বৈঠার বাড়ি খেয়ে নড়চড়ে উঠলো কুমির! বেরিয়ে আসলো আস্ত মানুষ! | রূপান্তরের গল্প ১৯০ | Rupantorer Golpo 190 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৯০ : কুমিরটি লম্বায় ১২ হাতের কম না। বিশাল মুখের দুই পাটির ভিতরে আস্ত একটা মানুষ। সেই মানুষটিকে নিয়ে কুমির ডুবছে আর ভাসছে। চরপাটার দুটি নৌকা নিয়ে সেই কুমিরকে ধাওয়া করছে জেলেরা। সুন্দরবনের এই বিপদটি অন্য রকম। ডাঙ্গায় বাঘ ধরলে তাকে অনুসরণ করা যায়। কিন্তু পানিতে কুমিরকে দাবড়ানো খড়ের পালায় সুঁই খোঁজার মতো। ডুব দিয়ে সে কোন দিকে যাবে সে ছাড়া কেউ জানে না। তাই নৌকা দুটি নিয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়া বেড়াচ্ছিলো জেলেরা। যে করেই হোক, জীবিত অথবা মৃত, ছেলেটিকে উদ্ধার করতেই হবে।
বশির বলছেন তার ভাইকে কুমিরে ধরার গল্প। মনে হচ্ছে চোখের সামনে দেখছি সে ঘটনা। সুন্দরননের ভিতরে নৌকায় বসে সেই ভয়ঙ্কর কুমির মানুষের লড়াইয়ে কথা শুনে সিউড়ে উঠছি। আসলে গল্প বললে ভুল হবে, এই ঘটনা মর্মান্তিক, বর্ণনা করা কঠিন। জীবিত একজন মানুষকে কুমির পানিতে ডুবছে-ভাসছে! ঘটনার শুরু ভোরবেলা। লোকালয়ে সেই খবর পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হলো। বশির বললো, খবর পাওয়ার সাথে সাথে ২৫/৩০টি নৌকা নিয়ে রওনা দেয় অন্যরা। খবর পেয়ে বন বিভাগও ছুটে যায়। কিন্তু পানির এই দানবের সাথে পেরে উঠবে কী করে? দুপুর গড়িয়ে বিকাল, তারপর সন্ধ্যা নামলো। কিছুতেই মানুষটিকে উদ্ধার করা গেলো না। জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা শেষ। অন্ধকার নেমে আসলো সুন্দরবনে।
বন উপকূলের মানুষ হাল ছাড়ে না। ভোর থেকে আবার শুরু হলো অভিযান। সেদিন শ’খানেক নৌকা নেমেছে। নদীর দুই পাশ দিয়ে বেয়েছে ওরা। আন্ধারমানিকের কাছাকাছি আসতে সেই ঘাতকের দেখা পেলো জেলেরা। ততোক্ষণে আস্ত ছেলেটিকে গিলে খেয়েছে কুমির। সেটাই তাকে বিপদে ফেলেছে। নদীর তীরে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে কুমিরটি। নৌকাগুলো ঘিরে ধরলো। বইঠা দিয়ে আঘাত করতে থাকলো। কুমির মেরে হলেও লাশ ফেরত নিতে হবে। সুন্দরবনে মানুষের মরদেহ রেখে যাওয়ার রীতি নাই। শরীরের এক টুকরো অংশ হলেও ফেরত নিতে হবে, কবর দিতে হবে। মনের শান্তি শুধু নয়, আইনগত কারণেও এটা করতেই হয়।
বইঠার বাড়ি খেয়ে নড়েচড়ে উঠলো কুমিরটি। এরপর উগড়ে দিলো তার শিকার। ছেলেটির পুরো শরীর বেরিয়ে আসলো কুমিরের মুখ থেকে। সে এক বীভৎস দৃশ্য ভাই। ভাইয়ের এরকম অবস্থ চোখে দেখা যায়? এক নাগাড়ে বলে চলছে বশির। আমরা নির্বাক। তাকিয়ে আছি বশিরের দিকে। দুই চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি। বললো, ভাইটাকে বাঁচাতে পারিনি ভাই। সেলা নদীর কুমিরের হিংশ্রতার কথা শুনতাম। এবার বুঝলাম, এই জঙ্গলে কুমির-মানুষের লড়াই কতোটা ভয়ঙ্কর!
