রূপান্তরের গল্প ১৯৬ | Rupantorer Golpo 196

রাতেই দেখা হবে আলম বাহিনীর সাথে | রূপান্তরের গল্প ১৯৬

রাতেই দেখা হবে আলম বাহিনীর সাথে | রূপান্তরের গল্প ১৯৬ | Rupantorer Golpo 196 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৯৬ : গাড়ি বহর ছুটছে। সামনে হুটার বাজিয়ে চলছে প্রথম গাড়ি। পিছনে পর পর কয়েকটি গাড়ি। RAB-এর গাড়ি বহর ছুটছে শ্যামনগরের বন উপকূল মুন্সিগঞ্জ-এর দিকে। বরিশাল RAB-এর সেই বহরের মধ্যে একটি গাড়ি আমাদের। সোজা ঢুকে পড়লাম মুন্সিগঞ্জ ফরেস্ট ক্যাম্প-এ। সন্ধ্যা বেলা। বাজারে ভীড় বেশি। তবে গাড়িতে বসে নিজেকে আড়াল করতে সমস্যা হয়নি। বন বিভাগের অফিসটির সামনেই চুনা নদী। জেটিতে অনেকগুলো জলযান ভিড়ানো। তার মধ্যে একটি আমাদের ভাড়া নেওয়া। আরেকটি ট্রলার RAB-এর। একসাথে রওনা দিবো আমরা।

আলম সরদারের সাথে সবশেষ বিকালে কথা হলো। তারপর থেকে আর ফোনে পাচ্ছি না। মনের ভিতরটা তাই খচখচ করছে। যদিও বনের ভিতরে সন্ধ্যার পর তাদের নেট এ থাকার কথাও না। তবুও দুশ্চিন্তা হয়। ফরেস্ট অফিসে নামতেই দেখা হলো আলমগীর ও মিলনের সাথে। এই মিলনের কথা লিখেছিলাম গত পর্বে। আলমের সাথে দস্যুতার শুরু তার। যদিও আপাতত জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আজকের সফরে মিলন আমাদের পথ দেখাবে।

RAB-এর একটি ক্যাম্প আছে পাশেই। সুন্দরবন উপকূলের দস্যুতা প্রতিরোধে এই ক্যাস্প। যদিও আমাদের সাথে যে বহর এসেছে সেটি বরিশাল RAB-এর। আর এই অঞ্চল খুলনা RAB-এর। আমাকে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় খুলনা রাজি না থাকায় বরিশাল থেকে সংস্থাটির সদস্যরা এসেছেন। মেজর আদনান কবীরের নেতৃত্বে চলছে তাদের কার্যক্রম। খুলনায় বরিশালের টিম এসে কাজ করছে, বিষয়টি অস্বস্তিকর। কিন্তু এছাড়া আর কীই বা করার আছে?

সময় নষ্ট না করে ট্রলারে উঠে পড়লাম। ছাড়ার আগেই রান্নাঘরের দখল নিলেন বেলায়েত সরদার। বাজারের ব্যাগগুলো চেক করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক কেনা হয়েছে। শুধু চুলার গ্যাস সিলিন্ডারটি আনা হয়নি। সরদার খেয়াল না করলে সিলিন্ডার ছাড়াই বনে ঢুকে পড়তাম। কী বিপদ যে হতো তখন! দ্রুত একটি একটি সিলিন্ডার আনানো হলো।

ওদিকে পাশের ট্রলারে উঠে বসেছেন RAB সদস্যরা। নেতৃত্বে আছেন দু”জন কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে পুরো বহরে ২০ জন হবেন। সঙ্গে বাবুর্চি ও রান্নাবান্নার সরঞ্জাম নিয়েছেন তাঁরাও। ভাটা শুরু হয়েছে বিকাল ৫টার দিকে। কথা ছিলো আধা ভাটায় রওনা হবো। সেই অনুযায়ী ট্রলার ছাড়বো রাত ৮টার দিকে। বন উপকূলে চলাফেরা করতে হয় জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে।

রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে সরদার বললেন, কতোজনের রান্না করবো ভাই? বললাম, ট্রলারে যে কয়জন আছে তার সাথে ডাকাতদের সংথ্যাটা যোগ করতে হবে। কিন্তু আলমগীর বা মিলন কেউই তাদের সংখ্যা বলতে পারলেন না। বললাম, দস্যুদের সংখ্যা যাই থাকুক, তাদের সাথে সাধারণ জেলেরাও থাকে। সব মিলিয়ে লোকজন কম হয় না। আপনি ৩০ জনের রান্না চড়ান। এবার ট্রলারের পাশ ধরে হেঁটে আসলেন তিনি। হাতে ভাতের হাঁড়িটি দেখিয়ে বললেন, এই হাঁড়িতে ১২জনের ভাতও রান্না হবে না। ত্রিশ জনের ভাত রান্না করতে হবে তিন বারে। আলমগীরকে একটু বকা দিলাম। বললাম, ছোট হাঁড়ি নিয়েছেন কেন? উনি বললেন, ট্রলারের রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে আগে খেয়াল করেননি। বলেই বড় একটি হাঁড়ি আনিয়ে নেন। সেজন্য প্রায় ৪৫ মিনিট দেরি হয়ে গেলো আমাদের।

রাত নয়টায় ট্রলার ছাড়লাম। চুনা নদী ধরে যাচ্ছি পশ্চিমে। ডান পাশে লোকালয়, বাম পাশটা সুন্দরবন। জনপদ ঘেঁষা এই সুন্দরবন হলো বেঙ্গল টাইগারের বসতি। মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ট বাঘ তখন বেশ সংকটে। ২০০৯-২০১০ পর্যন্ত প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসতো বাঘ। এআ চুনা নদী পেরিয়েও বাঘ চলে আসতো লোকালয়ে। সারা রাত পায়চারি করতো। ছাগল-ভেড়া কিংবা কারও পোষা কুকুর ধরে আবার ঢুকে পড়তো জঙ্গলে। বাঘের ভয়ে সন্ধ্যা হলেই ঘরে উঠে পড়তো মানুষ। কিন্তু ২০১৫/১৬ সালে এসে বাঘের সেই উৎপাতও প্রায় নাই হয়ে গেছে। তার মানে এই না যে বাঘ বনের ভিতরে ভালো আছে। জেলেরা বলেন, এখন মাল-এ (সুন্দরবনের জঙ্গলটাকে মাল বলে) শুয়ে ঘুমানো যায়। বাঘের কড় (পায়ের ছাপ) দেখা যায় না। মনে হয় যেন বাঘই নাই জঙ্গলে।

ভাটার টান আর ইঞ্জিনের গতিতে দ্রুতবেগে ছুটছে ট্রলার। বাম পাশে সুন্দরবনে প্রবেশের বেশ কয়েক খাল আছে। তবে আমরা ঢুকবো মালঞ্চ নদী দিয়ে। সম্ভবত কাছাকাছি কোনো জায়জায় আছে বনদস্যুরা। মিলন ও আলমগীরের তৎপরতা দেষে মনে হচ্ছে মালঞ্চে উঠেই কোনো একটি খালের মধ্যে ঢুকতে হবে। দু’জন দেখলাম ওই জায়গাটি নিয়ে তর্কে নেমেছেন। মিলন বলছে ওরা ওমুক খালে যেতে বলেছে। আলমগীর বলভেন, ওই খালে আলমরা কিছুতেই থাকবে না। ততোক্ষণে মালঞ্চ নদীতে ঢুকে গেছি আমরা। বন বিভাগ বা অন্য কেউ আজকে বাঁধা দিলো না। নির্বিঘ্নে বনে ঢুকলাম। কিন্তু কোন খালে দস্যুদলের সাথে আমাদের দেখা হবে সেটি নিয়ে বড় খামেলায় পড়লাম। ফোনেও পাচ্ছি না ওদের।

