মুখোমুখি বনদস্যু আর জেলে বহর | রূপান্তরের গল্প ১৮৮ | Rupantorer Golpo 188 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৮ : সহকর্মীদের শরীর ভালো না। মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন উঠতে পারছেন না। অন্যদের পেটে সমস্যা। আসলে সুন্দরবনের এই পরিবেশে সবাই টিকে থাকতে পারে না। এখানে শরীরটাকে সুস্থ্য রাখতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। বিশেষ করে খাওয়া দাওয়ার বিষয়টা নিয়ে কোনো রকম হেলাফেলা করা যায় না। বর্ষায় সুন্দরবনে খাবার পানির সমস্যা হয় না। বৃষ্টির পানি সুপেয়, সবাই এই পানিই পান করে। আমি নিজেও এতে অভ্যস্ত। কিন্তু সহযাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি নিয়ে যাই লোকালয় থেকে। বর্ষা পেরোলে আমিও খাবার পানি নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই না।
ভাদ্র মাসে একটু পর পর বৃষ্টি নামে। তারপর ভ্যাপসা গরম পড়ে। বাতাস থেমে যায়। একটু রোদ ওঠে। গরমের তীব্রতা বাড়ে। এরপর আবার মেঘ জমে। বৃষ্টি নামে। বন উপকূলের বাতাস এসময় ভারী হয়ে থাকে। কখন যে শরীরটা পানিশূণ্য হয়ে পড়ে টের পাই না। শুরুতে বুঝতাম না। দস্যুদের আস্তানায় তিন/চার দিনের সফরগুলোতে পুরোটা সময় জেগে থাকতে হয়। তার ওপর শরীর পানিশূণ্য হলে বিপদ বাড়ে। তাই এই সফরগুলোতে সব সময় খাবার স্যালাইন সাথে রাখি।
সারাদিন একটু একটু করে চুমুক দিয়ে স্যালাইন খাই। সুন্দরবনের এই লবণ পানির দুনিয়ায় খাবার পানি নিয়ে অবহেলার সুযোগ নাই। বেশি অসুস্থ্য হলে ডাক্তার-হাসপাতাল নিতে নিতে বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। অবশ্য আষাঢ় থেকে কার্তিক-অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত পূর্ব বাদার খাল নদীর পানি খাওয়া যায়। সেটা জেলেদের পেটে সয়ে গেছে, আমাদের সইবে না। সহযাত্রীদের বেশি বেশি খাবার স্যালাইন খেতে বললাম। নৌকা থেকে ওষুধ-পত্র বের করে আনলো দস্যু দলের সদস্য ভান্ডারী।
জোয়ার হয়েছে চার ঘন্টা হলো। বড় নদী থেকে খালে পানি ঢুকছে সরসর করে। তীব্র স্রোত। সেই স্রোতে ভেসে আসছে বিভিন্ন গাছের ডাল-পাতা আর ফল। জোয়ারে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে গাছের বীজ। ভাটায় নেমে যাচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। বাদা থেকে গাছের ঝরা পাতাগুলো নামে ছোট খালে। ভাটার স্রোতের সাথে সেগুলো নেমে যায় খালে, খাল মিশে নদীতে, নদী যায় সাগরে। বিশাল এই পানির চক্র চলতে থাকে প্রতি ছয় ঘন্টা পর পর, অনন্তকাল ধরে। নৌকায় বসে বসে দেখছি আর ভাবছি সুন্দরবন কতোটা বৈচিত্রময়! এই পানির নিচের বৈচিত্র আরও রহস্যময়। মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবন চলে কতো মানুষের! আবার কতো মানুষের জীবনও কেড়ে নেয় এই সুন্দরবন।
খালের গোঁড়ায় দস্যুতের পাহাড়া আছে। এখন ডিউটি পরিবর্তন হবে। দুইজন ফিরবে। নতুন করে দুইজন যাবে খালের গোঁড়ায়। তারা খাওয়া দাওয়া সেরে নিচ্ছে। সঙ্গে পানির বোতল আর সিগারেটের প্যাকেটগুলো গোছানো আছে। গুলির পোসেস এ অতিরিক্ত গুলি ভরা হলো। সামনের কয়েক ঘন্টা আমাদের জন্য ঝুঁকির। তাই কড়া পাহাড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ওদিক থেকে কুঁই আসলো। মানে সিগ্যাল। ওরা ফিরতে চায়। এদিক থেকে পাল্টা ইশারা দিলো একজন। মিনিট পাঁচ এর মধ্যে ডিউটির নৌকা ফিরলো। সাথে আরও দুইটি নৌকা। ভেসালী জাল আর খালপাটা জাল দিয়ে ওরা মাছ ধরে সুন্দরবনের খালে। বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া। ওদের চেহারা ভাবলেশহীন। দস্যুরা যে ধরে আনলো তা যেন কোনো ব্যাপার না। কাছে আসতেই সালাম দিলো। বরিশালের ভাষায় বললো, গরীব মানুষের ওপরই সব এসে পড়ে।
