মাস্টার হলেন মোস্ত: শুরু হলো রূপান্তর | রূপান্তরের গল্প ১৭৭ | Rupantorer Golpo 177 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৭ : ছোট্ট একটি পাকা বাড়ি। দু’টি ঘরের মধ্যে। একটিতে করা হয়েছে মুরগির খামার। হাতে বালতি নিয়ে সেই মুরগিদের খাবার দিচ্ছেন মোস্তফা শেখ। পিছনে ঝুরি হাতে মেয়েটি ডিম কুড়াচ্ছে। তার মানে রূপান্তর শুরু হয়েছে, দুর্ধর্ষ বনদস্যুদের রূপান্তর। আবার বাড়ি ফেরা হবে চিন্তাও করেননি সুন্দরবনের দস্যুনেতা মাস্টার অর্থাৎ মোস্ত। এখন আর তাঁকে মাস্টার বলে ডাকে না কেউ। বাগেরহাট শহরের এক পাশে ছোট্ট বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন। একটা মটরসাইকেল সারানোর গ্যারেজ দিয়েছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন, চলছে সংসার। জামিনে জেল থেকে বের হয়েছেন ক’দিন আগে। গ্রামে কাজের সুযোগ নাই। তাই শহরতলীতে এসে রোজগারের চেষ্টা করছেন তিনি।
গ্রামের বাড়িতে একটু জমি আছে। তবে সেগুলো অন্যের দখলে। সুন্দরবন থেকে ফিরে নিজের জমি ফেরত চাইতেই শুরু হয় ঝামেলা। ঝক্কি এড়াতে তাই গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত। দস্যুতা ছেড়ে জীবনে ফেরা হলো। কিন্তু এই জীবন টিকিয়ে রাখাটা নতুন চ্যালেঞ্জ। সবার সাথে মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে সাবেক দস্যুরা। এক বেলা খাবার খেয়ে বিদায় নিলাম। এরপর দিগরাজে দেখা হলো ফজলু’র সাথে। একটা কাপড়ের দোকান নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছেন তিনি। খুলনার দাকোপ-এ বাড়ি সাবেক বনদস্যু শাহীনের। মংলায় দেখা হলো তার সাথেও। হারুন, সুমন, সোলাইমান, সুলতান কাকারা ভালো আছেন। আরিফ মাঝে মাঝে ফোন দেয়। তবে নির্দিষ্ট কোনো ফোন নাম্বার থেকে না।
আরিফ সেই তরুন যে চল্লিশ লাখ টাকা নিয়ে রাজু’র ডেরা থেকে পালিয়েছিলো। তারপর ধরা পড়লো। সহযোগী বাচ্চুতে গুলিতে মরলো। দস্যুনেতার ভাগিনা বলে প্রাণে বেঁচেছিলো সে। তবে রাজু’র ট্রলারে বেশ কয়েকদিন বেঁধে রাখা হয় তাকে। মারপিটও কম হয়নি। ঘুমের ওষুধ কোত্থেকে পেলো? বাচ্চু’র সাথে গাটছড়া বাঁধলো কবে? টাকা নিয়ে পালানোর চিন্তা আসলো কী করে? পিছনে আর কেউ ছিলো কী না? এসব জানার চেষ্টা করে তারা। বিচর বসে। তারপর আরিফকে দল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই তরুণ পরে আবারও দস্যুতায় নামে। সারেন্ডার করে মাস্টারের সাথে। শুনেছি এখনও সরল পথে চলছে না আরিফ।
মাস্টার বাহিনীতে সবশেষ যোগ দেওয়া দস্যু আসাদুজ্জামান কোকিলের কোনো খবরই পাচ্ছি না। রামপালে বসবাস করছেন মাস্টার বাহিনীর আরেক সদস্য সোহাগ। সেখানে মাছের ঘের নিয়ে ব্যস্ত তিনি।
সারেন্ডার করা বনদস্যুদের সামাজিক পুণর্বাসন নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কারণ সুন্দরবনের ডাকাত বা বনদস্যু-জলদস্যুদের ঘৃণা করে ওদিকের মানুষ। কতো মানুষকে সুন্দরবনের ভিতরে নির্যাতন করেছে তার হিসাব নাই। চাঁদা নিয়েছে, অপহরণ করেছে, মুক্তিপণ নিয়েছে। প্রতিবেশিদেরও বাদ দেয়নি। সুন্দরবনে অত্যাচারিত হওয়ার প্রতিশোধ তো নিতেই পারে কেউ। গালি দিবে, সুযোগ পেলে মারপিটও করতে পারে। আর এসবের কারণে আবার যদি এলাকা ছাড়া হয় সাবেক দস্যুরা, তবে অনেকই বিপথে ফিরবে। আত্মসমর্পণের উদ্যোগ সফল হবে না।
মেজর আদনান কবীরের সাথে নিয়মিত কথা হতো। সারেন্ডার করা দস্যুদের নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতে তিনি। মোট কথা উদ্যোগটিকে টেকসই করতে হবে, এগিয়ে নিতে হবে। বললাম, আরও কয়েকটি দস্যুদল যোগাযোগ করছে। জানতে চাইলাম, কী করবো?
