তোলপাড় শুরু পূর্ব সুন্দরবনের দস্যু জগতে! | রূপান্তরের গল্প ১৭৮ | Rupantorer Golpo 178 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৮ : পূর্ব সুন্দরবনে মোশারফ নামের এক দস্যুনেতা আছে। তার সহযোগী ছোট সুমন। দুইজনের পার্টনারশিপের দস্যুদল “মোশাররফ বাহিনী” জঙ্গলে বেশ নাম করেছে। শুনেছি সেলা নদীর এপাশ ওপাশে ঘুরে বেড়ায় তারা। কখনও পশুর নদী পাড়ি দিয়ে যায় করমজল-জোংড়ার বাওনে। সেখানে সুন্দরবনের ভিতরে একটি বিল আছে- নাম আন্ধারিয়া।
পশুর নদীর পশ্চিমে, জোংড়া, মরাপশুর ও ঝাপসির মাঝখানে বিস্তীর্ণ জলা। সুন্দরবন নিজেই একটি বিশাল জলাভূমি, তার ভিতরে কয়েটি বিল আছে পূর্ব সুন্দরবনে। এই বিলগুলোতে প্রচুর মাছ হয়। বর্ষায় এসব বিলে পাওয়া যায় মিঠা পানির জিওল মাছ। কৈ, শিং, মাগুর মাছ ধরা পড়ে টনকে টন। কিন্তু এখানে মাছ ধরবে কারা? অভয়াশ্রম হলেও সুন্দরবনের এসব জায়গা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নাই। দস্যুরাই সেটা নির্ধারণ করে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকের ঘটনা। আমি গেছি সারেন্ডার করা মাস্টার, মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর সাবেক দস্যুদের খোঁজ খবর নিতে।
সুন্দরবনের খাল-নদীর দখলদারিত্ব নিয়ে যুদ্ধ চলে জঙ্গলে। তবে সেই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রকরা থাকেন লোকালয়ে। জঙ্গলের খাল-নদী আর বিলে জেলে পাঠান শহরের মাছ ব্যবসায়ীরা। কেউ দাদন দেন, কেউ বিনা দাদনে নিয়ন্ত্রণ করেন সুন্দরবনের মাছের ব্যবসা। পূর্ব বাদায় তখন বড় কোনো দস্যু বাহিনী ছিলো না। কিন্তু কয়েকটি সশস্ত্র ডাকাত দল ভাগাভাগি করে নিয়েছিলো এ অঞ্চল।
বনদস্যু মোশাররফের বাড়ি জয়মনিরঘোল। সহযোগী ছোট সুমনের বাড়িও সেখানে। সুযোগ বুঝে তারা রাতের অন্ধকারে পশুর নদী পারর হতো। আন্ধারিয়ার বিলে যারা মাছ ধরতো তাদের ওপর হামলা করতো। অপহরণ করে আবার ফিরে আসতো সেই রাতেই, পূর্ব বাদায়। সুন্দরবনের সেলা নদী থেকে দক্ষিণ-পূর্বের কিছু এলাকা ছিলো তাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল। যদিও নন্দবালায় একটি কোস্টগার্ডের ভাসমান পোস্ট আছে। তাদের নজর এড়িয়ে চলতো তারা। নন্দবালা ফরেস্ট অফিস, চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস, আন্ধারমানিক ফরেস্ট অফিসের নজর এড়ানো সহন না। তবে বনকর্মীরা এই দস্যুদের দেখেও না দেখার ভান করতো।
মোশাররফ বাহিনীর মতো ছোট দস্যুদলগুলো চলাফেরা করতো জেলেদের মতো, ছোট ছোট নৌকা নিয়ে। অস্ত্র লুকিয়ে রাখতো পাটাতনের নিচে। চেহারায় না চিনলে তাদের দিনে দুপুরেও ডাকাত বলে সন্দেহ করার উপায় ছিলো না। আমি যখন এদিক দিয়ে ঘোরাফেরা করি তখন মাঝে মাঝেই সন্দেহজনক নৌকা দেখতাম। লোকালয়ে চলে আসার পর জানতে পারতাম যে ওটা ছিলো ওমুক বাহিনীর নৌকা।
মংলায় আমার সোর্স বশির একজন মাছ ব্যবসায়ী। মানে সুন্দরবনের দস্যু সিন্ডিকেটের একজন সদস্য। মজনু বাহিনীর সারেন্ডারের পর বশির (ছদ্মনাম) কয়েকদিন ঢাকায় ছিলো আমার হেফাজতে। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে বার বার কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। আন্ধারিয়া, জোংড়া, ঝাপসি অঞ্চল তার দখলে ছিলো না। তবে নন্দবালা, হাড়বাড়িয়া, চরাপুঁটিয়া, চাত্রী, ঘসিয়াঙ্গাড়ি, কোকিলমনি পর্যন্ত তার জেলেরা মাছ ধরতো। মোশাররফ বাহিনীর সাথে সখ্য ছিলো। সম্পর্ক ছিলো শান্ত বাহিনী, সুমন বাহিনীর সাথেও। সুমন বাহিনী তখন পূর্ব সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বনদস্যু দল, বাড়ি মোড়েলগঞ্জে। বড় সুমন নামে পরিচিত পূর্ব সুন্দরবনে।
