যাচ্ছি বনদস্যু “শান্ত” বাহানীর ডেরায় | রূপান্তরের গল্প ১৮০ | Rupantorer Golpo 180 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮০ : পশুর নদী আজ ভয়াবহ উত্তাল। পশুর নদীতে চলছে আধা ভাটি। তীব্র গতিতে স্রোত নামছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। নদীর পূর্ব পাশে চর জেগেছে জায়গায় জায়গায়। সেই চরে ধাক্কা খেয়ে বড় বড় ঢেউ ভাঙ্গছে। আমরা সেলা নদীতে যাবো। তাই পথ ধরেছি বড় নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে। জয়মনিরঘোল থেকে পূর্ব দিকে চলে গেছে সেলা। সেই নদী দৈর্ঘ্যে বিশাল। সুন্দনবনের ভিতর দিয়ে মোহনা ঠেকেছে বঙ্গোপসাগরে। ভাদ্র মাসের আবহাওয়া। এই রোদ, এই বৃষ্টি। সময় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। আকাশে গখীর মেঘ করেছে। আর দখিণা বাতাস ছেড়েছে পুরোদমে। বিপরীত বাতাস ও স্রোতের সংঘর্ষে পশুর উন্মাতাল। ঝড়ো বাতাস বুকে নিয়ে ছুটছে আমাদের ভাড়া করা ট্রলারটি।
ওদিকে সমান তালে বাজছে আমার অফিসের মোবাইল ফোন। গাড়ির ভিতরে রাখা, যাতে কেউ লোকেশন ট্র্যাক করলে আমাকে লোকালয়ে পায়।রিং বাজছে মানে অন্যরা বুঝবে আমি লোকালয়ে আছি, বনের গভীরে যাইনি। আরেকটি ফোনে আমার ব্যক্তিগত নাম্বার। বন্ধ করে ব্যাগের ভিতরে রাখা। আর চালু আছে গোপন ফোনটি। সুন্দরবনের দস্যুদের সাথে কথা বলার জন্য তখন নিত্য নতুন সাময়িক ফোন নাম্বার ব্যবহার করি। সেলা নদীর ভিতরে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত নেটওয়ার্ক পাবো। কথাবার্তা চলছে এই গোপন নাম্বার দিয়ে।
একদম নদীর তীর ধরে এগুচ্ছে ট্রলার। সুকানীতে বেলায়েত সরদার। রোলিং থাকলেও সামলে নিচ্ছেন তিনি। এদিক দিয়ে চলাফেরার নৌ-পথ ভালো চেনা তাঁর। আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম জয়মনি। এতো তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লে দস্যুদের সাথে সময় মিলবে না। তাই একটু বিরতি নিবো আমরা। ট্রলার ভিড়লো জয়মনিতে স্থাপিত খাদ্য গুদাম- মংলা সাইলো’র জেটিতে।
২০০৯ সালে শুরু হয় এই সাইলো নির্মাণের কাজ। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ৫০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য শষ্য মজুত করা যাবে আধুনিক এই সাইলোতে। পাঁচ বছর নিরাপদ থাকবে শষ্য। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরের আঘাতের পর উপকূলের দুর্গত অঞ্চলে খাবার সংকটে পড়ে। কাছাকাছি খাদ্য গুদাম ছিলো না। আর সড়ক পথ ছিলো লন্ডভন্ড। তাই উপকূলের ১৯ জেলায় আপদকালে খাদ্য সরবরাহের জন্য এই খাদ্য গুদাম তৈরি করেছে সরকার। জেটিটি নদীর অনেকটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কার্গো বা জাহাজ থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির মালামাল লোড-আনলোড করা যাবে অল্প সময়ে।
এখানে এক ঘন্টা বিরতি নিবো আমরা। সেই সময়টুকু কাটলো আড্ডা আর গল্পে। এই দফায় আমার প্রধান সোর্স বশির। বেশ দুশ্চিন্তায় তিনি। কারণ বনদস্যু শান্ত বাহিনীর কাছে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, এই খবর প্রশাসনের লোকজন পেলে তার জন্য বিপদ হয়ে যাবে। নিতান্ত কৃতজ্ঞতা থেকে তিনি আমাকে সহযোগিতা করছেন। আমিও তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। আমার কারণে কেউ বিপদে পড়ুক তা চাই না কিছুতেই। ঝাল করে মুড়ি-চানাচুর মাখানো হলো। নাস্তা সারতে সারতে বশির বললেন, ভালো করে খেয়ে নিতে হবে ভাই। আবহাওয়ার যে অবস্থা, ঝড়-বৃষ্টি বেশি সময় ধরে চললে রান্না করা মুশকিল হয়ে যাবে।
এবার নামার সময় খুব বেশি বাজার করিনি। মাছ-মাংস কিনিনি। কোনো রকমে দুই বেলার খাবার খেতে পারলেই চলবে। বশির বললেন, ওদিকে গেলে মাছ পাওয়া যাবে। বললাম, আমরা নেমেছি সেই খবর পেয়েছে কেউ? বললো, মনা ফোন দিচ্ছে চারপাশে। সক্রিয় আরও বেশ কয়েকজন সোর্স। কিন্তু সবার কাছে একটাই তথ্য- গত রাতে বেলায়েত সরদারের ট্রলারে বনে ঢুকেছি। সকালে ফিরেছি। তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি আমরা। এসময় পাশে এসে বসলেন বেলায়েত সরদার। আমাদের কথাবার্তা শুনে বললেন, এই যে আমরা নদীতে নামছি। আর কেউ খুঁজেও পাবে না আমাদের।
