সবার চোখে ধূলা দিয়ে নামলাম সুন্দরবনে | রূপান্তরের গল্প ১৭৯ | Rupantorer Golpo 179 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৭৯ : এবার দেখা হবে দস্যুনেতা বারেক তালুকদারের সাথে। কিন্তু কী ভাবে যাবো, তা ঠিক হয়নি। কখন যাবো, কোথায় দেখা হবে সবকিছুই ঠিক করতে হবে। বেলায়েত সরদারের ট্রলার প্রস্তুত করতে বললাম। ঘাটে রাখা ট্রলারে ছই লাগানো হচ্ছে। আমি সুন্দরবনে নামলে এই ছইটি লাগানো হয়। এদিকে চিলা বাজারের লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে, আমরা বনে নামবো। সেই খবর সেখানকার এক সোর্স এর কানেও পৌঁছেছে।
সোর্স ভদ্রলোকটি ফোন দিয়ে আমার পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করছেন। দুপুরে সশরীরে হাজির হলেন মংলায়। বললাম, সুন্দরবনের ভদ্রা এলাকায় যাবো। মাছ ধরবো, একটু ঘুরে বেড়াবো। উনি বললেন, এখন তো মরা গোন। জেলেরা জঙ্গলে নাই। মাছ পাবেন না। রীতিমতো নাছোড়বান্দা। ওই ব্যক্তির নাম মনা। ওই দিন পুরোটা সময় আমার সঙ্গ ছাড়েননি। আসলে আমি কী করতে যাচ্ছি সেটি জানার জন্য ব্যাকুল তিনি। সম্ভবত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে জানাবেন সে কথা।
এসব জটিল-কুটিল বিষয় নিয়ে আগে ভাবতাম না। কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। কারণ এর আগের বিপদগুলো পার হয়েছে কাকতালীয় ভাবে। সামনে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চাই না। আমার সোর্স বশিরকে সরিয়ে দিয়েছি। শান্ত বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রেখে আমাদের সফর পরিকল্পনা করছেন তিনি। পরের দিন নামবো আমরা। যাবো অন্য কোনো ট্রলারে। অবশ্য চিলা খালের ঘাটে বেলায়েত সরদারের ট্রলার প্রস্তুত রাখা আছে।
এবারের সফরে হুট করেই সুন্দনবনে যাবো আমরা। প্রস্তুতি ছিলো না। কিন্তু শান্ত বাহিনীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগটিও ছাড়া যাবে না। যদিও এই সফর নিয়ে কাউকে জানাইনি। মেজর আদনান কিংবা RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকেও বলিনি।
বিকালে মংলা শহরে ঢুকলাম। সন্ধ্যা পার করলাম।প্রেস ক্লাবে, সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। স্থানীয় একটি রেস্তোঁরায় খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে ফিরলাম। বন্দর শহর হলেও এটি উপশহরের চেয়েও অনুন্নত। থাকা-খাওয়ার কষ্ট হয়। প্রয়োজন মতো বাজার সদাও পাই না। ২০১৬ সালে এসেও ভরা জোয়ারে পানি ওঠে শহরে। ডুবে যায় রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি। মংলা-ঘসিয়াখালী খালের খেয়া পার হয়ে যেতে হয় শহরে। আমাদের হোটেল খালের অন্য পাশে। রাত করে ফিরলাম। বিদায় নিলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই সোর্স। বিদায়ের সময় তাঁকে বললাম, সকালে ঢাকা ফিরবো।
রাত দুইটা। ভাটা হয়েছে পশুর নদীতে। চিলা বাজার থেকে ফোন করলো মামুন, বেলায়েত সরদারের সহযোগী। বললো, চিলা সেতুর নিচে চুপ করে বসে আছেন সেই মনা। ভেবেছেন রাতের ভাটায় নামবো আমরা। উনাকে বিভ্রান্ত করতেই সরদারের ট্রলার প্রস্তুত রেখেছি। মামুনকে বললাম, ট্রলার চালিয়ে পশুর নদীতে যাও। ঘন্টা খানেক দূরে কোথাও গিয়ে থাকো।
তারপর ট্রলার নিয়ে পশুর বাওনের কোনো ছোট খালে ঢুকিয়ে রাখো, তারপর ঘুম দাও। বেলায়েত সরদারকে মটরসাইকেলে চড়ে মংলায় আমাদের হোটেলে আসতে বললাম। বললাম, আসার পথে ওই সোর্স এর চোখে পড়া যাবে না। সরদার বললেন, ট্রলার ছাড়ার পর মিনিট দশ দাঁড়িয়ে ছিলেন মনা। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছেন। যাওয়ার সময় কোনো একজন স্যারকে ফোন দিয়েছেন। আমাদের জঙ্গলে নেমে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করলেন ওপাশে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছেন মনা। এই সোর্সকে বিভ্রান্ত করতে পারলেই আপাতত চলবে।
