রূপান্তরের গল্প ১৮৭ | Rupantorer Golpo 187

ধোঁয়াশা কাটলো : সাহেবদের লোক জুয়েল | রূপান্তরের গল্প ১৮৭

ধোঁয়াশা কাটলো : সাহেবদের লোক জুয়েল | রূপান্তরের গল্প ১৮৭ | Rupantorer Golpo 187 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৮৭ : নৌকায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বৈঠা বেয়ে ট্রলারের দিকে গেলাম। নৌকা ভিড়লো। ওদিকে ট্রলারে দাঁড়িয়ে আমার ছবি তুলছেন সহকর্মীরা। বনদস্যুদের ডেরায় বন্দুক নিয়ে নৌকায় শুয়ে ঘুমাচ্ছি, ছবি হিসাবে বিষয়টি দারুণ! সবাই মজা করছেন। ঘুম ভাঙ্গলো তাদের সোরগোলে। উঠেই সরদারকে খুঁজলাম। চিৎকার করে বললাম, ও ভাই ঘুম তো আসবেই, চা খাওয়াচ্ছেন না কেন?

এখন সার ভাটি। মানে ভাটা শেষ হয়েছে। পানি নেমে গেছে একদম তলানিতে। এমন সময় বাইরে থেকে কারও আসার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। খালের মুখগুলোতে চর জেগেছে। কেউ চাইলেই স্পিডবোট, ট্রলার কিংবা নৌকা নিয়ে ঢুকতে পারবে না। তাই বনদস্যুরা বেশ গা ছাড়া অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারও হাতে অস্ত্র আছে, কেউ খালি হাতে এই নৌকা ওই নৌকা করে বেড়াচ্ছে। মনিরকে বললাম, আমার বন্দুকটা রাখেন। এই সুন্দরবনে অবৈধ বন্দুকগুলো দেখলে কষ্ট লাগে। মনে হয় একটি সংরক্ষিত বনে কয়েকশ’ অপরাধী অবৈধ বন্দুক ও কয়েক হাজার গুলি নিয়ে অবস্থান করবে, ঘুরে বেড়াবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

জুয়েলকে দেখছি না। সে কোথায়? মনির বললেন, খালের মুখে ডিউটিতে আছে। সাথে আরেকজন আছে। বললাম, খেয়াল রাখবেন ওদিকে। তারপর ফিসফিস করে বারেক তালুকদারকে বললাম, জুয়েলের বিষয়টা পরিস্কার করেন।

জুয়েলের বয়স হবে ২৭/২৮ বছর। শরীরের গঠন বেশ মজবুত। কৈশোর পেরুতেই দস্যুতা শুরু। তাই বন্দুক চালাতে বেশ পারদর্শী। জানতে চাইলাম, আপনারা সারেন্ডার করবেন যখন তখন আর বাইরের লোকজনের কী দরকার ছিলো? বললেন, শহরের সেই মাছ ব্যবসায়ী কাম সোর্স জুয়েলকে পাঠিয়েছে। অস্ত্র সাথে করে নিয়ে আসবে, তাই না করিনি। এছাড়া ওই মাছ ব্যবসায়ী বললো, জুয়েলও সারেন্ডার করবে। বললাম, জুয়েলের চোখে আমি অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি। ওর বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।

নদীর ওদিক থেকে নৌকা বেয়ে আসছে ওরা। ভোর থেকে ডিউটি ছিলো। এবার তাদের বদলে অন্য দুইজন যাবে। টানা চার ঘন্টা পাহাড়া দিবে। এদিকে রান্না হয়ে গেছে। সকালের নাস্তায় থাকবে ভাত আর কাউইন মাছের ভুনা। খালে জিঁইয়ে রাখা ছিলো মাছগুলো। সকালের নাস্তা হতে হতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। জঙ্গলের এই জীবনে খাওয়া দাওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। যে দৌড় চলে সারাক্ষণ, তাতে দুই বেলা ভাত খেতে পারলে আর কিছু লাগে না। ট্রলারের ছাদে সবাই মিলে বসে পড়লাম। খাবার বন্টনের দায়িত্ব বেলায়েত সরদারের। চামচটা হাতে নিয়ে বললেন, এবার শুরু হবে চামচের বাড়ি!