আদনান বললেন, অবশ্যই কথা বলবেন ভাই। ঊর্ধতনরা নাকী কাজ এগিয়ে নিতে বলেছেন।বললাম, তাড়াহুড়া করবো না আমি। সারেন্ডার করা দসুদের একটা পর্যায়ে না নেওয়া পর্যন্ত
নতুন কাজ হাতে নেওয়া ঠিক হবে? উনি বললেন, কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বললাম, ভেবে দেখি।
সংবাদ সংগ্রহের বাইরে এই যে মধ্যস্ততায় নেমেছি সেটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলছে সাংবাদিকদের মধ্যে। সামনে কেউ কিছু না বললেও পিছনে আলাপ হয়। সাংবাদিকতার ব্যাকরণ নিয়ে কথা হচ্ছে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আমি ঠিক কাজটি করছি কী না সেটা নিয়েও আলোচনা চলছে। আমি অবশ্য নিজের মতো করেই ভেবে নিয়েছি সব। বনদস্যুতার সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি আত্মসমর্পণে দূতিয়ালী করতে কোনো নৈতিক বাধা দেখি না। তার চেয়ে বড় কথা আমার উদ্দেশ্য পরিস্কার। উপকূলের জেলেদের জীবন নিরাপদ হবে যদি সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা যায়।
সুন্দরবনের দস্যুরা জঙ্গলটাকে ব্যবহার করতো লুকিয়ে থাকার জন্য। বনের ভিতরেও দস্যুতা করতো। তবে তাদের টার্গেট থাকতো বঙ্গোপসাগর। সাগরে নেমে তারা মাছ ধরার ট্রলারগুলো থেকে একজন করে মাঝি তুলে আনে। এক রাতে বা দিন রাত মিলিয়ে একের পর এক ট্রলারে হামলা করতো তারা। মাছ থাকলে কেড়ে নিতো। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু মাঝিকেই অপহরণ করতো। ট্রলার ভর্তি দামী মাছ থাকলে সেগুলো তুলে আনতো। এছাড়া আস্ত ট্রলারও অপহরণ করে আনতো কেউ কেউ। দস্যুদের মধ্যে যারা সাহসী ছিলো, যাদের দক্ষ লোকজন ছিলো, তারাই সাগরে বেশি দস্যুতা করতো। এরপর সবকিছু নিয়ে ঢুকে পড়তো সুন্দরবনে।
লুকিয়ে থাকার জন্য সুন্দরবন অনন্য জায়গা। গহীন বনের শত শত খালের ভিতরে কোথায় তারা লুকিয়ে থাকবে কে জানে? বনদস্যুদের ধরতে হলে তাদের চেয়েও বেশি করে সুন্দরবন চিনতে হবে, জঙ্গলে চলাচল করতে শিখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি বাড়াতে হবে, সোর্সদের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সুন্দরবন ও সাগরে অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। থাকলেও কোথায় থাকবে দস্যুরা সেটা জানতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে হবে। তারপর অসম এক বন্দুকযুদ্ধে জড়াতে হবে। সে প্রায় অসম্ভব কাজ। বনদস্যুরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর এই দুর্বলতার কথা জানতো। তাই প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ার ভয় করতো না।