বশিরের ভাই-এর মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে দাফন করা হয়। তার আগে ও পরে কুমিরের আক্রমণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সুন্দরবনের মানুষেরা ভয়কে জয় করা শিখে ছোটবেলাতেই। বাঘ হোক বা কুমির, বিনা যুদ্ধে পরাজিত হবে না।
পরিবেশ ভারী হয়ে এসেছে। সবাই মিলে দুপুরের খাবার শেষ করলাম। সহযাত্রীদের শরীর ভালো না। তাই দ্রুত বিদায় নিতে চাইলাম। কিন্তু দিনের আলোয় ফিরে যাওয়া কি ঠিক হবে? দস্যুনেতা বারেক তালুকদার বললেন, রাতের জোয়ারে উঠবেন আপনারা। এখন বের হলে আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। বললাম, বাজে দুপুর দুইটা। এখন বের হতে না পারলে আবার সেই রাত দুইটা বাজবে রওনা দিতে। এবার বশির বললো, লোকালয়ে কী অবস্থা হয়ে আছে জানি না। আমাদের খবর পেলে প্রশাসন পাগল হয়ে যাবে। বললাম, ওরা তো জানে আমি চলে গেছি ঢাকায়। সুন্দরবনের ওখানে নেটওয়ার্ক নাই। তাই ওদিকের খবর জানি না আমরা কেউ। বললাম, আমার তো সুন্দরবন ভালোই লাগে। সাথের সবাই থাকতে পারলে আপত্তি নাই। গভীর রাতেই রওনা দিবো।
ঘুরেফিরে গভীর রাতটাই সুন্দরবনে চলাফেরা করতে হয়। বনদস্যুদের সাথে গোপনে দেখা করতে সুবিধা। আবার লোকচক্ষুর আড়ালে ফিরেও যাওয়া যায়। বশিরকে বললাম, আশেপাশে কোথাও কি ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়? বনদস্যু মনির পাশ থেকে বললো, ভিতরের কোনোনো বড় গাছের মাথায় উঠলে পাওয়া যাবে। বশিরকে বললাম, একটা নৌকা নিয়ে যান। ওদিকের খোঁজ খবরটা নিতে হবে। আর আমাদের গাড়ী চালককে ফোন দিয়ে বলবেন, ভোর চারটার মধ্যে ঘাটে থাকতে। ওরা রওনা দিলো।
দুপুরের খাবারের পর শরীরটা একদম ছেড়ে দিলো। ক্লান্তি, ঘুম মিলিয়ে আর পেরে উঠছি না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার চার পাশে মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিলো ওরা। একজন হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। ঘুমের মধ্যেও টের পাচ্ছি এসব। এটা ঘুমানোর সময় না। কিন্তু শরীর বিদ্রোহ করেছে। ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলো। এসময় একটু বৃষ্টি হয়। ওরা একটা পলিথিন টানিয়ে দিলো আমার ওপর দিয়ে। ওদের বললাম, খালের মুখের ডিউটিতে যেন গাফিলতি না থাকে। বললাম, নতুন কোনো বিপদ মাথায় নিতে পারবো না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙ্গলো প্রায় চার ঘন্টা পর, বেলায়েত সরদারের ডাকে।
স্টিলের গামলায় কতোগুলো ভাজা মাছ নিয়ে পাশে বসেছেন সরদার। বড় বড় পায়রা আর দাতিনা মাছ। সাথে একটা বড়সড় গলদা চিংড়ি। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। সন্ধ্যা হবে হবে। মেঘও আছে আকাশে। ভাটার টানে খালের পানি নেমেছে তলানিতে। বললাম, মাছগুলো কই পেলেন? পাশ থেকে জেলে কাশেম ভাই বললেন, মাছ তো নিলেন না। কয়টা খেয়ে যান। ভালো লাগবে আমার। বললেন, ভালোবেসে দিছি ভাই। অন্য ভাবে নিয়েন না।
কাশেম ভাই বলছেন, আপনাকে আমরা চিনতে পারিনি শুরুতে। পরে বনদস্যুদের মুখে শুনলাম। মাস্টার, মজনু, ইলিয়াসের মতো জলদস্যুদের আপনি সারেন্ডার করাইছেন। এই শান্ত বাহিনীও আপনার হাতে সারেন্ডার করবে। আর এই কাজে আপনি কোনো টাকা পয়সা নেন না। এমন লোক তো খুঁজে পাই না। বললেন, মঠবাড়িয়ায় আমার বাড়িতে আসবেন। রাজহাঁস রাখবো আপনার জন্য। বললাম, সে না হয় আসবো। কিন্তু আপনারাও অবৈধ ভাবে মাছ ধরা বন্ধ করেন। ফরেস্টের অনুমতি নিয়ে আসবেন। আর মহাজন বাদ দিয়ে নিজের মতো করে মাছ ধরবেন, বেচবেন। দেখবেন ভালো রোজগার হবে। ওরা বললো, মহাজনে মানবে না। জঙ্গল নদীতে টিকতেও দিবে না। বললাম, ডাকাত সরলেও দুষ্টটু মহাজনদের অত্যাচার কমবে বলে মনে হয় না।