কুকু পাখি ডাকছে। তার মানে জোয়ার শুরু হলো। টিপটিপ বৃষ্টি ছিলো আগে থেকে। কিছুক্ষণ হলো বাতাস থেমেছে। গুমোট পরিবেশ। ওরা বললো বৃষ্টি বাড়বে, নিচে বসেন। বললাম, খেয়ে নামি? এবার মনির বললেন, সময় পাবেন না। বলতে বলতে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নামলো ঝুম বৃষ্টি। দৌড়ে নিচে নামলাম। ট্রলারের ভিতরেই খাবার দেওয়া হলো। বারেক ভাই বলছেন, বৃষ্টি থেমে যাবে। বেশিক্ষণ থাকবে না। এটা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।

খাওয়া শেষ হলো। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ভিতরেই ছিলাম। সরদার বললেন, পরের বেলার খাবার খাবেন কী দিয়ে? মাছ তো নাই। বললাম, চাল-ডাল মিলিয়ে খিচুরি করে ফেলেন। আর পরের বেলার খাওয়ার তো দেরি আছে। ততোক্ষণে দেখবেন ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। নৌকায় হাত বড়শি আছে না? মনির বললেন, আছে ভাই। মাছ ধরবেন? বললাম, চেষ্টা করি একটু। বললেন এই জোলায় মাছ পাবেন বলে মনে হয় না। তারপরও চেষ্টা করতে পারেন। এদিকে নাকী কাউইন মাগুর মাছ পাওয়া যায়। জুয়েল উঠে গেলো। বড়শি আর কয়টা চিংড়ি মাছ আনলো নৌকা থেকে।

একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে খালের মাঝখানে গেলাম। সঙ্গে জুয়েল। অস্ত্রধারী এই যুবক কিছু একটা বলতে চায়। বড়শিতে আধার গেঁথে দিলো ছুঁড়ে ফেললো। সূতা ধরিয়ে দিলো আমার হাতে। বললাম, তুমি কী সারেন্ডার করবে? হঠাৎ এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। হুট করে বলে বসলো, বড় ভাইরা না বললে সারেন্ডার করবো কী করে? আমি চমকালাম না। এমন ভাব করলাম যে তার বড় ভাইদের চিনি আমি।

জুয়েলের সেই বড় ভাইদের আসলে চিনি না আমি। তবে ধারণা করছি, খুলনার কোনো অবৈধ অস্ত্রের কারবারী অথবা কোনো মাছ ব্যবসায়ী। বললাম, গালকাটা মাসুদকে চিনো? বললো, ওই যে ক্রসে মরলো যে মাসুদ? চিনবো না কেন ভাই? বলতে বলতে তার সেই বড় ভাইদের নামধাম বলে ফেললো। বুঝলাম, সেই পুরনো চক্রের লোক সে। ওরা সারেন্ডার চায় না। মাঝের সোর্সরা তাদের হয়ে কাজ করে। আর জুয়েলরা জঙ্গলে নেমে সেই গডফাদারদের নির্দেশে কাজ করে। কখনও দস্যু দল ভেঙ্গে দেয়, কখনও নির্দিষ্ট কাউকে সরিয়ে দেয়, মেরে ফেলে অথবা ধরিয়ে দেয়। এই মুহুর্তে জুয়েলের কাজটা কী বুঝতে চাইছিলাম।

জানলাম, বেশ কয়েক মাস সে পলাতক ছিলো। লোক পাঠিয়ে তাকে আনানো হয়েছে। জুয়েল বললো, আপনি যে এখানে আসছেন তারা জানে না। জানলে আমাকে বলতো। গতকাল বিকালেও কথা হয়েছে ফোনে। জিজ্ঞেস করলাম, কী চায় তোমার কড় ভাইরা? জুয়েলের মুখে উত্তর নাই। বললাম, আর কতোদিন বড় ভাইদের কাজ করে দিবে? ওরা কি তোমাকে টাকা পয়সা দেয়? সে বললো, উল্টা পারলে কিছু নেয় তারা।

নিচু স্বরে জুয়েল বললো, সারেন্ডার করবো ভাই। কিন্তু কী ভাবে করবো বুঝতে পারছি না। ডাঙ্গায় গেলে তো টিকতে দিবে না ওরা। বললাম, তোমাদের দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে তোমাদের খোঁজ খবর নেনে। একটু চুপ থেকে সে বললো, সারেন্ডার করবে। শুধু একটা অনুরোধ করলো, নিউজে বা ফেসবুকে তার চেহারাটা যেন না দেখাই। বললাম, দেখাবো না। কিন্তু তুমি নয়ছয় করো না একদম। বিপদে পড়বে তুমি, তোমার পরিবারও অনেক বিপদের মুখে পড়বে। আমি জানি সেখানে তোমার টাকা পয়সা রাখা আছে, বাড়ির আশেপাশে অস্ত্র-গুলিও আছে।

