রূপান্তরের গল্প ২০১ | Rupantorer Golpo 201

আত্মসমর্পণের আবেদন করলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২০১

আত্মসমর্পণের আবেদন করলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২০১ | Rupantorer Golpo 201 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২০১ : এক ঘন্টা আগেই যে খালে ছিলাম সেই খালটিকে এখন আর চিনতে পারছি না। পানি নেমে গেছে জঙ্গল থেকে। খালের পানিও কমতে শুরু করেছে। যেখানে ট্রলার আর নৌকাগুলো জায়গা পরিবর্তন করেছে। যেখান থেকে রওনা হয়েছি সেখান থেকে অনেকটা এগিয়ে আনা হয়েছে। এখানে পালোকাটি খালটি অতিক্রম করেছে আরেকটি ছোট্ট খাল।

যাওয়ার সময় বহরে নৌকা ছিলো ৭/৮টি। এখন দেখি ১৪/১৫টি। প্রতি নৌকায় দুই জন করে জেলে। একটি নৌকায় চারজন। তাদের মধ্যে একজনের বয়স আট বছরের বেশি না। বাবা, দাদা’র সঙ্গে সেও যাচ্ছে মাছ ধরতে। বললাম, বাচ্চাটাকে না আনলে হতো না? ছেলেটির বাবা বললো, বাড়িতে থাকলে খাওয়ার সমস্যা হয়। তাই সাথে করে নিয়ে আসছি। ছেলেটির দাদা বললেন, জঙ্গলে আসলে ভালো লাগে। ভালো মন্দ খাওয়া হয়। কিন্তু বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান না? দাদা বললেন, গরীব মানুষ, জঙ্গল করেই বাঁচতে হবে আমাদের। বাচ্চাটাকে কাছে ডেকে নিলাম। কী যে মায়া সেই মুখটাতে! ব্যাগ থেকে চকলেট, বিস্কিট আর চিপস-এর কয়েকটি প্যাকেট দিলাম হাতে। কী যে খুশি হলো বাচ্চাটি!

প্রথম ভাটায় লোকালয় থেকে রওনা দিয়েছে এই জেলেরা। কেউ কাঁকড়া ধরে, কেউ বড়শি বায় আবার কেউ জাল দিয়ে মাছ ধরে। আছে খালপাটার নৌকাও। চুনা নদী থেকে পশুরতলার ভাড়ানী ফুঁড়ে ওরা নামছে নিচের দিকে। বড় নদী দিয়ে না গিয়ে এই চোরা পথে যাচ্ছেন কেন আপনারা? প্রশ্নের উত্তর নাই। কারণ এরা কেউই বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসেনি। মাছ-কাঁকড়াও ধরতে যাবেন আরও নিচের দিকে, অভয়াশ্রমে।

আমরা যেখানে আছি সেটিও চোরাই পথ। এই জেলেদের দুর্ভাগ্য, কারণ এই সময় কোনো দস্যুদলের এখানে থাকার কথা না। আলম বাহিনীর সামনে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে সবাই। যথারীতি ওদের আটকে দিয়েছে দস্যুরা। কিন্তু এ দফায় চাঁদা বা মুক্তিপণের জন্য না, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ওদের থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে বেলায়েত সরদারসহ অন্যরা জেগে গেছে। ট্রলারের ছাদে তখনও গভীর ঘুমে আমার ভিডিওগ্রাফার বায়েজিদ ইসলাম পলিন। সে একটু বেশিই ঘুমায়। আর এই ঘুম নিয়ে সহযাত্রীদের সাথে চলে খুনসুঁটিও। পলিনকে ঘিরে বসে আছেন রাজীব, ইয়ামীন ভাই, আলমগীর আর মিলন। সবাই মিলে তার ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। আমি বললাম, ঘুমার আরও কিছুক্ষণ। শ্যুটিং-এর কাজ শুরু করতে আরও এক ঘন্টা দেরি আছে। তখন ডেকে তুলবেন।

এদিকে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বেলায়েত সরদার। মুখে সেই হাসি। কাছে আসতেই বললেন, ও ভাই, লোক তো দ্বিগুন হয়ে গেছে। এতো লোকের রান্না করবো কী করে? এতো বড় হাঁড়ি তো আমাদের নাই। বললাম, জেলে ভাইদের ছেড়ে দিলেই তো হয়, লোক কমে যায়। দস্যুনেতা আলম সরদার বললেন, এখন এদের ছাড়া যাবে না ভাই। বিপদ হতে পারে, ঝামেলা বাড়বে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আলম বললেন, ওরা গিয়ে অন্য পার্টিকে (দস্যুদল) বলে দিতে পারে যে আমরা এখানে আছি। বিশেষ করে জোনাব যদি জানতে পারে তাহলে এখানে এসে হামলা চালানোর চেষ্টা করবে।

