রূপান্তরের গল্প ১৯৮ | Rupantorer Golpo 198

জলদস্যুরা দেখতে কেমন? | রূপান্তরের গল্প ১৯৮

জলদস্যুরা দেখতে কেমন? | রূপান্তরের গল্প ১৯৮ | Rupantorer Golpo 198 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৯৮ :ডাকাত দেখতে কেমন হয়? জলদস্যুদের চেহারা আর বেশভূষা আমরা কল্পনায় কেমন দেখি? আর যদি বলি বনদস্যু, তাও আবার যদি হয় সুন্দরবনের দস্যু, তবে তারা দেখতে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর? পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়ান কিংবা বিদেশি সিনেমায় যেমন দেখি, জলদস্যু বলতে কল্পনায় তেমন কিছুই আসে। আগে ভাবতাম, জঙ্গলের দস্যুরা দেখতে হবে ভয়ঙ্কর, থাকবে বিরাপ্পনের মতো লম্বা মোচ।

জেলেদের মুখে বনদস্যুদের অনেক অত্যাচারের কথা জেনেছি। শুনি রক্তপাতের কাহিনীও। সেই সব ভয়ঙ্কর মানুষরা দেখতে ভয়ঙ্করই হওয়ার কথা। তবে দস্যুনেতা আলম সরদারকে দেখে রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম। হাতে বন্দুকটি না থাকলে তাকে বনদস্যু বলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। আলমের পাশে বসা আরেক তরুণ, হালিম। সঙ্গে অন্য যারা আছে তাদের বড় অংশই এসেছিলো সাগরে দস্যুতা করতে। কিন্তু আলমের সাগরে কোপ দেওয়ার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ওরা ভেবেছিলো সাগরে একটা বড় কোপ দিয়ে সারেন্ডার করে ফেলবে। কিন্তু সেটা করতে দেইনি আমিই। তাই কয়েকটি অস্ত্র আর মাত্র চারজন দস্যু উঠবে এ দফায়। মানে আত্মসমর্পণ করবে মাত্র চারজন!

ভিতরটা খচখচ করছে। মাত্র চারজন? মানুষ কী বলবে? এবিষয়ে মেজর আদনানের সাথে আগেও কথা হয়েছে। সুন্দরবনের ছোট ছোট দস্যুদলগুলো এমনই। ছয়/সাতজনের ছোট্ট দল ঘুরে বেড়ায় সুন্দরবনে। সারাদিন সরু কোনো খালের আগায় চুপচাপ বসে থাকে। সন্ধ্যার পর বের হয়। দস্যুতা করার জন্য তাদের কাছে বন্দুক থাকে। কিন্তু জেলেদের ভয় দেখানোর জন্য তারা ব্যবহার করে শক্তিশালী টর্চ লাইট।

রাতের বেলা বড় টর্চ জ্বলতে দেখলেই জেলেদের ভিতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায়। হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। তারপর সেই আলো জ্বালিয়ে রেখেই জেলেদের নৌকার কাছে গিয়ে ভিড়ে বনদস্যুরা। সাথে সাথে একজন বা দুইজন দস্যু নেমে পড়ে জেলেদের নৌকায়। এমাথা ওমাথা উল্টে পাল্টে দেখে। মোবাইল ফোন থাকলে তা নিয়ে নেয়। নগদ টাকা থাকলে কেড়ে নেয়। এছাড়া মাছ-কাঁকড়া বেশি থাকলে সেগুলো নিজেদের নৌকায় উঠিয়ে নেয়।

এরপর জিজ্ঞেস করা হয় কার জেলে? মানে মহাজন কে? আগাম চাঁদা দেওয়া থাকলে ভালো। না থাকলে প্রতিটি নৌকা থেকে একজন করে জেলে অপরহরণ করে তারা। নৌকাগুলো ছেড়ে দেয়। এরপর মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি হয়। মুক্তিপণের পরিমান পঞ্চাশ হাজার থেকে তিন লাখ পর্যন্ত হয়। এই টাকা জেলেদেরই জোগাড় করতে হয়। কিন্তু মাছ ধরতে নামার সময় যাদের পকেটে দুই হাজার টাকাও থাকে না তারা এতো টাকা কোত্থেকে পাবে? তখনই ত্রাণকর্তা হিসাবে সামনে এসে দাঁড়ান মহাজন।

সহযোগিতার নামে মুক্তিপণের টাকাটা তিনিই দেন। কখনও দর কষাকষি করে এক লাখ টাকার জায়গায় দস্যুদের কিছু কম দেন তাঁরা। সম্পর্কের খাতিরে কখনও অর্ধেক টাকাতেও দফারাফা হয়। কিন্তু ওই জেলে পরিবারকে বলা হয় মুক্তিপণ দস্যুদের চাহিদা মতো দেওয়া হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে উপকার মনে হয়। কিন্তু ঘটনা যেটি ঘটে তা হলো, এর পর থেকে ওই জেলে আটকা পড়েন মহাজনের জালে।

