সেলা নদীতেই দেখা হলো শান্ত বাহিনীর সাথে | রূপান্তরের গল্প ১৮১ | Rupantorer Golpo 181 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮১ : টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। উজান ঠেলে জঙ্গল ঘেঁষে আগাতে কষ্ট হচ্ছে বলে ট্রলার একটু দূর দিয়ে চলছে। হঠাৎ বৃষ্টি বেড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে ছাতা খুঁজতে গেলো বশির। অবশ্য ততোক্ষণে ভিজে গেছি। বৃষ্টিও কমে আসলো দুই তিন মিনিটের মধ্যে।
বশির উসখুস করছে। বলছে, এতোক্ষণে তো তাদের সিগন্যাল পাওয়ার কথা! আর দশ মিনিট গেলেই আন্ধারমানিক ফরেস্ট অফিস। বললাম, নদীর উল্টোপাশে থাকবে না তো ওরা? বললো, ওদিকে তো জঙ্গল খুব পাতলা। আর লোকালয়ও কাছে। ডাকাতেরা ওই পাশে যায় না। উৎকণ্ঠা বাড়ছে আমারও। তাহলে কি কোনো সমস্যা হলো? কোনো কারণে পরিকল্পনা বদলে ফেলেনি তো? ভিতর থেকে দস্যুনেতার শ্যালক স্বপন বের হয়ে আসলেন। তিনিও দেখি উসখুস করছেন।
অন্ধকার নদী ধরে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। ডান পাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছি তিন জন। হঠাৎ ট্রলারের গতি কমে আসলো। পিছন থেকে চিৎকার করে কিছু বলছেন ট্র্ররারের ক্যাপ্টেন বেলায়েত সরদার। সুকানিটি আরেক জনের হাতে দিয়ে বেরিয়ে আসলেন। বললেন, পিছনে গুলি হলো দুইটা। আওয়াজ পাননি? আমরা তো হতভম্ব। বললাম, কতোক্ষণ আগে? বললেন, এই তো মিনিট দুই হলো!
বশির বললো, তাহলে বোধ হয় ওদের পার করে আসছি। মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগে যখন বৃষ্টি আসলো তখনই মনে হয় তাদের অতিক্রম করে ফেলছি। বশির বললো, সিগন্যাল খেয়াল না করে আমরা এগিয়ে এসেছি। সরদারকে বললাম, ট্রলার ঘুরান। দৌড়ে পিছনে গিয়ে সুকানি ধরলেন তিনি। জায়গায় ঘুরিয়ে ফেললেন ট্রলার। আমরা এবার যাচ্ছি উল্টো দিকে, হাতের বাম পাশে জঙ্গল রেখে। এবার জোয়ার ধরে ছুটছে ট্রলার।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি ডিঙ্গি নৌকা নজরে আসলো। বশির তার হাতের লাইটারের ছোট লাইটটি তিনবার জ্বলানেভা করলেন। ওপাশ থেকেই একই সিগন্যাল এলো। তারপর বৈঠা বেয়ে এগিয়ে আসলো নৌকাটি। কাছে এসেই বশিরকে বকাঝকা শুরু করলো তারা। বললো, এতোবার সিগন্যাল দিলাম, খেয়াল করবা না? বলতে বলতে নৌকা ভিড়লো ট্রলারের সাথে। হাতে একটি দোনলা বন্দুক নিয়ে উঠে আসলো একজন। নাম আর চেহারা আলাদা। বেশভূষায় সুন্দরবনের দস্যু। পরনে গেঞ্জি-শর্টস, কোমড়ে গুলির পোসেস, মাথায় বাবড়ি চুল আর চোখে আগুন!
