রূপান্তরের গল্প ১৯৯ | Rupantorer Golpo 199

গহীন খালে তখন বন্যা জোয়ার, আলম বাহিনীর ডেরায় | রূপান্তরের গল্প ১৯৯

গহীন খালে তখন বন্যা জোয়ার, আলম বাহিনীর ডেরায় | রূপান্তরের গল্প ১৯৯ | Rupantorer Golpo 199 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৯৯ : তীব্র স্রোত। চারপাশ থেকে নামছে পানি। ভাটা লেগেছে আধা ঘন্টা হলো। শেষ জোয়ারে কিছুক্ষণ স্থির থেকে পানি উল্টো দিকে বইছে। জঙ্গল থেকে পানির এই নেমে ছোট খালগুলোকে চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। প্রতিটি গাছের গোঁড়া দিয়ে, ছোট গাছগুলোর ওপর দিয়ে নামার সময় সরসর করে শব্দ হয়, কলকল করে শব্দ হয়। অমাবশ্যার গোন বলে কথা। দিনের জোয়ারে পানির চাপ থাকে সবচেয়ে বেশি।

এই সময়কে এদিকের জেলেরা বলেন জোগা’র গোন। ভরা জোয়ারকে বলেন, বন্যা জোয়ার। পানি উঠে পড়ে জঙ্গলের ভিতরে। সাতক্ষীরা সুন্দরবনের পালোকাটি খালের মাথার দিকে বসে আছি আমরা। দস্যু দল আলম বাহিনীর সদস্যরা সাথেই আছে। কতোগুলো নৌকা একটার সাথে আরেকটা বাঁধা। সারা রাত একসাথে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আমি দেখছি এই জঙ্গলের ভয়ঙ্কর মানুষদের রূপান্তরের দৃশ্য।

দস্যুরা বলছে, গোন-এর সময় জালে মাছ পড়ে বেশি। জেলেরা থাকে মহাখুশি। বললাম, এই সময়ে আপনারা হাজির হন তাদের সামনে। তখন সেই খুশি কোথায় যায়? পাশের নৌকা থেকে এক জেলে বললো, তখন মাছের খুশি উল্টো দিকে যায়, কান্না হয়ে যায়। মাছ তো এরা নেয়ই, সাথে ডিউটির টাকা নেয়। চাঁদার টাকাও দিতে হয়। আর টোকেন না থাকলে মুক্তিপণ না দিয়ে যাওয়ার উপায় নাই।

আলম সরদার বললেন, তোমাদের কাছ থেকে না নিলে আমরা চলবো কী করে? ডাঙ্গায় তো উঠতে পারি না। জেলেদের বললাম, এই দস্যুদেরকে আমরা উঠায়ে নিয়ে যাচ্ছি। জেলে ভাই বললেন, লাভ হবে না। এই জঙ্গলে যতোদিন গাছ থাকবে, যতোদিন গাছের একটা পাতাও থাকবে, ততোদিন ডাকাত থাকবে। একটু শ্লেষসহ বললেন, কয়টা পার্টি (দস্যুদল) উঠাবেন আপনারা? এরা যাবে, এখানে আরেক পার্টি আসবে। আমাদের জীবন এমনই থাকবে। আপনারা এসব করে পুরস্কার পাবেন। তারপর বাড়িতে ফিরে যাবেন, এসি রুমে বসে অফিস করবেন। তখন আমাদের দেখার কেউ থাকবে না। বললাম, হয়তো ভবিষ্যতে এভাবে আসবো না। আবার আসতেও পারি। তাই বলে চেষ্টা করবো না?

কথা টেনে নিয়ে আলম সরদার বললেন, এই লোককর তোমরা চিনো? ৭/৮ বছর ধরে সুন্দরবনে আসে এই লোক। আমাদের জঙ্গল থেকে উঠানোর জন্য একাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তোমরা তাকে চিনো না বলে এসব কথা বলছো। কথোপকথন চলতে থাকলো। কয়েকটি নৌকা একসাথে বাঁধা। তার উপর বসা বনদস্যুরা, জেলেরা আর আমি। চোখের সামনে এই বদলে যাওয়াটা দেখছি।

পাশের নৌকার কয়েকজন জেলে ততোক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছে। তারা বললো, সারেন্ডার যদি চালায়ে রাখতে পারেন, তাহলে কাজ হলেও হতে পারে। কথাগুলো মন দিয়ে শুনলাম।

সত্যিই তো। আমাদের কাছে তাদের প্রত্যাশা এরচেয়ে বেশি হওয়ার কোনো কারণ নাই। আসলে তাদের নিয়ে আমরা কি ভাবি? কাজ করি? আসলেই তো! এই জেলেদের ওপর দুনিয়ার সব চাপ। জীবনের ঝুঁকি প্রতি পদে। কষ্টের কোনো সীমা নাই। বাঘ-কুমির আর বৈরী জঙ্গল-সাগরের সাথে লড়াই করা এই জীবনগুলো নেহায়েত অবহেলায় পড়ে থাকে।

জঙ্গল ঘেঁষা মানুষদের জীবন পুরোটাই কষ্ট, ঝুঁকি আর বঞ্চনায় ঠাসা। তবুও কতো সুন্দর করে হাসতে জানে তারা। এই হাসিই আমাকে তৃপ্তি দেয়, শক্তি যোগায়। জেলেরা এখনও বিশ্বাস করছে না আমাকে। তবে একদিন ওরা বুঝবে। বেঁচে থাকলে হয়তো সেই দিনটি আসবে। সবকিছু পরিকল্পনা মতো চললে সেই দিন আসলেও আসতে পারে। আমি আশাবাদী মানুষ।