তিন হাজার টাকা দাদন নিয়ে জঙ্গলে আসছি। গোনের শুরুতেই ডাকাতের হাতে পড়লাম। বললাম, দস্যুদের টাকা পয়সা দেন না? বললো, টাকা থাকলে কি দাদন নেই। গত গোনে নামতে পারিনি। এই গোনেও ধরা পড়লাম। এমনিতে ফরেস্টের ভয়ে লুকায়ে থাকি খালের আগায়। ভাবছিলাম কিছু মাছ ধরে মহাজনের টাকা তুলবো। আসার আগে কিছু ধার দেনা করছিলাম। সেগুলোও ফেরত দিতে হবে।
পরিচয় দিলাম না। শুধু বললাম, আপনারা চিন্তা করবেন না। এই ডাকাত দল আত্মসমর্পণ করবে। ওরা আপনাকে জিম্মি করবে না। মুক্তিপণও নিবে না। একথা শুনে খুশি হলো না তারা। বললো, ডাকাতেরা জঙ্গলেই থাকে। আপনারা চলে গেলে আবার ধরবে। তারপর দুই গুন টাকা নিবে। আপনি জানতেও পারবেন না স্যার। বললাম, আমাকে ভাই ডাকবেন। আর পরেও যেন ওরা না ধরে সেটাও আমি দেখবো। দস্যুনেতাকে বললাম, ওদের আর ধরবেন না আপনারা। এবারও কোনো টাকা নিবেন না।
দুই নৌকায় জেলে আছে চারজন। একজন শিশু, বয়স খুব বেশি হলে ১২ বছর। বাবার সাথে মাছ ধরতে এসেছে। ভাবলাম বাচ্চাটি মনে হয় ভয় পেয়েছে। কিন্তু কাছে ডেকে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম, সেও নির্বিকার। ট্রলার থেকে কয়েকটি বিস্কিটের প্যাকেট বের করে দিলাম ওকে। দুইটি বড় পানির বোতল দিলাম। পানিগুলো নিয়ে সে নৌকায় রাখা ছোট একটা ড্রামে রাখলো। বললাম, বোতলসহ রাখো। এসময় তার বাবা বললো, বোতল রাখলে বিপদে পড়বো। ফরেস্টাররা দেখলে নানা প্রশ্ন করবে। অন্য দস্যুদল দেখলে ভাববে মেলা টাকা পয়সা আমাদের, বোতলের পানি খাই। বিপদের শেষ নাই আমাদের।
গল্পে গল্পে জানলাম, বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই সুন্দরবনে এসেছে তারা। কোনো দস্যুদলকেও চাঁদা দেয়নি। ওরা এভাবেই আসে, মাছ ধরে আবার চলে যায়। সাথে কিছু নগদ টাকা রাখে। ফরেস্টের সাথে দেখা হলে ডিউটির টাকা দিতে হয়। বনদস্যুরাও নেয় ডিউটির টাকা। পাশে দাঁড়ানো দস্যু মনিরকে বললাম, এই ডিউটির টাকাটা কী? কীসের ডিউটি করেন আপনারা? বললো, সব ডাকাতেই নেয়। আমরাও নেই। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। এই টাকার পরিমান সচরাচর একশ’ থেকে দুইশ’ টাকা। জেলেরা বললো, ডিউটির টাকা না দিলে জঙ্গলের সাহেবরা মাইন্ড করে।
আমাদের রান্নাঘর তখনও সরগরম। ব্যস্ত বেলায়েত সরদার। তাকে সহযোগিতা করছে বেশ কয়েকজন। তাদের সাথে বকবক করছেন সরদার। ডাক দিয়ে বললাম, নতুন চারজন মেহমান আসছে। তাদের খাবার হবে তো? রান্নাথর থেকে খোন্তা দেখিয়ে বললেন, খোন্তা আর চামচের বাড়ি দিয়ে সবাইকে খাওয়ায়ে দিবো ভাই। আরও চারজন আসলেও সমম্যা হবে না। জেলে ভাইদের নৌকা বাঁধলো। বললাম, এই বেলাটা এখানেই থাকেন।
