রূপান্তরের গল্প ২০০ | Rupantorer Golpo 200

ডাকাত উঠলো RAB-এর ট্রলারে | রূপান্তরের গল্প ২০০

ডাকাত উঠলো RAB-এর ট্রলারে | রূপান্তরের গল্প ২০০ | Rupantorer Golpo 200 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২০০ : সন্ধ্যা নামার আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেই। তারপর নৌকা বেয়ে সরু কোনো খালের আগায় চলে যাই। বলতে পারেন ডাঙ্গার উপর নৌকা উঠিয়ে বসে থাকি। কোনো আলো জ্বালাই না। কথা বলি ফিসফিস করে। গল্পে গল্পে একজন জেলে ভাই বলছিলেন কথাগুলো। বললাম, তাহলে রাতের খাবার? হেসে ফেললো সবাই। একজন বলল, রাতের খাবার? জঙ্গলে আসলে সকালে আর বিকালে ভাত খেতে পারলেই খুশি আমরা। রাতের খাবার খাওয়া হয় না। সন্ধ্যার পর চুলা জ্বালাই না, আলো জ্বালাই না ডাকাতের ভয়ে। চোর-ডাকাতেরা সব রাতের বেলা বের হয়। দূর থেকে আলো দেখে টার্গেট করে জেলেদের।

দস্যুদের দিকে তাকালাম। ওরা বললো, রাতে তো আমরাও খেতে পারি না। ডাকাতদের কাজই তো রাতের বেলা। ঘুরে বেড়াই কিন্তু আলো জ্বালাই না একদম। তাহলে আমাদের দেখে জেলেরাও পালিয়ে যাবে। তখন ধরবো কাকে? বলতে বলতে বাক্কার নামে এক দস্যু বললো, আমাদের অবস্থা বাঘের মতো। গায়ে অনেক শক্তি। কিন্তু আমাদের দেখে কেউ দাঁড়ায় না। বাগের যেমন শিকার ধরতে অনেক কষ্ট হয়, আমাদেরও জেলে ধরতে মেলা কষ্ট হয়। পশ্চিমের খাল পালোকাটিতে বসে আড্ডা দিচ্ছি সেই রাত থেকে। সহকর্মীরা সবাই ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু আমার ঘুম আসে না।

দস্যুনেতা বললেন, আমার মনে এতো প্রশ্ন কেন? বললাম, এতো বড় জঙ্গল জীবন সম্পর্কে সবকিছু কি জানা যায়? কতো কিছুই তো অজানা এখনও! আলম সরদার বললেন, সুন্দরবনের ডাকাতদের তো কম দেখেনি। এতো বছর ধরে সুন্দরবনের ডাকাতদের সাথেই চলাফেলা আপনার। তবুও জানা শেষ হয়নি?

আলম বলছেন, আমাদের লিডার ছিলো, ক্রসফায়ারে মারা গেলো, মোতালেবের সাথেও তো দেখতাম কথা বলতেন আপনি। এরপর মজনুকে তো সারেন্ডারই করালেন। আলিফ, জোনাব, মান্নানের সাথেও কথা হতো আপনার। তারপরও পশ্চিম বাদা (বন) নিয়ে অনেক কিছুই জানেন না দেখি! বললাম, এই কয় বছরে এতো বড় জঙ্গলের কতো কিছু জানা যায়? আরেকটা বিষয়ে জানতে চাইলাম। পূর্বের জলদস্যুরা ইঞ্জজিনচালিত শক্তিশালী ট্রলার ব্যবহার করে। আপনারা পশ্চিমের দস্যুরা কেন নৌকা বেয়ে ডাকাতি করেন?

দস্যুনেতা বললেন, পূর্ব সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা বৈধ, সেখানে খোলামেলা মাছ ধরে জেলেরা। ওদিকে ট্রলার চালানোর অনুমতিও আছে। আবার সাগরের ট্রলারগুলো ওই পাশ দিয়ে চলাফেরা করে। ওদিকে ডাকাতরা ট্রলার নিয়ে ঘুরলেও কেউ সন্দেহ করে না।

এদিকে পশ্চিম বাদায়, মানে খুলনার শিবসা নদীর পশ্চিম থেকে রায়মঙ্গল পর্যন্ত বেশির ভাগ এলাকাই অভয়ারণ্য। মানে ওদিকে মাছ ধরা নিষেধ। জেলেরা চুরি করে মাছ ধরে এই এলাকায়। এছাড়া যেটুকু জায়গায় নিয়ম আছে সেখানেও ট্রলার নিয়ে ঢোকা নিষেধ। মানে এদিকের সুন্দরবনের ভিতরের খাল-নদীতে বন বিভাগ ছাড়া আর কেউ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ব্যবহার করে না। এখন আমরা যদি ট্রলারে চলি তাহলে সেই শব্দ শুনলে যে কেউ সন্দেহ করবে। জেলেরা পালিয়ে যাবে। আর প্রশাসন এগিয়ে আসবে আমাদের ধরার জন্য।