মাথায় “বন্যা জোয়ার” কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। জেলেরা প্রায়ই বলে কথাটি। জাল ফেলা ও উঠানোর সাথে এই সময়টির কথা বলা হয়। অমাবশ্যা আর পূর্ণিমায় ভরা জোয়ার হয়, এসময় জঙ্গলের ভিতর পর্যন্ত পানি উঠে পড়ে। তখন বনের প্রাণিগুলো কই থাকে? এবার এক মুরুব্বী জেলে এগিয়ে এলেন। বললেন, জঙ্গলের সব প্রাণিই শুকনা জায়গা খোঁজে। জোয়ার আসলে হরিণগুলো চাপতে থাকে ভিতরের দিকে। আবার বাঘেরাও খোঁজে উঁচু বাদা।

প্রবীন এই জেলে বললেন, এই সুন্দরবনে জায়গায় জায়গায় চটক আছে। বললাম, সেটা আবার কী চাচা? উনি বললেন, বনের ভিতরে জায়গায় জায়গায় গাছ থাকে ছাড়া ছাড়া, ঝোপঝাড় থাকে না। মাটি থাকে উঁচু। বন্যা জোয়ারে পানি উঠে গেলেও সেই জায়গাটি পরিস্কার থাকে। চারপাশ দেখা যায়। তাই বনের প্রাণিরা ওখানে গিয়ে দাঁড়ায়। বাঘ, হরিণ, বন্য শুকরেরা একসাথে থাকে? চাচা বললেন, এই জঙ্গলকে কি বাড়ির বাগান মনে হয়? এর নাম “বাদা”। মানে বাধায় ভরা এই জঙ্গল। এখানে কেউ কাউকে খুঁজে পায় না। এতো বড় জঙ্গলে তাদের থাকার জায়গার অভাবও হয় না।

আরেকটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে গত কয়েক মাস ধরে। রাজু বাহিনী, জুলফিকার, শহীদুল, ইলিয়াস, নোয়া মিয়া ও মাস্টার বাহিনীকে দেখেছি ট্রলার নিয়ে চলাফেলা করতে। কিন্তু এই অঞ্চলের ডাকাত দলগুলো নৌকা নিয়ে ঘোরে কেন? নৌকাতেই থাকে কেন?

দস্যুনেতা আলমকে সরদারকে জিজ্ঞেস করলাম, পূর্ব ও মধ্য সুন্দরবনের দস্যুদের মতো উনারা কেন ট্রলার ব্যবহার করে না? বললেন, ট্রলার নিয়ে চলাফেরা করা এদিকে বেশ ঝুঁকির। প্রথমত এগুলো জোগাড় করতে হয়। এক একটি ট্রলার তৈরি করতে অনেক টাকাও খরচ হয়ে যায়। আবার একবার প্রশাসনের সামনে পড়লে সেই সম্পদ রেখে পালাতে হয়। পুরোটাই গচ্চা যায়। নতুন করে গড়তে হয়।

আলম সরদার বলছেন, ট্রলার তো শব্দ ছাড়া চলে না। দূর থেকে শোনা যায় ইঞ্জিনের শব্দ। এসব নিয়ে ছোট খালে ঢোকা যায় না। ট্রলার নিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে।

পাশ থেকে আরেক দস্যু হালিম বললো, আরও বিষয় আছে ভাই। ইঞ্জিন চালিয়ে চলাফেরা করলে জেলেদের খুঁজে পাওয়া যাবে? আমরা তো চলি চোরের মতো, শব্দ ছাড়া। নৌকা নিয়ে চুপ চাপ ঘুরি। ছোট ছোট খাল আর ভাড়ানীর ভিতর থেকে জেলেদের ধরে আনি। কখনও উঠে যাই খালের একদম আগায়। ট্রলারে চলাফেলা করলে এই জেলেদের একটাকেও খুঁজে পাবো না। একটা জেলেও অপহরণ করতে পারবো না। আর জেলেদের ধরতে না পারলে খাবো কী? চলবো কী করে?

ছোট হোক বা বড়, একটা ডাকাত দল পরিচালনা করা অনেক খরচের ব্যাপার। হালিম বলছে, নৌকা নিয়ে প্রশাসনের মুখোমুখি হলেও অনেক সময় ওরা বুঝতে পারে না। জেলেদের মতো করে থাকি। ওরা ভাবে আমরা জেলে। ট্রলার নিয়ে চললে তো প্রথমেই সন্দেহ করবে। আর নৌকা নিয়ে কখনও যদি সামনাসামনি হয়েও পড়ি, তখন আস্তে করে পাশের খালে ঢুকে পড়ি। সেই সুযোগ না থাকলে নেমে হাঁটা দেই, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ি। এই সুন্দরবনে একবার পায়ের নিচে মাটি পেলে আমাদের আর পায় কে? প্রশাসন কী আর জঙ্গলে নেমে খুঁজবে আমাদের? তখন শুধু নৌকাটা ধরে নিয়ে যায়। আমরা জঙ্গলের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে অন্য জেলেদের ধরি। তাদের নৌকা নিয়ে নেই। বিনিময়ে নৌকার দাম দিয়ে দেই। পাশ থেকে এক জেলে বললো, কই তোমরা নৌকার দাম দাও?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top