২০১০ সালে রাজু বাহিনী সাগরে বড় একটি দস্যুতার ঘটনা ঘটায়। সেবার সাগর থেকে সম্ভবত ৭২জন মাঝি ও ২৬টি বড় ফিসিং ট্রলার অপহরণ করে আনে। বিরাট খবর হলো সেবার। মুক্তিপণ হিমাবে মাঝি প্রতি তিন লাখ টাকা চাইলো রাজু। প্রতিটি ট্রলারের জন্য চাইলো দশ লাখ টাকা। সেই মিয়ানমার সীমান্ত থেকে এগুলো ধরে এনেছিলো তারা। মালিক কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের।
এতোগুলো ট্রলার সুন্দরবনের কোথায় লুকানো আছে? খোঁজ শুরু হলো। বিশেষ টাস্কফোর্স কাজ শুরু করলো। কিন্তু বিশাল সুন্দরবনে কোথায় খুঁজবে? কিন্তু ওপর থেকে চাপ আসছে। উদ্ধার করতেই হবে অপহৃত মাঝি ও ট্রলারগুলো। সেবার হেলিকপ্টারে অভিযান শুরু হয়। সুন্দরবনের এমাথা ওমাথা হেলিকপ্টার উড়লো। সেই খবর পেয়ে রাজু তার বহর নিয়ে ঢুকে পড়লো নিশানখালীর এক সরু খালের আগায়। জোয়ারের সময় সেই ২৬টি ট্রলার ঢুকানো হয়। তারার কিছু গড়ান গাছের ডাল কেটে উপরে বিছিয়ে রাখে। আকাশে অসংখ্য বার হেলিকপ্টার উড়লো। কিন্তু অপহরণকারীদের টিকিটিও খুঁজে পেলেন না অভিযানকারীরা।
সুন্দরবনের বিস্তৃতি বিশাল। ৬০০০ বর্গকিলোমিটারের গভীর বন অপরাধীদের লুকিয়ে থাকার মোক্ষম জায়গা। এই সুবিধা নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে নাই। যেটুকু ছিলো সেগুলো সরকার নানা কাজে অধিগ্রহণ করেছে। জাহাইজ্জার চর, ভাসান চর, উরির চর, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালীতে আগে দুর্ধর্ষ দস্যুরা থাকতো। পরবর্তীতে সংগঠিত দস্যুদল টিকে থাকে শুধু সুন্দরবনে।
মংলায় পৌঁছে গেলাম সন্ধ্যার মধ্যে। আমার সেই সোর্সকে খবর দিলাম। এক দৌড়ে চলে আসলেন তিনি। আসার সময় হাত ভর্তি ফল কিনে আনলেন। বললাম, বিষয়টা কী? বললেন, আমি নাকী তার জীবন বাঁচিয়েছি। চা থেকে খেতে ওই সোর্স বললেন, পূর্ব সুন্দরবন থেকে শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদার আমার সাথে কথা বলতে চান। বললাম, কাল কথা বলবো। সামনে আগ্রহ দেখালাম না। তবে এই বারেক তালুকদারের সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকলাম। সোর্স বশিরকে বললাম (ছদ্মনাম) কাল সকাল সকাল চলে আসবেন আমার হোটেলে। নাস্তা করবো একসাথে।
RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে বললাম, আরও জলদস্যুদের সাথে কথা বলবো? বললেন, কেন না? অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম মংলার এখানে সেখানে। রাতের বেলা গেলাম চিলা বাজারে বেলায়েত সরদারের বাড়িতে। ওই রাতেই রাজহাঁস রান্না হলো। ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে ফিরে আসলাম মংলার পশুর হোটেলে। মন বলছিলো পরের দিন কিছু একটা হতে যাচ্ছে!
(ছবি: বিবিসি’র প্রতিবেদনের ছবি। সারেন্ডার করা জীবনে ফেরা দস্যুদের সাথে ছবিটি তুলেছিলেন বিবিসি বাংলা লন্ডনের সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ হাসান খান। পিছনে বেলায়েত সরদারও আছেন। উনি কিন্তু দস্যু ছিলেন না।)