রূপান্তরের গল্প ১৯১ | Rupantorer Golpo 191

শান্ত’র পর আলম বাহিনী, টেনে ধরছে সুন্দরবন! | রূপান্তরের গল্প ১৯১

শান্ত’র পর আলম বাহিনী, টেনে ধরছে সুন্দরবন! | রূপান্তরের গল্প ১৯১ | Rupantorer Golpo 191 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৯১ : সুন্দরবনের জেলেরা আমাকে ভালোবাসে ভাই। খবর নিয়ে দেখেন আমরা ওদের সাথে কেমন আচরণ করি, অত্যাচার করি কী না! গত রাতে গল্পে গল্পে একথা বলছিলেন দস্যুনেতা বারেক তালুকদার। বললাম, জেলেরা এতো ভালোবাসলে সাথে অস্ত্র রাখার কী দরকার? উনি বললেন, বন্দুক-গুলি না থাকলে তো আমাদের পিটিয়ে মারবে। সুন্দরবনের দস্যুদের সবাই নিজেদের নিরীহ প্রমাণের চেষ্টা করে।

যতোবারই বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে গেছি, আমার সামনে ভালো ভালো কথা বলে। সাজিয়ে গুছিয়ে জেলেদের দিয়ে তাদের পক্ষ্যে কথা বলায়, সুনাম করায়। কিন্তু এখন আমি বুঝি অনেক কিছু। কারণ আগের ৭/৮ বছর জেলেদের সাথে সময় কাটিয়েছি। অভিজ্ঞতা ছিলো, ভিতরের অনেক কিছুই জেনেছি। জেলেদের মুখে শুনেছি দস্যুদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা। একথা ঠিক যে সুন্দরবনের দস্যুরা জেলেদের প্রাণে মারে না। অতিরিক্ত ভয় পেলে জঙ্গলে আসবে না মানুষ। তখন খেয়ে পড়ে টিকে থাকাও মুশকিল হবে।

ফিরে যাচ্ছি ঢাকায়। শান্ত বাহিনীর সারেন্ডারের বিষয়টি নিয়ে এখন আর সন্দেহ নাই। RAB এর গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদের কাছে সফরের কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে রাখলাম। ভোরবেলায় মংলার ফেরি ঘাটে তেমন মানুষ ছিলো না। তাই কোনো ঝামেলা ছাড়াই ট্রলার থেকে নেমে গাড়িতে উঠলাম। বেলায়েত সরদারকে বিদায় দিলাম। এই কাজে আমার সোর্স বশিরও বিদায় নিলো। বাড়ি ফিরলো দস্যুনেতা বারেক তালুকদারের শ্যালক স্বপন। চলতি পথে নামিয়ে দিলাম মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন ও বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন আলীকে।

সকাল সকাল পৌঁছালাম গোপালগঞ্জে। সাংবাদিক ছোট ভাই রাজীব আহমেদ রাজুর বাসায় বিরতি নিলাম। নাস্তা সেরে ধরলাম ঢাকার পথ।

গাড়িতে রেখে যাওয়া ফোনে কয়েকশ’ ফোন এসেছে। আরেকটি ফোনেও অনেকগুলো মিসড কল অ্যালার্ট। সাতক্ষীরার সেই আলমগীরের এতোগুলো ফোনকল দেখে একটু চিন্তায় পড়লাম। ওদিকে কোনো বিপদ হলো না তো? সোর্সদের নিয়ে কিছু অপ্রত্যাশি কাজ নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তা হয়, তেমনি আমাে কারণে তাদের কোনো বিপদ হোক সেটিও চাই না।

ফোন করলাম আলমগীর ভাইকে। না। কোনো বিপদ না। সবকিছু ঠিক আছে। জানালেন, আলম সরদার নামে পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুদল সারেন্ডার করতে চায়, কথা বলতে চায়। বললাম, জঙ্গলে ছিলাম ভাই। ওদের ফোন দিতে বলেন।

আলম সরদার পুরনো বনদস্যু। তবে সব সময় সুন্দরবনে থাকে না। আলিফ বাহিনীর সাথে দস্যুতা শুরু করে। তারপর কখনও মোতালেব, কখনও মজনু বাহিনীর সদস্য। পরের দিকে ছোট করে নিজের নামে দস্যুতা শুরু করে। তবে বছরের অর্ধেক সময় জঙ্গলে থাকে না সে। নিরাপদ কোথাও আত্মগোপনে থাকে।

কিছুদিন আগের কথা। সারেন্ডারের সময় মজনু ডাকাত বলেছিলেন তার কথা। সারেন্ডার করবে আলম, এমন খবর ছিলো পশ্চিম সুন্দরবনে। যতোবারই ভাবি যে সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে কাজের ইতি টানবো, ততোই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে সুন্দরবন। বিশেষ করে মজনু ও ইলিয়াসের একসঙ্গে আত্মসমর্পণ করবে কখনও কল্পনা করিনি। আবার তার পর দস্যদুল যে আলম ও শান্ত বাহিনী এগিয়ে আসবে সেটিও ছিলো পরিকল্পনার বাইরে। আলমের নিজ থেকে যোগাযোগ করতে চাওয়া, তার আগে শান্ত বাহিনীর এক রকম জোর করে তাদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া, এগুলো ঘটছে একের পর এক। মনে হয় যেন অদৃশ্য কোনো ইশারায় ঘটছে ঘটনাগুলো।

