অন্ধকার খাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১৯৭ | Rupantorer Golpo 197 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৯৭ : বেলায়েত সরদারের হাঁকডাকে পুরো ট্রলার এখন সরগরম। রান্নার আয়োজন চলছে। তাঁকে সহযোগিতা করছেন ট্রলারের সহযোগীরা। সত্যি কথা বলতে আর কারও সহযোগিতার প্রয়োজন নাই। কিন্তু কাউকে ঘুমাতে দিবেন না তিনি। চিৎকার করে নাম ধরে ধরে ডাকছেন। মানে কাউকে ঘুমাতে দিবেন না।
কী রান্না করবেন আজ? সরদারকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা। বললাম, এই পদ কয়টা রান্না করতে এতো লোকজন লাগবে? সবাইকে ডেকে তুলছেন কেন? সরদার বললেন, কেবল জঙ্গলে ঢুকলাম। এখনই ঘুম? বলেই সেই হাসি হাসতে থাকলেন। বললাম, ঠিকই তো! আমরা জেগে থাকবো, আর তারা ঘুমাবে, তা হবে না। এরপর দু’জন মিলে ট্রলারের কেবিনে কেবিনে হানা দিলাম। সবাইকে তুললাম। চোখ ডলতে ডলতে আমার সহকর্মীরা জড়ো হলেন ট্রলারের ছাদে।
বেশ মজা করছি আমরা। তবে সতর্কও আছি। কারণ ছোট্ট খালে কাঁদার উপর আটকে আছে ট্রলার। দুই দিকেই গভীর জঙ্গল। বাঘের হামলার শংকা আছে। গাছ থেকে ট্রলারে উঠে পড়তে পারে বিষধর কোনো সাপ। পর্যাপ্ত আলো জ্বালিয়ে রাখা উচিৎ। কিন্তু আলো জ্বাললে দূর থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। অন্ধকারেই বসে রইলাম। নৌকাটির ফিরে আসার অপেক্ষা করছি। ঘুম থেকে ওঠা সহকর্মীরা চা খাবেন। সরদার বললেন, ঘুম থেকে তুলে তো দেখি কাজ বাড়ালাম। বললাম, চা তো আমারও খাওয়া দরকার। বলতেই সবাই মিলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। সরদার গেলেন রান্নাঘরে। চুলায় উঠলো গরম পানি।
ভাদ্র মাস চলে। ভীষণ গরম। হাল্কা বাতাস পাবো বড় নদীতে। কিন্তু ছোট্ট এই খালে তার ছিঁটেফোঁটাও ঢুকছে না। দরদর করে ঘামছি বসে। মিলনদের ফিরে না আসা পর্যন্ত চরম উৎকণ্ঠাও কাটছে না। আলম সরদারদের সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কাটবে না সেই দুশ্চিন্তা।
ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার আসলো। ধীরে ধীরে বাড়ছে পানি। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কান ঝালাপালা। বন্যপ্রাণিদের মধ্যে শুধু দূর থেকে হরিণের ডাক শুনছি। প্যাঁচা, কুকু পাখিসহ নিশাচর পাখিরা ডাকাডাকি করছে। অমাবশ্যার গোন চলে। চাঁদ না থাকায় অন্ধকারটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। রাত বাড়ছে। ওদিকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় উৎকণ্ঠাও বাড়ছে। ফিসফিস করে আলমগীর ভাইকে বললাম, ওদিকে কোনো খবর পাচ্ছি না যে! উনি বললেন, টেনশন করেন না ভাই। ওরা আছে। এই খাল ধরে অনেক দীর যাওয়া যায়। ভিতরে অনেকগুলো সরু খাল আছে। হয়তো ভাটায় আটকে আছে তারাও। এক পোয়া জোয়ার হলেই দেখবেন চলে আসবে ওরা।