বিকালের নাস্তাটা বেশ ছিলো। তাজা মাছের ভাজা, সাথে সরিষার তেল, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখা। সরদারের রেসিপি বলে কথা। ওদিকে চা উঠেছে কাশেম ভাইয়ের নৌকার চুলায়। সবার জন্য ঘন লিকারের রঙ চা হলো। তারপর আমার জন্য পুরো এক মগ দুধ চা। সন্ধ্যা নামলো। খালের গোঁড়ায় ডিউটি পরিবর্তন হলো। সন্দেহজনক আর কোনো ঘটনা ঘটেনি কয়েক ঘন্টায়। ওদিকে বশির ফোনে কথা বলে ফিরেছে অনেক আগেই। লোকালয়ের কেউ আমাদের সুন্দরবনে প্রবেশের খবর পায়নি। সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
জঙ্গলে আরও বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হবে। আলো জ্বালালাম না। নৌকার কুপি বাতি বা টেমিগুলো জ্বলছে শুধু।
অন্ধকারে বসে বনদস্যু শান্ত বাহিনীর সদস্যদের অন্ধকার জীবনের গল্প শুনছি। রাতের জন্য আবার রান্নায় বসবেন বেলায়েত সরদার। বললাম, এবার দস্যু দলের বাবুর্চির রান্না খাবো। বন্দুক হাতে আনিসুর এগিয়ে আসলেন। স্বল্পভাসী এই দস্যু শান্ত বাহিনীর বাবুর্চি। বললেন, রাতে কাঁকড়া রান্না করে খাওয়াবো? বললাম, খুব ভালো হবে। সরদারেরও একটু বিশ্রাম হবে।
শান্ত বাহিনীর নৌকার খোলের ভিতরটা ভর্তি কাঁকড়া। পাটাতন খুলে বড় বড় কাঁকড়াগুলো তোলা হলো। তারপর শুরু হলো কাটা-বাছার কাজ। জেলেরাও হাত মিলালো সেই কাজে। গল্প-আড্ডার সাথে সাথে রান্না হলো। এসময় বন্দুকধারী তরুন বনদস্যু আছাদ আর দুলাল ভান্ডারীর ছিলো সতর্ক পাহাড়ায়। রাতের বেলা ওই জঙ্গলে কখন বাঘ চলে আসে বলা যায় না। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। হরিণ অথবা বন্য শুকরের দল আছে আশেপাশে। ভান্ডারী বললো, এর মানে বাঘ মামা আশেপাশে নাই।
রাতের খাবার খেলাম সবাই মিলে। বনদস্যুদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। রাত তখন প্রায় দুইটা বাজে। সবগুলো নৌকা বের করা হলো সেলা নদীতে। তারপর গাছগুলোর ভিতর দিয়ে টেনে নেওয়া হলো আমাদের ট্রলার। বড় নদীতে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। শান্ত বাহিনীকে বিদায় দিলাম। যাওয়ার সময় ওরা বললো, ডাক দেওয়া মাত্র হাজির হবে তারা। নৌকা বেয়ে নদী পাড়ি দিলো বনদস্যু দল। একটু দক্ষিণে গেলেই আন্ধারমানিক। তার উল্টো দিকের বড় খালটি ধরে তারা চলে যাবে টেংড়ার খালের কোনো সরু খালের ভিতর।
মঠবাড়িয়ার জেলেদের নৌকাগুলোও বিদায় নিলো। ওরা সামনের ভাটিতে নেমে যাবে নিচের দিকের কোনো খালে। ওখানে আছে মহাজনের ভরের নৌকা। নৌকার মাছগুলো বড়ফে না দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। ওরাও বিদায় নিলো।
আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হলো। নিস্তব্ধ ওই সুন্দরবনের নিরবতা ভাঙ্গলো। সুকানিতে দাঁড়ালেন বেলায়েত সরদার। সেলা নদীর মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। জোয়ার থাকতে থাকতে উঠবো পশুরে। তারপর মংলার যে ঘাট থেকে রওনা দিয়েছিলাম, সেখানে নেমেই গাড়িতে উঠবো। দিনের আলো ফোঁটার আগে মংলা ছাড়বো আমরা।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে জয়মনিরঘোল পেরিয়ে গেলাম। পথে কেউ ডাকাডাকি করলো না। পশুর নদীতে নানা রকম জলযান চলাফেরা করে। ওই ভীড়ে মিশে গেলাম। কোনো ঝামেলা ছাড়ে শেষ হলো সফর। ফিরে যাচ্ছি সুন্দরবন থেকে। সাথে যাচ্ছে শান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণের আবেদন।