত্মসমর্পণে অখুশি যাঁরা তাঁদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সামনে আমি কী করতে যাচ্ছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top