রূপান্তরের গল্প ১৯৪ | Rupantorer Golpo 194

টানাপোড়েন কেটে গেছে, আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত শান্ত বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১৯৪

টানাপোড়েন কেটে গেছে, আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত শান্ত বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১৯৪ | Rupantorer Golpo 194 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৯৪ : পশ্চিম সুন্দরবনে গোলাগুলি হচ্ছে। লোকালয় থেকে বেশ দূরে, ফিরিঙ্গির চরের আশে পাশে কোথাও। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জেলেরা। পরদিন জানা গেলো বনদস্যু জোনাব বাহিনী ও আলম বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আলমকে ফোনে পাচ্ছি না। বিভিন্ন দিক থেকে খবর পেলাম, আলম বাহিনীর ওপর হামলা করেছে জোনাব। তার মানে সত্যি সত্যি জোনাব নেমেছে আবার। কয়েকটি অস্ত্র নিয়ে আপন ভাইসহ কয়েক জনকে নিয়ে আবারও জোনাব সুন্দরবনে।

বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আলম বাহিনী সারেন্ডারের জন্য প্রস্তুত ছিলো। এখন যদি তার কিছু হয় তাহলে এবারের উদ্যোগটি ভেস্তে যাবে। একটু পর পর ফোন দিচ্ছি আলমের নাম্বারে। ফোন বন্ধ। আমার কোনো সোর্সদের কাছেও কোনো খবর নাই। পরদিন অন্য একটি ফোন নাম্বার থেকে ফোন দিলেন দস্যুনেতা। বললেন, জোনাব আক্রমণ করেছে। তবে কিছু হয়নি। বরং পাল্টা গুলিতে তারাই পরাস্ত হয়েছে। নৌকা ছেড়ে পালিয়েছে জোনাব। ফেলে গেছে একটি বন্দুক। নৌকার খোল-এ কয়েকটি গুলিও ছিলো।

সেদিন জোনাবের সাথেও কথা হয়। আলমের নামে এক গাদা অভিযোগ তার। বললাম, নিজেই তো ভালো পথে আসছেন না। কতোবার বললাম। একবার দেখাও করলেন না। আপনি আসলে কী করতে চান বলেন তো? জোনাব বললেন, সারেন্ডার তো করবোই। কিন্তু আমার কাছে তো কিছু নাই। কী দিয়ে সারেন্ডার করবো? বললাম, যা আছে তাই দিয়ে করবেন। আপনি কিন্তু নয়ছয় করছেন! বিরক্তি প্রকাশ করে ফোন কেটে দিলাম। আলমকে বললাম, তৈরি থাকবেন। যেকোনো মুহুর্তে ডাক দিবো।

এদিকে পূর্ব সুন্দরবনের শান্ত বাহিনীর ভিতরে তখন সংকট চরমে। কয়েকদিন ধরে তারা সারেন্ডার নিয়ে বচসা করছে। আরও দুই দিন পর খবর পেলাম সেই জুয়েল পালিয়েছে দু’টি অস্ত্রসহ। তার মানে নিজের সঙ্গে আনা একটি বন্দুকের সাথে এখান থেকে একটি বন্দুক চুরি করে পালিয়েছে সে। এটা নতুন আরেকটি দস্যু বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করবে সে।

বারেক তালুকদারকে বললাম, তৈরি হন এবার। সারেন্ডার করে ফেলতে হবে। বেঁকে বসলো তারা। বললো, আরেকটু সময় লাগবে। বললাম, দেরি করলে মারা পড়বেন। আপনাদের প্রতিপক্ষ খুবই সক্রিয়। সুযোগ পেলেই গুলি করবে। মেরে ফেলবে বা কাউকে দিয়ে মারাবে। অনেকেই সারেন্ডার বন্ধ করতে চায়। তারাও আপনাদের খুঁজছে।

বারেক তালুকদারকে কেউ বিভ্রান্ত করছে। বেশ বিরক্ত আমি। তবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে বললাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিন তারিখ ঠিক করেন। উনারা কাজ শুরু করলেন। আমাকে চায়ের নিমন্ত্রণ দিলেন গোয়েন্দা প্রধান। পরদিন RAB সদর দপ্তরে বসলাম আমরা।

পরবর্তী দস্যুদলগুলোকে খুলনা RAB-এর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করানোর অনুরোধ করলেন তাঁরা। বললাম, উনারা আমাকে বাদ দিয়ে কাজটি করতে চাচ্ছেন। মজনুকে তারা রীতিমতো থ্রেট করেছিলো। মোহসীন উল হাকিমের মাধ্যমে আত্মসমর্পল করলে তাদের বিপদে পড়তে হবে বলেও ভয় দেখায় সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা। এমনও জেনেছি, ওদের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জঙ্গলে আমাকে পেলে গোলাগুলি হয়ে যাবে। জঙ্গলের দস্যুদের বলা হতো, আমার সাথে যোগাযোগ যেন না রাখে কেউ। গোয়েন্দা প্রধানকে বললাম, আমাকে কারা থামাতে চাইছে? কেন থামাতে চাইছে বলতে পারেন? উনি বললেন, আমরা আপনার পাশে আছি।