ওক পোয়া জোয়ারের জন্য অপেক্ষায়। সময় কাটছেই না। কখনও রান্নাঘরে যাচ্ছি, ফিরে আবার গলুই-এ এসে বসছি। মনের ভিতরটা ছটফট করছে। কিন্তু সহযাত্রীদের সামনে আমি নির্লিপ্ত। দুশ্চিন্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মানুষ আমি না। এতে কোনো সুবিধা নাই। বরং অসুবিধা বাড়তে পারে। সবাই মানষিক চাপ নিতেও পারে না। আলমগীর ভাই বললেন, ভিতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেন। সেখানে ব্যাটারিচালিত একটি ফ্যান আছে। বললাম, ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবো।
অনেক দূর থেকে ভেসে আসলো কুকু পাখির ডাক। তারপর একই রকম শব্দে ডেকে উঠলো বেশ কয়েকটি কুকু পাখি। অদ্ভুত ভাবে এরা জোয়ার ভাটার হিসাবটা বুঝতে পারে। ডাক দেয় প্রতি দেড় ঘন্টা অন্তর অন্তর। বেশ ভৌতিক লাগে সে শব্দ। রাতের বেলা হঠাৎ করে এই ডাক শুনলে নতুন যে কেউ ভড়কে যেতে পারেন। অবশ্য আমরা এই ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। মানে জোয়ার এক পোয়া অর্থাৎ দেড় ঘন্টা হয়ে গেছে। খালের ভিতরে পানি চলে এসেছে। ট্রলার ভাসতে আধা জোয়ার হতেই হবে। তবে এই পানিতে চলবে ডিঙ্গি নৌকা।
আরও আধা ঘন্টা পার হলো। খালের ভিতর থেকে কথাবার্তার শব্দ পাচ্ছি। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে আসছে নৌকা। বৈঠা বাওয়ার শব্দের সাথে সাথে ওদের কথাবার্তার শব্দও ভেসে আসছে। একটু পর পর কে যেন গান গাইছে দরাজ গলায়। বারী সিদ্দিকীর গান- আমার গায়ে যদো দুঃখ সয়… গান গাচ্ছে কে? আলমগীর ভাই বললেন, ও আমাদের মিলন। ভালো গান গায়।
একটি না। চার/পাঁচটি নৌকা আসছে। মানে বনদস্যু আলম বাহিনীর নৌকা বহর। সামনের নৌকায় বসা মিলন পাটোয়ারী। মিনিট খানেকের মধ্যে ট্রলারের চারপাশে ভিড়লো নৌকাগুলো। লেকজন সংখ্যায় কম না। তবে সবার হাতে অস্ত্র নাই।
ট্রলার থেকে নেমে গেলাম নৌকায়। পরিচয় হলো আলম সরদারের সাথে। বললাম, পটুয়াখালীর সেই অস্ত্রগুলো না ধরালে তো সারেন্ডার করতেন না। দস্যুনেতা বেশ লজ্জা পেলেন। বললেন, যা হইছে ভালোই হইছে ভাই। একটু লোভ করিলাম। আপনি সেটা নষ্ট করে দিলেন। অবশ্য তাতে আমার আফসোস নাই। এই পাপের জীবন থেকে মুক্তি পেলেই খুশি।
ও বেলায়েত ভাই, মেহমান আসছে, চা খাওয়াবেন না? বলতেই রান্নাঘর থেকে উঠে আসলেন সরদার। বললেন, চা তো খাওয়াবো। কিন্তু তার আগে এদের একটু শাস্তি দিলে হয় না? বললাম, বন্দুকধারী এই লোকজনদের শাস্তি দিবেন?
বেলায়েত সরদার বললেন, এই যে কয়েক ঘন্টা টেনশনে রাখলো, তার শাস্তি হবে না? বললাম, কী শাস্তি দেওয়া যায়? পাশ থেকে অচেনা একজন বললো, শাস্তি হিসাবে তাকে শিকারে পাঠানো যায়। একটা হরিণ মেরে আনতে হবে রাতের মধ্যেই। আমি বলার আগেই আলম সরদার বললেন, হরিণ মারতে দিবেন না বলেই একটা ছাগল কিনে আনছি ভাই। বলেই নৌকায় বেঁধে রাথা ছাগলটির দিকে টর্চ মারলেন। টর্চ বলতে বড় কিছু না। ম্যাচ লাইটারের পিছনে থাকা ছোট্ট এলইডি বাতি।