সাত সকালে হোটেল ছাড়লাম। মংলা থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিবো। সেই খবর চারপাশে ছড়িয়ে দিলাম যাতে সবাই নিশ্চিত হয় যে আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। সঙ্গী হলেন বশির এর বেলায়েত সরদার। সহকর্মী ভিডিওগ্রাফার খায়রুল বাশার দীপু ভাই ও মংলার সাংবাদিক নিজাম ভাই ছিলেন আগে থেকে। রওনা দিয়ে দিগরাজ বাজারে বিরতি নিলাম। নাস্তা সেরে নামলাম বাজার করতে।
সুন্দরবনে যাওয়ার সময় কিছু কেনাকাটা করতে হয়। চাল-ডাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কিনতে হয়। বিশুদ্ধ পানির বোতল, চা পাতা, চিনি, গুঁড়া দুধ, মশার কয়েল, টর্চ-এর ব্যাটারি, সাবান, শ্যাম্পু, শুকনো খাবার, তেল, লবণ, মসলা কিনে গাড়িতে রাখলাম।
মংলা থেকে আমরা রওনা দিবো বিকালের ভাটায়। মাঝ ভাটা হতে বিকাল চারটার মতো বাজবে। ট্রলার ছাড়বো তখন। বশির বললেন, শান্ত বাহিনী যেখানে থাকবে সেখানে ট্রলার চালিয়ে যেতে সময় লাগবে তিন ঘন্টা। তবে জোয়ার চলে আসলে সেই হিসাব মিলবে না। বনদস্যুরাও এই ভাটার হিসাব করে বড় নদীর পাশে এসে অবস্থান নিবে। বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে মংলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বশির। পর্যটকরা যান এমন একটি ট্রলার ভাড়া করা হলো। মংলার ফেরি ঘাটে অপেক্ষা করবে সেই ট্রলারটি। জ্বালানী তেল কিনে, বাজার তুলে প্রস্তুত থাকবেন বশীর।
সব ঠিক থাকলে ওদের সাথে আমার দেখা হবে সন্ধ্যার পর পর। বাজার করে চলে গেলাম রামপাল। তারপর বাগেরহাট শহর। ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে দেখা হলো বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন ভাইয়ের সাথে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। তারপর রওনা হলাম আবার মংলার উদ্দেশ্যে।
মংলা খালের ফের ঘাটে নামলাম। গাড়ি থেকে নামতেই এগিয়ে এলেন এক নারী। বোরকা পড়া সেই নারীর সাথে বাচ্চা একটা মেয়ে। কাছে এসেই কান্না জুড়ে দিলেন দুজন মিলে। আমি একদম অপ্রস্তুত! কী হলো? কারা আপনারা? ভদ্রমহিলা নিচু স্বরে বললেন, বারেক তালুকদার তাঁর স্বামী। বললাম, আপনি এখানে আসছেন কী মনে করে? এমনিতে সব কাজ গোপনে করার চেষ্টা করছি। অথচ আপনি এসে সব গোলমাল বাধিয়ে দিলেন। নরম করে বকা দিলাম। বললাম, বাড়ি যান। বাঁকীটা আমি দেখছি।
দ্রুত ট্রলারে উঠলাম। পর্যটকবাহী ট্রলার। বেশ সুন্দর করে সাজানো। ছাদের দুই পাশে লম্বা করে কাঠের বেঞ্চ বসানো। ট্রলার ছাড়লো। দিনের বেলা বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি এই প্রথম! কেউ সন্দেহ করবে না। দিনে দুপুরে কেউ ডাকাতদের সাথে দেখা করতে যাবে ভাবতেও পারবে না কেউ। ট্রলার ছুটলো বড় নদীর দিকে। তারপর আহ্নি ঘুরালাম দক্ষিণে। ভাটার স্রোতে ছুটছি আমরা। এবার সুকানিতে দাঁড়িয়েছে বশির। বেলায়েত সরদার গেছেন রান্নাঘরে। বড় নদীতে উঠতে উঠতে ট্রলারের ভিতর থেকে অচেনা একজন বেরিয়ে আসলেন। লম্বা, শীর্ণ দেহের মানুষটি। কাছে এসে হাত মিলালেন। বললেন, দস্যুনেতা বারেক তালুকদার তার দুলাভাই।
মিনিট দশেকের মধ্যে চা নিয়ে আসলেন বেলায়েত ভাই। মাথাটা ব্যাথা করছে। আকাশেরও অবস্থা ভালো না। ভাদ্র মাসের আবহাওয়া যেমন হয়! পশ্চিম আকাশে মেঘ করেছে। দেখতে দেখতে মংলা ছাড়িয়ে গেলাম। চিলা বাজার পার হলাম। ঘাটে ভিড়ানো বেলায়েত সরদারের ট্রলার। যাচ্ছি সুন্দরবনের ভিতর। ভাবছি আমার গদিপথ যারা অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন তাঁদের বিভ্রান্ত করতে পারলাম তো?
(ছবি: চিলা খালে রাখা বেলায়েত সরদারের ট্রলার)