পাশের নৌকার মধ্যবয়সী জেলে ভাই মনে হলো মহা বিরক্ত। একটু ঝাঁঝসহ বললো, আমাদের ছেড়ে দেন। অনেক দূরে যাবো আমরা। পরের ভাটিতে মাছ ধরতে না পারলে লোকসান হয়ে যাবে। এবার বনদস্যু মনির রেগে গেলো। বললো, ডাকাতে ধরলে গালিগালাজ করে, মারপিট দেয়, তারপর আবার টাকাও নেয়। তখন তো চুপ করে থাকো। এখন স্যারে ভালো কথা বলছে, তোমাদের সহ্য হচ্ছে না! বলেই হাতে একটা লাঠি নিয়ে মারতে যায়। বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। বললাম, থাক থাক। ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না। বলেই পরিবেশ হাল্কা করতে নেমে পড়লাম তাদের নৌকায়। মগ দিয়ে পানি তুলে গোসলটা সেরে নিলাম। আমার সহযাত্রীদেরও বললাম, গোসলটা করে ফেলেন, ভালো লাগবে।
রান্না শেষ করে বেলায়েত সরদারও আসলেন। গোসল করতে গিয়ে নৌকার পাটাতন তুললেন। দেখি নৌকা ভর্তি মাছ। ভেটকি, জাবা, পায়রা, দাতিনা, পারশে, টেংড়া, রুছো, কাকিলাসহ নানা জাতের চিংড়ি মাছে ভরা নৌকার খোল। দারুণ ব্যাপার! জেলেদের বললাম, মাছ তো অনেক পেয়েছেন, তারপরও এতো মন খারাপ কেন? বললো, মাছ তো কমবেশি ধরি, কিন্তু দাম তো পাই না। মহাজনে যে দাম কাটে তাতে মাঝে মাঝে কিছু টাকা গায়ের উপরে পড়ে। নামার সময় খরচ হয়, নৌকা-জাল-দড়ি কিনতে টাকা লাগে। তারপর আবার অফিসে অফিসে টাকা দেয়া লাগে। আর দস্যুরা ধরলে মাছ নিয়ে যায়, তারপর উঠায়ে (জিম্মি) রাখে, তারপর টাকা চায় (মুক্তিপণ) এক লাখ! পাশ থেকে দস্যুনেতা বারেক তালুকদার বললেন, আমরা ডাকাতি করলেও অতো টাকা নেই না ভাই। মোটামুটি খরচ চলার মতো টাকা পেলেই চলে আমাদের।
নৌকার খোলের মাছগুলো দেখতে ভালো লাগছে। যদিও তাদের মাছ ধরার প্রক্রিয়াটি অবৈধ। যে জাল তারা ব্যবহার করছে সেটিও বৈধ না। ওরা বলে, এই জঙ্গলে মাছের অভাব নাই। আমরা তো আর বিষ দিয়ে মাছ ধরি না। বলতে বলতে একটা টুকরিতে বড় বড় দাতিনা আর পায়রা মাছ তুললো। আমাদের খেতে দিবে। টুকরিটি হাতে নিলাম। ছবি তুললাম। তারপর মাছগুলো ঢেলে দিলাম খোলের ভিতর। বললাম, আপনাদের মাছ আপনারাই রাখেন। আমাদের এখানে কাউইন মাছ রান্না হইছে। একসাথে খাবো। আর এই বেলা যেহেতু মাছ ধরতে পারবেন না সেজন্য দুঃখিত। পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বের করে বললাম, ক্ষতিপূরণ হিসাবে টাকাটা রাখেন। আবার রাতের ভাটিতে জাল ফেলবেন। এই ডাকাত দলের কাছ থেকে আমি নিয়ে যাবো আপনাদের। ওরা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, কী বলবে!
দস্যু দলের সদস্যদের ডেকে একসাথে করলাম। বললাম, সন্ধ্যার পর বা রাতের বেলা সুবিধা মতো বের হবো আমি। আপনাদের অস্ত্র-গুলি যা দেখলাম সেগুলো এই ভাবেই জমা দিবেন। সারেন্ডারের আগ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা করবেন না। কোনো অভিযোগ যেন না শুনি।
ট্রলারের ছাদে বসে সারেন্ডারের পরের প্রক্রিয়াগুলো জানালাম। কথা পরিস্কার। এটি সাধারণ ক্ষমা না, শর্তবিহীন আত্মসমর্পণ। দস্যুদের বললাম, আপনাদের নিরাপদে সারেন্ডার করানোর দায়িত্ব আমার। মামলাগুলো আলোচনা চলছে। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে পরে সরকার সিদ্ধান্ত নিতেও পারে। তবে এবিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারবো না। শুধু একটি বিষয় মাথায় রাখবেন, আত্মসমর্পণ করতে এক টাকাও খরচ নাই। উল্টো মামলা ও সংসার চালানোর জন্য RAB কিছু সহায়তা দিবে, প্রত্যেককে এক লাখ করে টাকা দিবেন প্রধানমন্ত্রী। আপনারা উঠবেন, সাধারণ জীবনে ফিরবেন। আপনাদের প্রতি সহানুভূতি নাই। ওই জেলেদের জীবন একটু নিরাপদ ও সহজ করতে মাঠে নেমেছি আমি। দস্যুরা বললো, তারা প্রস্তুত।
(ছবি: বনদস্যু শান্ত বাহিনীর ডেরায়। সুন্দরবন, ২০১৬)