দস্যুদের একজনকে সন্দেহ হচ্ছে! | রূপান্তরের গল্প ১৮৫ | Rupantorer Golpo 185 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৫ : বিপদ কী কেটে গেছে? পাশে দাঁড়ানো জলদস্যু মনির বললেন, তাই তো মনে হয়। এই জঙ্গলের দস্যু জীবনে কতো কিছু ঘটে যায়! এটা আর এমন কী? বিপদ আসে, বিপদ চলেও যায়। কপাল খারাপ হলে আমরা ধরা পড়ি, কেউ মরেও যায়। কোস্টগার্ড বা প্রশাসন আসলে খুব বেশি হলে খালের ভিতরে ঢুকবে। গোলাগুলি করবে ঢোকার সময় থেকে। ততোক্ষণ আমরা থাকতাম এখানে?
ওরা ঢুকতে ঢুকতে আপনাদের নৌকা চলে যাবে গুলির রেঞ্জ এর বাইরে। এছাড়া এই ঘন জঙ্গলে সুন্দরী গাছ বেশি। ঘন বনের ভিতর দিয়ে গুলি বেশি দূর যায় না। অন্যদিকে প্রশাসন তো শব্দ ছাড়া আসতে পারে না। আজকে যেমন ওদের স্পিডবোটের শব্দ অনেক আগেই পাইছি। কাছে আসতে আসতে আপনারা অনেক দূরে চলে যেতেতে পারতেন। আর আমাদের তো নিশানাও খুঁজে পেতো না। বড়জোর খালের ভিতরে ঢুকে ট্রলারটা নিয়ে যেতো!
যাক, ওরা চলে গেছে। বিপদ কেটেছে আপাতত। ভাটার টান শুরু হয়েছে অনেক আগে। আপাতত ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই। সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। তবে আমার মনের ভিতরটাতে টান দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আবারও আসবে তারা। আর এবার আসলে সদলবলে আসবে। সোর্সকে সাথে করে নিয়ে আসবে। আসলে সেলা নদীর এদিকটা খুব ভালো চিনি না। তাই দুশ্চিস্তাটা বেশিই হচ্ছে। আর যে খালের ভিতরে আছি, এদিক দিয়ে ট্রলার নিয়ে শুধু বড় নদীতেই বের হতে পারবো। বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো অন্য বিষয়ে। এখান থেকে কেউ প্রশাসনকে আমাদের খবরটা দেয়নি তো? মনের কথা মনেই রাখলাম। দস্যুদের মধ্যে একজনকে সন্দেহ হচ্ছে আমার!
এই জায়গাটি গহীন সুন্দরবন। খালটি খুব ছোট, দুর্গম। ভিতর দিয়ে অন্য কোনো খাল বা নদীতে যেতে পারবো না। নদীতে যেতে হলে আধা জোয়ারের পর বা আধা ভাটির আগে বের হতে হবে।খালের গোঁড়ায় ডিউটি বাড়াতে বললাম। জায়গাটি নিরাপদ না হলেও আপাতত খাল পরিবর্তনের সুযোগ নাই। দিনের আলোয় বড় নদীতে বের হওয়া যাবে না।
দস্যুদের কে কেমন বুঝার চেষ্টা করি চোখের দিকে তাকিয়ে। খুব কঠিন কাজ। ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু উপায়ও তো নাই। সবার চোখই হিংশ্র। একই রকম দেখতে। তার মধ্যে থেকে অন্তত একজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি চোখ দেখে। ওদেরকে মাপার আর কোনো ব্যবস্থা নাই। বনদস্যুরা প্রত্যকেই অপরাধী, হিংস্র, অবৈধ অস্ত্রধারী। তারপরও দুই/একজন থাকে যাদের চিহ্নিত করে ফেলি শুরুতেই। আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত ওই দলটির ভিতরের খবর ওরাই আমাকে দেয়। দলনেতার মনোভাব অন্যরকম বা নেতিবাচক হলে বা দলের অন্য কেউ সমস্যা সৃষ্টি করলে জানায়। মোটকথা দেখা হওয়ার পর থেকে আত্মসমর্পণ পর্যন্ত আমাকে তথ্য দেয়, সহযোগিতা করে।
শান্ত বাহিনীর বনদস্যু মনিরকে পছন্দ হয়েছে প্রথম দেখাতেই। বেশি কথা বলেন না। কিন্তু পাশে পাশে আছেন, অল্প কথার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয়েছেন বাড়ি ফেরার আকুলতার কথা। শুরুতেই তাই এই বনদস্যুকে বেছে নিয়েছি। বয়স আমার কাছাকাছি। কথা কম বললেও তার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছি। গত রাত থেকে সব সময় পাশে পাশে থেকেছেন। হাতের দোনলা বন্দুকটিতে গুলি ভরা। শক্ত হাতে ধরে রাখা বন্দুকটির ওজন বইতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর।