দিনের পর দিন মাছ-কাঁকড়া ধরে সেই মহাজনের কাছেই দিতে হয়। মহাজন সাহেব নিজের মতো করে দাম কাটেন। মহাজনের সেই ঋণ সারা জীবনে শোধ হয় না। এভাবে জেলে, মহাজন আর বনদস্যুদের মধ্যকার এই সম্পর্ক জারি থাকে। যে সম্পর্কের দায় শোধ করেন শুধু জেলেরা।

আলম বাহিনী এই মুহুর্তে ছোট্ট একটি দস্যুদল। কিন্তু বড় হতে কতোক্ষণ? পটুয়াখালীর সেই অস্ত্রের চালানটি হাতে আসলে এই বাহিনী পরিণহ হতো মাঝারি দস্যুদলে। তারপর সাগরে একটি কোপ দিলেই আলম বাহিনী হয়ে যেতো বড় দস্যুদল। ২৫/৩০টি অস্ত্র আর পর্যাপ্ত গুলি থাকলে সুন্দরবন দাপিয়া বেড়ানো যায়। অবশ্য দল বড় করতে ব্যর্থ হলেও দস্যুনেতা আলমের মধ্যে আফসোস নাই। স্ত্রী সন্তানদের কাছে ফিরে যাওয়ার এই সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না।

জোয়ারের পানি বাড়ছে। রাত দুইটা নাগাদ ভাসলো ট্রলার। এরপর পুরো বহর নিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম পালোকাটি খালের ভিতর। ধীর গতিতে ট্রলার চালিয়ে যতোটা সম্ভব দূরে চলে গেলাম। তারপর একটি দোয়ায় (কয়েকটি খালের মোহনা) নোঙ্গর করলাম। ততোক্ষণে রান্নাবান্না শেষ। বেশ ক্ষুধার্ত সবাই। কিন্তু সমস্যা হলো রান্না যা করা হয়েছে তার চেয়ে মানুষ বেশি। আলম বাহিনীর বহরে এতো মানুষ থাকবে বুঝতে পারিনি। আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া দস্যু মাত্র চারজন হলেও আরও কয়েকজন চিহ্নিত বনদস্যু ছিলো সেখানে। তারা সারেন্ডার করবে না। ওই দোয়ায় কয়েকটি জেলে নৌকাও ছিলো। এরা সবাই দস্যুদের সহযোগী।

স্টিলের প্লেটে ভাত-ডাল আর আলু ভর্তা নিয়ে আসলেন বেলায়েত সরদার। বললাম, শুধু আমাকে খাবার দিলে হবে? এতোগুলো মানুষকে খাওয়াবেন কী করে? উনি বললেন, যতোক্ষণ চামচ আর খোন্তা আমার হাতে, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। চামচের বাড়ি এমন ভাবে মারবো যে সবাই খাওয়ার পরও কিছু ভাত বেঁচে যাবে। আপনি খান। কী আর করা! প্লেট হাতে নিয়ে বসে পড়লাম। পাশে আমার আলম সরদার বসা। হালিম, বাক্কারসহ অন্যরাও বসে পড়লো পাশে।

প্রথমে পরিকল্পনা ছিলো ৬ সেপ্টেম্বর রাতে আলম বাহিনীর কাছে আসবো আমরা। কিন্তু আরও একদিন হাতে রেখে বনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আলমকে আমি দেখিনি। সামনাসামনি কথা হয়নি। এমনও তো হতে পারে যে তার মালিকানায় আরও কিছু অস্ত্র-গুলি আছে!

অতীতের দস্যুদের আত্মসমর্পণের আগে তাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো বের করেছিলাম আমরা। সেজন্য কিছু সময় দরকার। সেই হিসাবে একদিন আগে আসা। অবশ্য এখানে এসে বুঝলাম যে আলম সরদারের কাছে বেশি বন্দুক নাই। থাকলে অন্তত এখানকার অন্য দস্যুরা খালি হাতে থাকতো না। এছাড়া দস্যুনেতাকে সামনা সামনি দেখে মোটামুটি নিশ্চিত, এদের কাছে লুকানো অস্ত্র নাই। খাওয়া দাওয়া শেষে লম্বা আড্ডায় বসলাম।

অনেক কিছু জানার আছে এদের কাছে। পশ্চিম সুন্দরবনের বড় বড় দস্যুদল কী করে গড়ে ওঠে? কারা এদের অস্ত্র-গুলি দেয়? কারা বাজার সদা পৌঁছে দেয়? কারা এদের হয়ে চাঁদা ও মুক্তিপণের টাকা তোলে? কারাই বা জঙ্গলে তাদের মিত্র? অনেক কিছু জানতে পারছি গল্পে গল্পে।

ছবি: আমার পিছনে দস্যুনেতা আলম সরদার ও সদস্য হালিম। পশ্চিম সুন্দরবন। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top