কর্নেল আজাদ বললেন, মাঠ পর্যায়ের কিছু মানুষ এমন থাকবেই। এদের নিয়ে ভেবে কাজ নাই। বললেন, RAB-এর শীর্ষ কর্তারা আপনার পাশে আছেন। বললাম, কাউকে ভয় পাচ্ছি না। সুন্দরবনের ডাকাতদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক বার মরেছি। আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। তবে সারেন্ডারে আগ্রহী বনদস্যুদের ভয় দেখালে কাজ করতে একটু সমস্যা হয়।

কয়েক দিনের মধ্যে দস্যুদলের আত্মসমর্পণের তারিখ ঠিক হলো। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাবেন। সারেন্ডার করবে সুন্দরবনের আরও দুটি দস্যুদল। বরিশালের মেজর আনদান কবীরের সাথে আলোচনা চলছিলো। ৮ সেপ্টেম্বর মাথায় রেখে সবকিছু গোছাতে হবে। বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই দুইটি দস্যুদলের অবস্থান দুই দিকে। আলমের বাহিনীর অবস্থান পশ্চিম সুন্দরবনে, সাতক্ষীরা সুন্দরবনে। আর শান্ত বাহিনীর অবস্থান পূর্ব দিকে, বাগেরহাটের মংলা-মোড়েলগঞ্জের সুন্দরবনে। এক দিনের মধ্যে দুই দলকে উঠিয়ে সারেন্ডারের অনুষ্ঠানস্থলে আনতে হবে। এবারের অনুষ্ঠান হবে বরিশালে।

এর পরের কয়েকদিন শুধু কথাবার্তা চালিয়ে গেলাম। আলম সরদার সারেন্ডারের জন্য প্রস্তুত। শান্ত বাহিনীও ঝামেলা কাটিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তাদের সদস্য জুয়েল পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের বিভ্রান্তি কেটে গেছে। ওরা বললো, জুয়েলের বিষয়ে আমার সতর্ক বার্তা সঠিক ছিলো। বললাম, সামনেও বিপদ হতে পারে। আপনাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে, সেটি প্রশাসনও করতে পারে আবার হতে পারে অন্য কোনো দস্যুদল। জুয়েল আপনাদের অবস্থান ও সক্ষমতা সম্পর্কে জানে। তাই আপনাদের ধ্বংস করতে হয়তো জুয়েলকেই ব্যবহার করা হবে। খবর পেলাম, পূর্ব সুন্দরবনের আরেকটি দস্যুদল বড় সুমন বাহিনীতে যোগ দিয়েছে জুয়েল।

৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে সময় দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেভাবে কাজ গোছানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে ঢুকে পড়বো পশ্চিম সুন্দরবনে। সেখানে আলম বাহিনীকে উঠিয়ে তারপর আবার যেতে হবে পূর্ব জঙ্গলে। শান্ত ও আলম বাহিনী একসাথে চলে যাবে RAB হেফাজতে। এরপর অস্ত্র জমা দিয়ে সাধারণ জীবনের যাত্রা শুরু করবে এই বনদস্যুরা।

বনদস্যুদের জীবনে ফেরা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। কিন্তু জেলেরা খুবই আনন্দ পাচ্ছে। ভয়ঙ্কর দর্শন সশস্ত্র দস্যুরা বদলে যাচ্ছে। চোখের সামনে তারা রূপান্তরিত হচ্ছে সাধারণ মানুষে। এই রূপান্তর তাদের চিন্তারও বাইরে ছিলো। অনেকে বলেন, যে অপরাধীরা বছর বছর ধরে জেলেদের নির্যাতন করছে তাদের প্রতি এতো সহানুভূতি কেন? কঠোর সমালোচনা হচ্ছে এসব নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, দস্যুদের কঠোর শাস্তিই পেতে হবে। আমি বলি, ওদের জন্য আলাদা কিছুই করা হচ্ছে না। শুধু নিরাপদ আত্মসমর্পণের ব্যবস্থাটুকু করা হচ্ছে। জঙ্গলে-সাগরে ফেরারী সশস্ত্র মানুষগুলোর প্রতি তাদের ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে জেলেরা বলছে ভিন্ন কথা। একের পর এক বনদস্যু দলের আত্মসমর্পণ তাদের মনে সাহস যোগাচ্ছে।

ঘুরে ঘুরে জেলেদের সাথে কথা বলে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করেছি। তাদের উপকার হবে নিশ্চিত হয়েই এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। সামনে চতুর্থ ও পঞ্চম দস্যুদল সারেন্ডার করবে। সেই সাথে এগিয়ে যাবে আমার দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়ে তোলার চেষ্টা।

(ছবি: শান্ত বাহিনীর প্রধান- বারেক তালুকদার)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top