মাথাটা ঘুরে ওঠে। এতো কিছু মাথায় রাখা যায়? কিন্তু সুন্দরবনটাকে আমার বুঝতে হবে। তা না হলে এই বন থেকে দস্যুতার অবসান ঘটানোর চেষ্টা সফল হবে না। এতো দূর এসে আমি ব্যর্থও হতে চাই না। কারণ এই দফায় ব্যর্থ হলে পুরো আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে আমার কিছুই হবে না। কিন্তু এই অঞ্চলে এরপর যা হবে তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকবে না কারও। এই গহীন জলা-জঙ্গলে এসে অপরাধীদের আটক করা প্রায় অসম্ভব। এই ফেরারি মানুষগুলোকে বাড়িতে ফিরতে না দিলে আগুন জ্বলবে জঙ্গলে। যার প্রভাব পুরোটাই পড়বে নিরীহ জেলেদের ওপর।

গল্পে গল্পে ভোর হলো। সূর্য উঠছে, তবে তার আগেই আলোকিত চারপাশ। আলম সরদারকে বললাম, চলেন মালঞ্চ নদী থেকে ঘুরে আসি। ওরা আঁৎকে উঠলো। হালিম বললো, RAB সদস্যরা আছে না ওখানে? বললাম, চলো তাদের খোঁজ খবর নিয়ে আসি। হালিমকে বললাম, তুমিও চলো। অস্ত্রটা রেখে বৈঠা ধরো। আলম সরদারও তার অস্ত্রটি রাখলেন পাশের নৌকায়। জোয়ারে টইটম্বুর খাল ধরে ভাসতে ভাসতে চললো আলম সরদারের নৌকা। যাচ্ছি মালঞ্চ নদীতে নোঙ্গর করা RAB-এর ট্রলারে।

ভাদ্র মাসের গরমে নাকাল সবাই। সরু খালের ভিতরে এক ফোঁটা বাতাসও আসছে না। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি একটি পাতাও নড়ছে না। হালিম বললো, বাতাস নাই মোটেই। আকাশ দম ধরে আছে। বড় বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। প্রথম ভাটায় বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু শেষ ভাটায় বৃষ্টি হবেই হবে। বললাম, বৃষ্টি হলে গরমটা কমবে, আরাম লাগবে।

নৌকা চলছে পালোকাটি খালের ভিতর দিয়ে। ভাটার স্রোত এতো তীব্র যে নৌকা সোজা রাখতে হিসমিম খাচ্ছি আমরা। সামনে বৈঠা বাইছে বনদস্যু হালিম। পিছনে আলম সরদার। মাঝখানে বসে বেশ মজা পাচ্ছি। স্রোতের চাপে নৌকা খালের ডানে-বামে বাড়ি খেতে খেতে আগাচ্ছে।

চলতে চলতে ধাক্কা খেলাম একটা কেওড়া গাছে। গাছ ভর্তি ফল। মনে হচ্ছে পাতার চেয়েও বেশি কেওড়া ধরেছে গাছে গাছে। পাশেই আবার দেখি ছইলা গাছ। তাতেও ফল ধরেছে। কেওড়ার মতোই বেশ বড় বড় হয় ফলগুলো। এই জঙ্গলের বাঁকী গাছগুলোর মধ্যে গড়ান, গেওয়া বেশি। মাঝে মাঝে বাইন আর কাঁকড়ার গাছ দেখা যায়। এদিকে সুন্দরী গাছের দেখা মিলে না।

ভরা জোয়ারে এই জঙ্গলটাকে জীবন্ত এক বন মনে হয়। ভীষণ ভালো লাগে। প্রায় আধা ঘন্টা চললাম এভাবে। পড়লাম মালঞ্চে। এই নদীটি শুরু হয়েছে চুনা নদী থেকে। কদমতলা ফরেস্ট অফিসের উল্টোদিক থেকে নেমে গেছে এই নদী। অনেকটা পথ পেরিয়ে মিশেছে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর সাথে। মালঞ্চ নামটি যেমন সুন্দর, দেখতে তার চেয়ে বেশি সুন্দর।

উল্টো পাশে, মানে পশ্চিম পাশের একটি বাইন গাছের সঙ্গে বাঁধা RAB-এর ট্রলার। ছাদের উপর তিনজন সশস্ত্র সদস্য বসা। আমাদের যেতে দেখে নড়েচড়ে বসলো তারা। কাছে পৌঁছানোর আগেই এই দলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ছাদে উঠে দাঁড়ালেন। ভিড়লাম আমরা।

উনাদের ট্রলারে উঠে এক কাপ চা খেয়ে আবার নেমে যাবো। সোৎসাহে আমাদের দেখছেন উনারা। বুঝতে চাইছেন নৌকায় ওরা কারা? কথা না বাড়িয়ে দস্যুনেতা আলম সরদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এবার উনারা একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র সদস্যরা একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। উনারা ভেবেছিলেন যে আমরা বোধ হয় আলম বাহিনীকে এখনই তাঁদের হেফাজতে দিবো। বললাম, বনের ভিতরে আজ সারা দিনের কাজ আছে। রাতেও থাকবো আমরা। আগামী দিনে উঠে আসবো। কষ্ট হলেও আপনারা এখানেই থাকবেন।

বললাম, এদিক দিয়ে সন্দেহজনক কোনো নৌকা দেখলে আটকে দিবেন। ওই খালের ভিতরে একটু দূরে আমরা থাকবো। যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নাই। কোনো সমস্যা দেখলে হুইসেল বাজাবেন। বিস্কিট আর চা খেয়ে ফিরে আসলাম। নদী পার হয়ে খালের ভিতরে না ঢোকা পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন RAB সদস্যরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top