আমি গলুই-এ দাঁড়িয়ে দেখছি। বশির আর স্বপনকে বকাঝকা করতে করতে আমাকে খুঁজছেন ভান্ডারী। ভাই কই? বলতে বলতে আমার দিকে তাকালেন। এই অন্ধকারে কিছুই পরিস্কার দেখা যায় না। শুধু অবয়বটা বোঝা যায়। বন্দুক ঘাড়ে ঝুলিয়ে এগিয়ে আসলেন ভান্ডারী। জড়িয়ে ধরে বললেন, যাক দেখা হয়ে গেছে। এইবার আমাদের বাড়িও ফেরা হবে। বলতে বলতে কাঁপতে থাকলেন। কান্নাকাটি করে অস্থির অবস্থা। বললাম, এতো ডাকসাইটে জলদস্যু আপনারা। এভাবে কান্নাকাটি করলে ইজ্জত থাকবে না। সবাই মিলে হাসাহাসি চললো মিনিট দুই। বললাম আমরা কি এই সেলা নদীর মাঝখানে থাকবো? ভান্ডারী বললেন, জোয়ারে যেভাবে ভেসে যাচ্ছি সেভাবেই যাবো। ইঞ্জিন আর চালু করা লাগবে না।
কিছু দূর এগিয়ে ছোট্ট একটি খালের মুখে থামলাম। জোলা খাল। খালের গোঁড়ায় ঘন জঙ্গল। বড় লকটা কেওড়া গাছও ভেয্গে পড়ে আছে সেখানে। খুব ভালো করে খেয়াল না করলে বুঝার উপায় নাই। অর্ধেক জোয়ার না হলে ট্রলার নিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারবো না। আর আস্ত ট্রলার বড় রদীতে রেখে দস্যুদের কাছে যেতেও রাজি না। ভান্ডারীকে বললাম, ডিঙ্গি নিয়ে ভিতরে যান। সবাইকে একটু ভিতরে থাকতে বলবেন। জোয়ার বাড়লে তারপর এসে আমাদের নিয়ে যাবেন।
সুন্দরবনে এর আগে কোনো বনদস্যু দলের সাথে এতো সহজে দেখা করা হয়নি। আবার যেভাবে আলোর ইশারা মিস করে ফেলেছিলাম, এমনটাও ঘটেনি। একটুর জন্য পন্ড হতে বসেছিলো সব। আসলে জঙ্গলের ভিতর থেকে বা ডিঙ্গি নৌকা থেকে ছোট্ট এলইডি’র আলোর ইশারা করে দস্যুরা। এদিকের বনদস্যুদলগুলো ছোট ছোট। নিজেরাই আতঙ্কে থাকে। বড় দলগুলোও দেখা করতো রাতের বেলায়। সিগন্যাল দিতো বড় টর্চ জ্বালিয়ে।
ভান্ডারীসহ আরেক দস্যু ঢুকে পড়লো খালে। মিলিয়ে গেলো এক মিনিটোর মধ্যে। পূর্ব সুন্দরবন অন্যরকম। এদিকের গাছগুলো বেশ বড় বড়। ঝোপগুলোও গভীর, জমাট বাঁধা। সুন্দরী গাছের অভাব নাই। রাতে খাবো কী? বশিরকে বললাম, ওরা কি রান্নাবান্না করবে? বশির বললো, বাজার-সদা করার তো সময় পাইনি আমরা। কালকে থাকলে শিকার করবে ওরা। বললাম, খবরদার! হরিণ শিকারের প্রয়োজন নাই। এমনিতে সাথে মাছ থাকলে খাবো একবেলা।
এদিকে বেলায়েত সরদার দেখি উসখুস করছেন। এতেক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে এই শান্ত বাহিনীর প্রধানের নাম বারেক তালুকদার। বললাম, তাতে কী? সরদার বললেন, ও ভাই, এই ডাকাতে আমার কাছে তুন হাজার টাকা পায়! বললাম, বনদস্যুরা পায় না আপনি পান? বললেন, ওরা পায় আমার কাছে। মজা করে বললাম, এবার টাকা শোধ করে যাবেন। আর গল্পটা দস্যুনেতার সামনেই শুনবো!
এবার খুললো রান্নাঘর। সরদার বলে, সবকিছু ঘুটেমুটে একটা কিছু রাঁধবেন। মানে খিচুরি জাতীয় কিছু একটা হবে। রান্না হলো বড় হাঁড়িতে। এর মধ্যে জোয়ারের পানি বেড়েছে। কখন যে নৌকা নিয়ে ভান্ডারি পাশে ভিড়েছে, খেয়াল করিনি। রাত তখন ৯টা থেকে ১০টা হবে। বশির বললো, ভিতরে ঢোকা যাচ্ছে এখন। সঙ্গে সঙ্গে নোঙ্গর তুললাম।
ছোট্ট এই খালে কখনও ট্রলার ঢুকেছে বলে মনে হয় না। ভীষন সরু। দুই পাশের গাছ নেমে এসেছে খালের ভিতর। এমন খালে ঢুকতে ভীষণ ভয় লাগে আমার। এই গাছগুলোতে সবুজ রঙ এর সাপ দেখেছি প্রচুর। আর সাপ আমি ভীষণ ভয় পাই। টর্চ জ্বালিয়ে দুই পাশে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। ট্রলারে সাপ উঠে বসলে বিপদ আছে।
মিনিট পাঁচ এভাবে চললাম। তারপর খালটি বেশ বড়। মোটামুটি একটি পুকুরের মতো এখানটা এক পাশে তিন/চারটি নৌকা রাখা। সেখানে বন্দুকে হাত রেখে সতর্ক অবস্থানে দস্যুরা। নৌকাগুলোর পাশেই বাঁধা হলো আমাদের ট্রলার। এটাই দস্যু বাহিনী, পূর্ব সুন্দরবনের ডাকাত দল- শান্ত বাহিনীর ডেরা। আজ রাত এখানেই থাকবো আমরা। সকালে কাজ করবো। তারপর সুবিধাজনক সময়ে ফিরতি পথ ধরবো। কিছুক্ষণের মধ্যে দস্যু সরদার বারেক তালুকদার উঠলেন ট্রলারে। হাত মিলিয়ে বললাম, এই চেহারা নিয়ে ডাকাতি করেন কী করে? লোকজন ভয়টায় পায়?
(বৃষ্টির মধ্যে বড় নদী ধরে এগিয়ে চলা। সেলা নদী। সুন্দরবন ২০১৬)