গাড়ি চলছে মহাসড়ক ধরে। ফেরি পার হবো গোয়ালন্দ ঘাট দিয়ে। পদ্মাসেতুর কাজ শুরুর পর থেকে মাওয়া ঘাটটি বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পার হতে সময় লাগে। তাই একটু বেশি পথ হলেও ওদিক দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফোন দুটো সাইলেন্ট করে ঘুম দিবো। কিন্তু তার আগেই আসলো বারেক তালুকদারের ফোন। কুশল বিনিময় শেষ ফোন রাখলাম। ভাবছিলাম এই সশস্ত্র অপরাধীদের জীবনটা বড়ই কঠিন, ততাই বাড়ি ফেরার এতো আকুলতা।

দস্যুদল হিসাবে শান্ত বাহিনী’র তেমন নাম-ডাক নাই। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য বলছে, পূর্ব সুন্দরবনের কুখ্যাত ডাকাত বাহিনী- শান্ত বাহিনী। বাগেরহাট অঞ্চলে জেলেদের কাছ থেকে তারা চাঁদা নেয়, অপহরণ করে, আদায় করে মুক্তিপণ। কুখ্যাতির সাথে বাস্তবে শান্ত বাহিনীর চাল চলনের খুব একটা মিল পাইনি। তবে অবৈধ অস্ত্রে সজ্জিত একটি দল নিঃসন্দেহে অপরাধী। বারেক তালুকদার এই দলের প্রধান। বনদস্যুতার সাথে যার সম্পৃক্ততা দশ বছরেরও বেশি। ২০১৬ সালে এসে আরও বড় বড় দস্যুদলের তুলনায় নাম-ডাকে পিছিয়ে। অন্য দিকে পশ্চিম সুন্দরবনের আলম সরদারের দস্যু দল আরও ছোট। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পরই জঙ্গলে নামে। অবৈধ অস্ত্রের বাজার থেকে একটি নাইন এমএম বিদেশি পিস্তল কিনে। তারপর একটা একটা করে বন্দুক ও গুলি জোগাড় করে। অনেকটা নিরবে অবস্থান করে সুন্দরবনে।

বেলা আরেকটু বাড়ার সাথে সাথে ফোন আসলো বরিশাল থেকে। মেজর আদনান কবীর বেশ উদ্বিগ্ন। বললেন, গোয়েন্দা প্রধানের সাথে তাঁর কথা হয়েছে। বললাম, এই সারেন্ডারটাও তোমরা করবে? খুলনা RAB-এর এলাকা সুন্দরবন। সামনের আত্মসমর্পণগুলো তারাই করুক না হয়। উনি বললেন, বঙ্গোপসাগরের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নাই ভাই। বাঁকী কাজগুলোও একসাথে করতে চাই। বললাম, সদর দফতরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করা যাবে। তারপর শান্ত বাহিনীর আদ্যোপান্ত জালাম। বললাম, আলম সরদারও খোঁজ নিচ্ছে। আদনান বললেন, আলম তো পুরনো বনদস্যু। সারেন্ডার করছে মন্দ হবে না। আপনি কাজ আগান। আমি সদর দপ্তরে কথা বলছি। এরপর আসলো অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। ওপাশ থেকে পরিচয় দিলো, আলম সরদার বলছি ভাই।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর-কয়রার মতো ভাষা। কুশল বিনিময় হলো। বললো, টিভি আর ইউটিউবে আমার কাজকর্মগুলো দেখেছেন উনি। খুব শিগগিরি সারেন্ডার করবেন। তবে সাথে অস্ত্রশস্ত্র তেমন নাই। বললাম, যা আছে তাই থাকুক। অস্ত্র বাড়ানোর প্রয়োজন নাই। জানালাম, আরেকটা দস্যু দলের সঙ্গে দেখা করে ফিরলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সময় ঠিকঠাক হলেই সারেন্ডার করবে ওরা। আপনি চাইলে একসাথে সারেন্ডার করতে পারবেন। অস্ত্র-গুলি নতুন করে জোগাড় করবেন না। হয়তো হাতে বেশি সময় পাবেন না। সদস্যদের নিয়ে তৈরি হন দ্রুত।

আলমকে বললাম, ঢাকা ফিরে দুই/একদিনের মধ্যে সারেন্ডারের দিনক্ষণ চুড়ান্ত হবে। সামনে আগস্ট মাস। মন্ত্রী যেদিন সময় দিবেন তার আগের দিন আপনাদের নিয়ে আসবো। আলম বললেন, বারেক ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তাঁর। বললাম, আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? বললেন, না ভাই। আমিও ডাকাত সেও ডাকাত। ওদের থেকে আমরা অনেক দূরে থাকলেও সুন্দরবনেই তো থাকি।

ফেরি পার হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে বিকাল গড়িয়ে গেলো। সামনের কয়দিন। একটু বিশ্রাম নিবো। ফোনে ফোনে সারেন্ডার করা বনদস্যুদের খোঁজ রাখবো। আর অফিসের দৈনন্দিন কাজগুলো করবো। সামনের কয়দিন কোনো রকম চাপ নিবো না। ক্লান্ত লাগছে খুব।

বাসায় ফিরলাম। একদিন বিশ্রাম নিয়ে অফিস শুরু করলাম। টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করি। মূল কাজ রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। কিন্তু বন-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে গত কয়েক বছরে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন আমার পেশার মূল কাজটি থেকে। পুরনো সম্পর্কগুলো ঝালাই করতে হবে। সাংবাদিকতার ইমেজ কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। সেই পুরনো সম্মান হয়তো ফিরে পাবে না এই পেশা। কিন্তু নিজের কাজটুকু দিয়ে নিজের সম্মানটুকু ধরে রাখতে হবে। সাংবাদিকতার অধ:পতন খুব পীড়া দেয় আমাকে।

(ছবিটি সুন্দরবনের না। গোপালগঞ্জের ফসলের মাঠ। প্রতিবার সুন্দরবন যাওয়া আসার পথে উপভোগ করি গ্রাম বাংলাকে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top