ট্রলার চলছে দক্ষিণে। সামনে আমরা। পিছনে RAB। মিলন ও আলমগীর সম্ভবত একমত হয়েছে। দু’জনই গিয়ে দাঁড়িয়েছে গলুই-এ। যেতে যেতে বাম পাশের প্রতিটি খালের দিকে নজর রাখছি আমরা। কতোক্ষণ যাবো জানি না। শুধু এটুকু নিশ্চিত, ওরা যেখানে আছে সেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। যতোক্ষণ নেটওয়ার্ক ছেড়ে না যাবো ততোক্ষণ দস্যুদের ওদিক থেকে ইশারা আসবে না। মানে ওরা আছে ফোনের নেটওয়ার্কের বাইরে।

বার বার ফোনের দিকে নজর রাখছি। নেটওয়ার্ক শূৃণ্য হওয়ার পর গলুই-এ যাবো, ততোক্ষণ কেবিনের ভিতর একটু হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিবো। বিশ্রাম খুব প্রয়োজন। কারণ আগামী তিনদিন এই শরীরটির উপর একটানা ঝড় যাবে।

আধা ঘন্টা এক ভাবে চলছি। এরপর গতি কমলো ট্রলারের। বের হয়ে দেখি পালোকাটি খাল সামনে। মানে বনদস্যু মজনু বাহিনীকে যে খাল থেকে তুলেছিলাম সেখানেই আমরা। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্ক নাই। ওদিকে আলমগীর ও মিলন গলুই-এ দাঁড়িয়ে ইশারা দিচ্ছে। সুকানিতে বেলায়েত সরদার। তাঁর পাশে দাঁড়ানো ট্রলারের অন্যরা। পিছন পিছন আমাদের অনুরসণ করছে RAB-এর ট্রলার।

ডিঙ্গি নৌকাটি সাধারণ চোখে দেখা যায় না। একেবারে জঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়ানো। খুব ভালো করে তাকালে আবছা অবয়বটি নজরে আসে। জঙ্গলের মানুষেরা অবশ্য অনেক দূর থেকে এসব দেখতে পায়। মিলনরা এই নৌকাটি দেখেছে আগেই। তাই গতি কমিয়ে দুই পক্ষ্য একে অপরকে বুঝে নিলো। থামলো ট্রলার। পালোকাটি বা আশেপাশের কোনো খালে আছে আলম বাহিনী। পিছনের ট্রলারটিকে পাশে আসতে বললাম। তারপর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলাম। বড় নদীতে নোঙ্গর করে থাকবেন তাঁরা। যতোক্ষণ না ফিরছি, ততোক্ষণ এখানেই থাকবেন তাঁরা।

ট্রলার ঘুরিয়ে নৌকাটির দিকে এগুলাম। সাথে সাথে বৈঠা বেয়ে এগিয়ে আসলো তারা। ট্রলারের সাথে নৌকাটি বেঁধে উঠে পড়লো একজন। মিলনের সাথে হাত আর বুক মিলিয়ে ট্রলার ঘুরাতে বললো। একটু পিছনে ঢুকে গেছে পালোকাটি খাল। আমরা যাচ্ছি সেদিকেই।