এবার ভুত দেখার মতো করে তাকালো জুয়েল। স্বীকার করলো। বললো, বাড়ির আশেপাশে না ভাই। সুন্দরবনে লুকানো আছে। পিঠে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, তোমার খবর রাখবো আমি। এদিক সেদিক করো না! বন্দুক হাতে চুপচাপ বসে পানির দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

অনেক ক্ষণ হলো বড়শি ফেলছি। কিন্তু মাছের কোনো খবর নাই। ট্রলারের রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে সরদার বললেন, ও ভাই, আপনার তো রাশি ভালো না। আমি আসতেছি। সেই হাসি দিয়ে বললেন, মাছ পাচ্ছেন না তো কী হইছে! চা খান। বলেই দুধ চা হাতে নিয়ে পাশের নৌকায় নেমে আসলেন। নৌকা বেয়ে চলে আসলেন কাছে। বলেই হাত বড়শির সূতা ধরিয়ে দিলাম তাঁর হাতে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, আপনি না থাকলে মাছ হয়? মিনিট দশ পর টান পড়লো। হ্যাঁচকা টান! সরদার তো মহাখুশি! টানতে টানতে সূতা জড়িয়ে গেলো পানির নিচের ডালপালার মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ কসরৎ চললো। তারপর উঠে আসলো বিশাল লম্বা একটি কুঁচিয়া! আমি তো পারলে পানিতে লাফ দেই। এই সাপের মতো দেখতে সবকিছুতেই আমার ভয়!

ওটা কুঁচিয়া না ভাই, সাতহাতি। জানলাম সাতহাতি আর কুঁচিয়া নাকী এক জিনিষ না। এটা অনেক বড় হয়, লম্বাও হয়। সাত হাত লম্বা হয়ে বলে এর নাম নাকী সাতহাতি। সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেলে মাঝে মাঝে বড়শি খায় এটি। বেলায়েত সরদারের বেহাল অবস্থা। বড়শি থেকে সাতহাতিটি ছাড়াতে পারছেন না। পেঁচিয়ে জড়িয়ে একাকার। বললাম, এটা ছাড়ানোর দরকার নাই ভাই। বলতেই সূতা, বড়শিসহ পানিতে ফেলে দিলেন সরদার। বললাম, আমার তো ভাই রাশি ভালো না। কিন্তু আপনি হলেন কুঁচিয়া রাশি! বড়শি ধরলেই কুঁচিয়া ধরে আপনার হাতে! এর মধ্যে চা খেলাম। নৌকা দু’টি বেয়ে নিয়ে আসলাম ট্রলারের কাছে।

বশিরের ঘুম ভাঙ্গলো এখন। সকাল থেকে এতো হইহুল্লোড় হলো, কিছুই জানেন না। বললো, গরমে ঘুম ভাঙ্গছে ভাই। তা না হলে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতাম! তখন প্রায় অর্ধেক জোয়ার। নদীর পানি ঢুকছে। মুখটা ধুতে গিয়ে দেখি পানিতে লবণ নাই। আসলে পূর্ব সুন্দরবনের খাল-নদীতে প্রায় সারা অর্ধেক বছরই মিঠা পানি থাকে। বর্ষায় উজান থেকে নতুন পানি আসে বলে এদিকের পানিতে এখন লবণ নাই। অদ্ভুত ব্যাপার! অথচ পশ্চিমের খাল নদীর পানি এখনও মুখে নেওয়া যায় না। লবণ জলের এই বন উপকূলকে বুঝতে সময় লাগবে। আমাকে বুঝতেই হবে। তা না হলে দস্যুতা নিমূর্লের যে চেষ্টা চলছে সেটি শেষ করা যাবে না। কালো হাতগুলো চিনতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনের ইতিহাসে নায়ক না, কখন যে খলনায়ক হয়ে যাবো, টেরও পাবো না।

(ছবিতে আমার পাশে বনদস্যু ভান্ডারী। তার পাশে জুয়েল)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top