হালিম বললো, সামনেই দোবেঁকী। সেখানে বন বিভাগের অফিস আছে, কোস্টগার্ডের অফিসও আছে। বন বিভাগ সমস্য না। কিন্তু কোস্টগার্ডকে বলে দিলে নির্ঘাৎ অভিযান চালাবে। বললাম, তাহলে তো সেই ঝাইলোর খালের মতো গোলাগুলিতে পড়তে হবে। এবার এই বিপদ ঘাড়ে নেওয়া যাবে না। জেলে ভাইদের বললাম, মনে করেন ডাকাত ধরেছে আপনাদের। আজকের দিনটা এখানেই থাকেন। দুই বেলা আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করবেন। আজকে রাতটা থেকে কাল সকালে বেরিয়ে যাবো আমরা।

এবার বেলায়েত সরদার আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, বাঁশটা আমাকেই দিলেন ভাই? বললাম, সবাই মিলে একটু রান্নাবান্না করবেন। আপনার জন্য এটা কোনো ব্যাপার হলো? সবাই হাসতে হাসতে শেষ। বললাম, সকালে কী খাচ্ছি আমরা? রান্নাঘরে রাখা ভাতের হাঁড়িটা দেখিয়ে বললেন, ওই ভুল আমি করি না ভাই। রাতেই ভাত রান্না করে পানি দিয়ে রাখছিলাম। সকালের নাস্তা হবে পান্তা দিয়ে। বললাম, আমার কোনো সমস্যা নাই।

কড়াই-এ বেশ সুন্দর করে শুকনা মরিচ ভাজা চলছে। সরিষার তেল দিয়ে ভাজার পর সেই মরিচের ওপর হাল্কা লবণ ছিটিয়ে দেয় ওরা। কী যে দারুণ লাগে! পান্তা ভাতে সেই মরিচ ডলে নিলে আমার আর কিছু লাগে না। বললাম, সবাই যখন খাবে খাক, আমাকে একটু পান্তা ভাত দেন, ক্ষুধা লাগছে।

বনদস্যুদের শেষ নৌকাটি জঙ্গলের সাথে লাগানো। সেই নৌকায় বাঁধা আস্ত একটি ছাগল। দস্যুদলের আপ্যায়ন বলে কথা। সাধারণত মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য ওরা হরিণ শিকার করে রাখে। কিন্তু আগে থেকে নিষেধ করার কারণে ছাগলটি আগে থেকেই আনিয়ে রেখেছে আলম বাহিনী। এর আগে মজনুও একই কাজ করেছিলো। অনেক আগে দস্যু সম্রাট রাজু বাহিনীর আস্তানায় গিয়েও একই রকমের আপ্যায়ন দেখেছিলাম। হরিণ শিকারে বাধা দিয়েছি বলে এক বেলার মধ্যেই লোকালয় থেকে দু’টি ছাগল এনেছিলেন।

অবশ্য সেই অভিজ্ঞতা ২০১১ সালের। ২০১৬ সালে এসে সুন্দরবনের দস্যু জগত পরিবর্তীত হয়েছে অনেকটা। এই পাঁচ বছরে বড় বড় দস্যু দলগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে কোণঠাসা তারা। অনেকেই অস্ত্র আর সদস্যদের নিয়ে সরকারের কাছে নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করছে যার মধ্যস্ততা করছি আমি। মাষ্টার বাহিনী দিয়ে শুরু। এরপর মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার জীবনে ফিরবে পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যু আলম বাহিনী ও পূর্বের শান্ত বাহিনী।

পান্তা ভাত দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম সবাই মিলে। ডেকে তুললাম ভিডিওগ্রাফার পলিনকে। তারপর আলম বাহিনীর নৌকাগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম জঙ্গলে নেমে শ্যুটিং এর কাজ করবো। কিন্তু এদিকটা সব দিক থেকে অতো নিরাপদ না।