ভাটা প্রায় শেষের দিকে। ওই খালের মুখে ঢুকলেও ভিতর পর্যন্ত যাওয়ার উপায় নাই। তাহলে কী করবো এখন? খাল ধরে ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। মিনিট দশ চলার পর ঠেকে গেলো ট্রলারের তলা। এখানে খাল একদম শুকিয়ে গেছে। কী করবো এখন? মিলন বললো, এখানে আটকে থাকলে তো বিপদ হতে পারে। জেলেরা এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে ফেলবে আমাদের। জানতে চাইলাম, আশেপাশে আর কোনো দস্যুদল থাকে? বললো, জোনাব আর আলিফ ঘুরে বেড়ায় এদিকে। বিশেষ করে রাতের বেলায় তারা চলাফেরা করে। তবে শেষ ভাটায় সেই ঝুঁকি কম। যদিও ডিঙ্গি নৌকায় দস্যুদের চলা ফেরা আটকে রাখা যায় না। যেখানে পানি কম থাকে সেখানে কাঁদার ওপর দিয়ে ঠেলে নেয় নৌকা। গন্তব্য তাদের পৌঁছাতেই হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।

আলমগীর ভাই এবার মুখ খুললেন। বললেন, ওই জোনাব আসুক বা আলিফ, দেখবোনে। এখানে এসে ঝামেলা করার সাহস পাবে না। বললাম, জোনাব কিন্তু আলমের ওপর গরম হয়ে আছে। কয়দিন আগেই তো গুলি করে ওদের বারোটা বাজালো আলম বাহিনী। পাশে এসে ফিসফিস করে মিলন বললো, ওই গোলাগুলিতে জোনাব আহত হয়েছে। গুলির স্প্লিন্টার লাগছে কপালে। ও আহত। আসবে না এদিকে। এছাড়া আলিফ আছে মামদো নদীর নিচের দিকে। খাশিটানা থেকে নটাবেঁকীর মধ্যে কোনো খালে। এদিকে আসবে না সে।

মিলনের আসল নাম মেহেদী হাসান। কিন্তু জঙ্গলে পরিচিতি পাটোয়ারী নামে। একসময় মিলন পাটোয়ারী নাম শুনলে বুক কেঁপে উঠতো জেলেদের। সে নাকী ভীষণ মারপিট করতো। প্রথমে নিজেরা দস্যুতা করে। তারপর কখনও মোতালেব, কখনও মজনু, কখনও আলিফ বাহিনীর সাথেও দস্যুতা করেছে। জেলেদের অপহরণ করা, দাবড়ে ধরা, অন্য দলের সাথে বন্দুকযুদ্ধ করায় বেশ পারদর্শী ছিলো সে। তার গল্পে পরে আসছি। আগে যে দস্যুদলকে নিতে এসেছি তাদের সাথে দেখা করতে হবে। দেরি দেখে ওরা ভয় পেতে পারে। এসময় কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। ৮ সেপ্টেম্বর সকালের মধ্যে আলম ও শান্ত বাহিনীকে নিয়ে সারেন্ডার অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। আলমগীর ও মিলনকে বললাম, আলম সরদারের কাছে যাবো। অথবা ওদের এখানে আনেন।

টুপ করে নেমে পড়লো মিলন। নৌকার দুইজনকে বললো, নিচে নামো, নৌকা ঠেলো। বলতেই দুইজন নেমে পড়লো কোমড় সমান কাঁদা পানিতে। কাঁদার ওপর দিয়ে এগিয়ে চললো নৌকা। অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো তারা। দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ভাটায় আটকা পড়া ট্রলারে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। সহযাত্রীরা সবাই ঘুম। এসময় পাশে এসে দাঁড়ালেন বেলায়েত সরদার। বললেন, রান্না কি শুরু করবো ভাই? বললাম, আগে দস্যুরা কয়জন আছে দেখি। সরদার বললেন, কী সব ডাকাত দল এগুলো। ২০/৩০ জন মানুষকে একসাথে রান্না করে খাওয়াতে পারে না। আমরা মেহমান। কিন্তু রান্নাবান্না আমাদেরই করতে হয়। সরদারকে বললাম, ওদের টাকা দিয়ে কেনা খাবার খাওয়া ঠিক হবে?

(ছবি: বনদস্যুদের অপেক্ষায় পশ্চিম সুন্দরবনে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top