বৃষ্টিমুখর পরিবেশ। আছি পর্যটন করপোরেশনের পশুর হোটেলে। সাত সকালে এসেছে বশির। হোটেলে বসে পূর্ব বাদার বনদস্যু-জলদস্যুদের নিয়ে আলাপ করছি। সামনে আরও কাজ করতে গেলে বিস্তারিত জানতে হবে। দস্যুদলগুলো কারা, বাড়ি কোথায়, গডফাদার কারা-এসব নিয়ে ভালো করে না জেনে কাজে নামবো না। কাজ বলতে ওদের সারেন্ডারের কথা বলছি। সকাল দশটার পর সেই আড্ডায় স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও যোগ দিলেন। বশির চুপ করে গেলেন। বুঝলাম, সবার সামনে এসব নিয়ে কথা বলবেন না তিনি।
একটা কল আসলো বশিরের ফোনে। ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সাংবাদিকদের একজন বললেন, বশির কেন এখানে? তার বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ দিলেন, বললেন আমি যেন এদের সাথে না মিশি। খুব খারাপ মানুষ নাকী বশির। বললাম, আমার তো এখানে ভদ্রলোকদের সাথে কোনো কাজ নাই। এসময় দরজায় উঁকি দিলো বশির। ইশারা বুঝে কের হলাম। বারান্দায় যেতেই ফিসফিস করে জানালেন, দস্যুনেতা বারেক তালুকদার ফোন দিয়েছেন।
বরিশালের ভাষায় কথা বলেন বারেক তালুকদার। বললেন, অনেক দিন ধরে ডাকাতি করছেন জঙ্গলে। বাড়ি উঠতে পারছেন না ক্রসফায়ার ও মামলার ভয়ে। ছোট্ট একটি দস্যুদল নিয়ে জঙ্গলে পড়ে আছে তারা। বললাম, সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাবো। এই ফোনে বাড়তি কথা বলা যাবে না। ট্র্যাক হতে পারে। আবার ফোনগুলোতে অটো ভয়েস রেকর্ডিং চালু করা থাকে। কখন কে কোন তথ্য জেনে যায় বলা মুশকিল। বললাম, সময় সুযোগ করে ফোন দিবো। বারেক তালুকদার বললেন, ফোনে না ভাই, সামনা সামনি কথা বলতে চাই। আপনি চলে আসেন। বললাম, আমার আসতে দেরি আছে। ফোন কেটে দিলাম। নাম্বারটা নিয়ে আমার গোপন ফোন নাম্বার দিয়ে কল করলাম।
দুই/তিনবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ধরছেন না। বশিরকে বললাম, আপনার নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে আমার ফোনটা ধরতে বলেন। কাজ হলো। ফিরতি ফোন করলেন আমার নাম্বারে। বললাম, নাম্বারটা সেইভ করে রাখেন। এই নাম্বারে আমাদের মধ্যে কথা হবে। উনি বললেন, আর একদিনও সুন্দরবনে থাকতে ইচ্ছা করছে না ভাই। বললাম, এতো বছর জঙ্গলে ডাকাতি করছেন! এইটুকু সহ্য হচ্ছে না? দস্যুনেতা বললেন, এই যে কথা বলছি, পরের বার কথা বলা হবে কী না জানি না। আমার সাথে কয়দিন আগেই বিরাট একটা দুর্ঘটনা ঘটতে গেছিলো। মেরেই ফেলছিলো ওরা। বল্লাম, মৃত্যুর লাইনে গেছেন যখন, তখন তো ঝুঁকি থাকবেই। এবার অবাক করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, আজকেই আসেন আপনি। নিয়ে যান আমাদের। বল্লাম, আজকে আসার পরিস্থিতি নাই, আমাকে ঢাকা ফিরতে হবে।