শুনেছি প্রচুর কেউটে সাপ আছে এদিকের সুন্দরবনে। বাঘের ঝুঁকি কম থাকলেও একেবারে ঝুঁকিমুক্ত না। সবচেয়ে বড় বিপদ বন্য শুকরদের নিয়ে। এই অঞ্চলে বিশাল আকৃতির বন্য শুকর আছে, দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদের আচার আচরণ সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। হঠাৎ করেই আক্রমণ করে বসে। বনদস্যু হালিম বলছিলো, গুলি দিয়েও এদের থামানো যায় না।

নৌকায় ভেসে ভেসে আলম সরদার ও তার বাহিনীর সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিলাম। সবাই আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। আলম সরদার বললেন তাঁর এই দস্যু জীবনে আসার কাহিনী। অন্যরাও বয়সে তরুণ। অপরাধ জীবনে আসার কারণগুলো প্রায় কাছাকাছি। দারিদ্র, সূদের খপ্পরে পড়ে মামলা খেয়ে ফেরারি হয়েছে কেউ কেউ। আবার কেউ এসেছে নেহায়েত শখের বশে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের আশায়। এসেই আটকে গেছে দস্যু জীবনে।

কথা হচ্ছিলো তরুণ বনদস্যু বাক্কারের সাথে। সাধাসিধা এক যুবক। বছরের অর্ধেক সময় সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে। বাঁকী সময় ইঁট ভাটায় কাজ করে। এরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক। মামলা চালানোর সক্ষমতা নাই বলে ফেরারি হয়েছে এরা। মামলা চালাতে পারলে এরা বাড়িতেই থাকতো। আবার বাড়িতে থাকতে পারে না বলেই অপরাধ জীবনে আসা ছাড়া কোনো উপায়ও নাই। সেদিক থেকে এই জঙ্গলের কোনো দস্যুদলে ভিড়ে যাওয়া সবচেয়ে সহজ।

আমাদের ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বনদস্যুরা আত্মসমর্পণ করতে চায়। ধরে নেওয়া হয় সেটিই সরকারের কাছে দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের আবেদন। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত একটি দরখাস্ত করে তারা। সেটিও আমার হাতেই তুলে দেয়।

সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি অনেকটা নিয়মতান্ত্রিক বিষয় হয়ে যাচ্ছে। আবেদনের পর সরকার একটি দিন নির্ধারণ করে। সেই দিনকে রেখে আমরা কাজ এগিয়ে নেই। RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানের সাথে আলোচনা করে পুরো প্রক্রিয়াটি চলে। তারপর দিনক্ষণ অনুযায়ী আগের দিন আমি বনে ঢুকে যাই। জলদস্যুদের নিয়ে আসি, তারা RAB হেফাজতে যায়। এরপরের পুরো প্রক্রিয়াটি দক্ষ হাতে পরিচালিত হয়।

অস্ত্র জমা দেওয়া, মামলা, থানা হয়ে জেলখানা, তারপর জামিন নিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরোটা সময় RAB তাদের দেখভাল করে। কেউ কোনো বিপদে পড়লে সহযোগিতা করে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পূণর্বাসের বিষয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

কেউ কেউ বলেন, সারেন্ডার RAB-এর কাজ না। আমার মাথায় আসে না কেন তারা এসব কথা বলেন? এই বাহিনীর একের পর এক অভিযানেই তো বনদস্যু-জলদস্যুরা কোণঠাসা হয়েছে। আবার তাদের প্রতি আস্থা না থাকলে দস্যুরা কি সারেন্ডারের জন্য তাদের কাছে যায়?

মেজর আদনানসহ সংস্থাটির শীর্ষ কর্তারাও বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে দেখছেন। সেজন্যই কাজটি সহজ হয়ে গেছে। দুষ্টের দমন যেমন আইন শৃংখলা বাহিনীর কাজ, তেমনি শিষ্টের পালনও তো তাদেরই দায়িত্ব। মূল কথা, অপরাধ দমন হচ্ছে কী না! সুন্দরবনের দস্যুতা নিয়ে যাঁদের ভাসা ভাসা ধারণা, তাঁরাই এর বিরোধীতা করছেন। আর তাঁদের ভুল বোঝাচ্ছেন এই জঙ্গলের কয়েকজন বড় বড় মাছ ব্যবসায়ী। দস্যুমুক্ত সুন্দরবন এই ব্যবসায়ীরাও চান না।

(ছবি: আমাদের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের আবেদন করছেন দস্যুনেতা আলম সরদার। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top