চা আসলো। গরম গরম দুধ চা। ওদিকে বৃষ্টি শুরু হলো টিপটিপ করে। রোদের মধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। ঝমঝম করে কিছুক্ষণ বৃষ্টি পড়ছে। আবার থেমেও যাচ্ছে। সরদার বললেন, এই বৃষ্টির নাম ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। মানে হলো, সাগর থেকে এসময় ইলিশ মাছ ঢোকে নদীতে। বৃষ্টি হলেই ইলিশের ঝাঁক উঠে আসে ওপরের দিকে। তখনই তারা আটকা পড়ে ইলিশের জালে। জেলেরা বলেন, নদী বা সাগরে একটু ঝড় বৃষ্টি না হলে নাকী জালে মাছ পড়ে না।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ট্রলার ছাড়লাম। জয়মনি পেরিয়ে সেলা নদীর মুখে পড়লাম বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে। সে এক মহাদুর্যোগ! বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ট্রলারের গায়ে। সরদার চেষ্টা করছেন ঢেউগুলো আহ্নিতে নিতে। এমর পরিস্থিতিতে ঢেই বাধাতে হয় সামনের দিকে। বড় ধাক্কা যদি পাশে লাগে তবে যেকোনো সময় ডুবর যাবে ট্রলার।
ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেলাম। আসলে পর্যটকবাহী এই নৌযানগুলো বৈরী আবহাওয়ায় চলার উপযোগী না। যাই হোক, দুশ্চিন্তা করতে করতে মোহনা পার হয়ে সেলা নদীতে ঢুকলাম। পূর্বে সুন্দরবন শুরু এখান থেকে। ডান পাশে পড়লো নন্দবালা ফরেস্ট অফিস। তার পাশেই নন্দবালা খাল। বাম পাশে জয়মনির ঠোঁটা। নদীর মোহনায় বাড়তি স্থলভাগজুড়ে অনেকগগুলো কুঁড়েঘর। শেষ ভাটায় পুরো নদীর পাড় জুড়ে মানুষ নেমেছে নেটজাল নিয়ে। টানা দিয়ে দিয়ে তারা চিংড়ির পোণা ধরছে।
বৃষ্টি বাড়লো। তবে সেলা নদীতে ঢোকার পর বাতাস হারিয়ে গেলো। বৃষ্টির কারণে নন্দবালা থেকে কেউ ডাক দেয়নি। তবে সামনে এগুতেই চাঁদপাই ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের জেটি থেকে আমাদের ডাক দিলেন বনরক্ষীরা। কী করবো এখন? বশির বললো, সেলা নদীতে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। সামনে অভায়শ্রম শুরু। ওদিকে প্রবেশই নিষেধ। এরকম সময়ে বন বিভাগের এই ডাকাডাকি দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়। ভাবলাম আগের মতো করে পালাবো? কিন্তু ওদের জেটিতে স্পিডবোট বাঁধা। ওটা নিয়ে ধাওয়া করলে আমাদের ধরতে তাদের সময় লাগবে কযেক মিনিট।
ছাতা মাথায় নিয়ে সামনের দিয়ে এগিয়ে গেলো বশির। দূর থেকে হাত নাড়িয়ে কিছু একটা ইশারা করলো সে। হাত নাড়িয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পাল্টা ইশারা দিলেন তাঁরা। অবশ্য বৃষ্টির কারণেও একটু ছাড় পেলাম। এই আবহাওয়ায় নদীতে নেমে ঝামেলা বাড়াতে চায় না কেউ। একই কারণে নন্দবালার কোস্টগার্ডও আমাদের খেয়াল করেনি।
সুন্দরবনের এদিকটা অন্য রকম। সেলা নদী ধরে এগুচ্ছি। বৃষ্টি কমলো। প্রথম জোয়ারে স্রোত গেলো ঘুরে। এবার নদীর ডান পাশের জঙ্গল ধরে এগুতে থাকলাম আমরা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সহযাত্রীদের ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম। সুকানীতে থাকলেন বেলায়েত সরদার। টর্চ আর ছাতা নিয়ে বশির আর আমি গিয়ে দাঁড়ালাম গলুই-য়ে। বাম পাশে মৃগামারী খালটি রেখে এগিয়ে চলছি। সামনে আরেকটি বড় খাল পড়বে। আন্ধারমানিক খালটি চলে গেছে বাম দিকে। তার কিপরীতে খালটির নামে আছে একটি ফরেস্ট অফিস। বশির বললো, ওই অফিসের আগেই দেখা হবে শান্ত বাহিনীর সাথে। টর্চ জ্বালিয়ে ওরা ইশারা দিবে। বশির দিবেন পাল্টা ইশারা। তারপর আমরা ঢুকে পড়বো বনদস্যুদের ডেরায়।
গত আধা ঘন্টা ধরে গলুই-এ দাঁড়িয়ে আছি। চোখ কান খোলা। শুধু কথা বন্ধ। মনে মনে ভাবছি, দিনে দুপুরে মংলা থেকে রওনা দিয়েছি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছি সুন্দরবনে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা হবে বনদস্যুদের সাথে। আবারও শুরু হবে দস্যুদের আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায়। চলছি আমরা সেলা নদী ধরে দক্ষিণ দিকে।