ফোন রেখে বশিরকে বললাম, এই লোক কী বলে? এখন কী করে আনবো তাকে? RAB সদর দপ্তরে কথা বলতে হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলাপ করতে হবে। তারপর সময় নির্ধারণ করে নিয়ে আসতে হবে তাদের। সে বললো, গত কয়েক দিন ধরে মাথা খাচ্ছে এই দস্যুনেতা। সারেন্ডার করবে। আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলে। বললাম, আজকে না, তাকে তৈরি থাকতে বলেন। খুব বেশি হলে তার সাথে দেখা করবো এ দফায়। পূর্ব সুন্দরবনের এদিকটা ভালো চিনি আমি। ওদের কাছাকাছি থাকতে বলেন। বিকালে নেটওয়ার্কে থাকতে বলেন। ঢাকায় ফিরে আসার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু মত পাল্টালাম। বললাম, আগামী কাল সুন্দরবনে ঢুকবো।
শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদারের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিলাম। এরপর পূর্ব সুন্দরবনের অন্য দস্যুদলগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। আমি বিনা পরিকল্পনায় কারও সামনা সামনি হতে চাই না, দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মোশাররফ বাহিনী, সুমন বাহিনী এদিকটাতেই থাকে। বশির বললো, ওরা আমার কাছের লোক। সমম্যা হবে না। বললাম, কাল-পরশু ওদের দূরে সরে থাকতে বলবেন। সাগর বাহিনী নামে আরেকটা দস্যুদলের খবর পাচ্ছি। বশির বললো, ওরা পশ্চিম সুন্দরবনে থাকে। করমজল বাওন থেকে ভদ্রা পর্যন্ত চলাফেরা করে। এদিকে আসবে না।
পরদিন সেলা নদীর কোনো জায়গায় দেখা হবে আমাদের। এদিকে ফরেস্ট, পুলিশ, RAB, কোস্টগার্ডের উপস্থিতি বেশি। সোর্সরাও সক্রিয়। কিছুতেই আমার এই সফরের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। বশির বললো, কাক-পক্ষীও টের পাবে না ভাই। হোটেল কক্ষে ফিরলাম। স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে আড্ডায় বসলাম আবার। উনারা ইনিয়ে বিনিয়ে আমার পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইছেন, সঙ্গে থাকতে চাইছেন। মুখে আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তাঁদের সঙ্গে রাখবো না। স্থানীয় অনেক হিসাব থাকে। এর মধ্যে ঢোকা যাবে না।
দুপুরে গেলাম জয়মনির ঘোল। মংলার শেষ লোকালয়। সেখানে এক সময়ের ভয়ঙ্কর দস্যুনেতা জুলফিকারের বাড়ি। জুলফু বাহিনী নামে ত্রাশের রাজত্ব গড়েছিলো সে। তার অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে বন বিভাগ একটি ফরেস্ট অফিসও বন্ধ করে দেয়। মৃগামারী খালের মুখে সেই ফরেস্ট অফিসটি এখন পোড়ো বাড়ির মতো দেখতে। সেলা নদী দিয়ে চলাফেরার সময় নজরে আসে। ওই খালে প্রচুর কাউইন মাছ পাওয়া যায়। বড়শির জেলেদের আনাগোনা আছে। উনাদের সাথে একটু খাতির জমাতে পারলে জুলফু বাহিনীর রোমহর্ষক সব কাহিনী শোনা যায়। RAB-এর সাথে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় জুলফিকারের। পরবর্তীতে দলের নেতৃত্ব নেয় তার ছোট ভাই মর্তুজা। কিছুদিনের মধ্যে ক্রসফায়ারে তারও মৃত্যু হয়। তারপর বিল্লাল নামে একজন আসে নেতৃত্বে। ভয়ঙ্কর সেই বনদস্যুর দস্যু নাম ছিলো ফিরাউন বিল্লাল। বন্দুকযুদ্ধে মরতে হয় তাকেও।
জয়মনির ঘোলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। পথে পড়লো সেই জুলফিকারের বাড়ি। পাশাপাশি দু’টি কবর। ওখানে যেতেই এগিয়ে আসলেন এক বৃদ্ধা, সাথে দুইজন শিশু। উনি জুলফিকার ও মর্তুজা’র মা। কোলে জুলফু’র সন্তান। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি কেন আগে আসলা না বাবা? আমার দুইটা ছেলেই মরলো ক্রসফায়ারে। বললাম, আমি কতোবার সারেন্ডার করতে বললাম আপনার ছেলেদের! ওরা তো কথা শুনলো না!