এদিকে কোস্টগার্ডের স্পিডবোট চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বেলায়েত সরদারের নাকী ভালো ঘুম হয়নি রাতে। ট্রলারের ছাদে গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। বললাম, সকালের নাস্তা কি আজ হবে না? উঠে বসে লম্বা একটা হাসি দিলেন। বললেন, আপনি খুব খারাপ! একটু ঘুমাতেও দিবেন না। আমিও হাসতে হাসতে বললাম, আপনি ঘুমান। ওরা কেউ রান্না করবে। আর কি ঘুমানো যায়? বলেই উঠে পড়ে পুরো এলাকা গরম করে ফেললেন সরদার। মনির বললেন, তাদের কাছে কাউইন মাছ আছে।
সাথে সাথে একজন এগিয়ে গেলো। দস্যুনেতার নৌকায় বসে দড়ি ধরে টান দিলো। একটি দড়িতে তিনটি বড় বড় কাউইন মাগুর বাঁধা। পানিতে জিঁইয়ে রাখা। মাছগুলো তুলে কাটা-বাছার তোড়জোড় শুরু হলো। মসলা বাটতে বসলো একজন। কড়া এক কাপ রঙ চা হাতে সেই কাজ কারবার তদারকিতে নেমে পড়লেন আমাদের ক্যাপ্টেন কাম বাবুর্চি বেলায়েত সরদার।
আরেকটি নৌকা নিয়ে জুয়েল কোথায় যেন যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো, শিকারে যাচ্ছি ভাই। দুপুরে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াতে হবে না? দস্যুনেতা বারেক ভাইকে বললাম, শিকার করতে হবে না ভাই। সাথে যা আছে তাই খাবো। বললেন, হঠাৎ করেই নিয়ে আসলাম আপনাদের। সময়ের অভাবে বাজারও করাতে পারিনি। সুন্দরবনে আমাদের মেহমান হয়ে আসছেন। একটা হরিণ তো খাওয়াই। তা না হলে মেহমানদের অসম্মান করা হয় না? বললাম, হরিণ খাবো না ভাই। জুয়েলকে বললাম, নৌকা ভিড়াও। শিকারে যেতে হবে না।
সকালের রান্না শুরু হয়েছে। অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। কুকু পাখি ডাকছে একের পর এক। আরেকটি পর খালের মুখে চর জেগে যাবে। কেউ আসলেও ভিতরে ঢুকতে পারবে না। মনির বললেন, আগামী ৬/৭ ঘন্টা আর কোনো বিপদ নাই। তবুও দুইজনকে পাহাড়ায় রাখেন। আমাদের অবস্থান জানাজানি হয়ে থাকলে কেউ না কেউ আসার চেষ্টা করবেই। বারেক তালুকদারকে বললাম, এই সময়ের মধ্যে আমাদের কাজগুলো সেরে ফেলি, আপনারা তৈরি হন।
দীপু ভাই ক্যামেরা বের করলেন। সবকিছু ঠিক ঠাক করতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। জঙ্গলে আসলে ক্যামেরটা যে আগেই বের করতে রাখতে হয় উনার জানা ছিলো না। লেন্স ঘোলা হয়ে আছে। বললাম, ট্রলারের ছাদে রেখে দেন ঘন্টা খানেকের জন্য, ঠিক হয়ে যাবে। বর্ষাকালে সুন্দরবনের বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকে। এছাড়া কামেরাসহ অন্য যন্ত্রপাতিগুলো চালানোর আগে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
একটি মলিন ও ছেঁড়া কাগজ নিয়ে সামনে রাখলেন দস্যুনেতা। বললেন, এই কাগজে আমাদের সারেন্ডারের আবেদনটা লিখে দেন। বললাম, আপনাদের মধ্যে কেউ লিখলে ভালো হতো। বললেন, লিখতে জানলে আমরা কি ডাকাতি করতে আসি? বুঝতে পারছি। ব্যাগ থেকে কলম বের করে নিজেই লিখলাম। তাতে স্বাক্ষর করলেন দস্যুনেতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বনদস্যু শান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণের লিখিত আবেদনটি বুঝে নিলাম।
অস্ত্র-শস্ত্র গুছিয়ে নৌকায় বসে ইন্টারভিউ দিলেন বারেক তালুকদার। তারপর অন্য সদস্যদের নিয়ে কাজগুলো সেরে ফেললাম। এখানে নৌকা থেকে নামার উপায় নাই। তাই নৌকায় নৌকায় কাজগুলো সব সেরে। ক্যামেরায় সারেন্ডারের আগ্রহের কথা জানালো বনদস্যুরা। এতোদিনে বুঝে গেছি, সুন্দরবনের কোনো দস্যু বাহিনী যখন ক্যামেরার সামনে বসে, তখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে। শান্ত বাহিনীর সকলেই চেহারা দেখিয়ে সাক্ষাৎকার দিলো। দোনলা বন্দুক হাতে শুধু একজন থাকলো ক্যামেরার আড়ালে।
(ছবি: দস্যুনেতা শান্ত, সেলা নদী, সুন্দরবন | ২০১৬)