রূপান্তরের গল্প ২০২ | Rupantorer Golpo 202

ক্রসফায়ারের আতঙ্কে বাড়ি ফিরা হয় না | রূপান্তরের গল্প ২০২

ক্রসফায়ারের আতঙ্কে বাড়ি ফিরা হয় না | রূপান্তরের গল্প ২০২ | Rupantorer Golpo 202 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২০২ : চুনা নদীটি ছোট্ট, তবে অদ্ভুত সুন্দর। খোলপেটুয়া নদী থেকে শুরু হয়ে বুড়িগোয়ালিনী হয়ে মুন্সিগঞ্জের পাশ দিয়ে পশ্চিমে বয়ে গেছে। একপাশে সুন্দরবন, অন্যপাশে লবণ জলের জনপদ। দস্যুনেতা আলম সরদারের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে, চুনা নদীর তীরে। ছোট্ট নদীটির উল্টো পাশেই সুন্দরবন।

দারিদ্র পীড়িত পরিবারে জন্ম দস্যুনেতা আলমের। কৈশোরে তিন বন্ধু মিলে নামতো কাঁকড়া শিকারে। তারপর সঙ্গদোষে দস্যুতায় হাতে খড়ি। আলিফ আর মিলনের সাথে রাতে রাতে চলতো অপকর্ম। অবৈধ রোজগারের লোভ থেকে হাতে ওঠে অবৈধ অস্ত্র। তারপর অনেক বার ফিরে আসার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। এরপর ক্রসফায়ারের তালিকায় নাম ওঠে। তারপর থেকে হয় জঙ্গল, না হয় ফেরারি জীবন। ডিঙ্গি নৌকায় বসে আলম সরদার বলছেন, যাদের ওপর অত্যাচার করি তারা সবাই আমার প্রতিবেশি, পরিচিত।

আলম বলছেন, এই জীবনে আনন্দ নাই, জীবন নিয়ে কোনো তৃপ্তি নাই। আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। জেলখানায় গেছি। তারপর জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরি, কিন্তু থাকতে পারি না। পুলিশের সোর্সরা তাড়াতে থাকে, টাকা চায়। কখনও বাড়িতে বসে মামলা খেয়ে যাই। দস্যুনেতা বললেন, সেই যে ১৭/১৮ বছর বয়সে পলাতক জীবন শুরু হলো, এখনও পালিয়েই বেড়াচ্ছি। আমরা সুন্দরবনের ডাকাত। বিরাট নাম হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বাড়িকে একটা পাকা ঘরও নাই। অবৈধ টাকায় জেলে-বাওয়ালীদের দীর্ঘশ্বাস আছে, ওই টাকা কাজে লাগে না।

সাক্ষাৎকার শেষ হলো। অন্যান্য কাজ সেরে নৌকা বহরে ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর। ভাটা প্রায় শেষ। জোয়ার আসবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে। এদিকে আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। দম বন্ধ করা গরম। একটুও বাতাস নাই। বনদস্যু হালিম বললো, বড় বৃষ্টি হবে বলছিলাম না ভাই? বললাম, বলছিলে। এখন বৃষ্টিটা হলেই বাঁচি।

বনদস্যুদের সাথে জেলেদের সম্পর্কটা অদ্ভুত রকমের। তারা সবাই সবাইকে চিনে। ভোরবেলা এখানে যারা আটকা পড়েছে তারা যেমন দস্যুদের চিনে, দস্যুরাও তাদের পরিচিত। মুন্সিগঞ্জের কয়েকজন জেলেও আছে এই বহরে। দস্যুনেতার প্রতিবেশি তারা।

জেলেদের মন মেজাজ ভালো নাই। বেশ বিরক্ত আমাদের ওপরও। এই অবস্থা দেখে একটু শান্তনা দিতে গেলাম। তবুও তাদের মুখে হাসি ফুটলো না। একটু অপ্রস্তুত আমি। আমার এই দশা দেখে পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলো হালিম। একগাদা গালি দিয়ে বললো, তোমাদের কি আমরা অপহরণ করছি? ভাই না থাকলে দেখতা কী করি! বলেই হাতে একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এলো সে। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলাম। হালিমকে আটকালাম। বললাম, ওদের তো রোজগারের সময় এখন। তোমরা যখন আটকাও তখন ভয়ে কিছু বলে না। মন মেজাজ তাদের ঠিকই খারাপ হয়। সাথে যোগ হয় ভয় আর দুশ্চিন্তা।

আজকে ওরা ভয় পাচ্ছে না। কিন্তু লোকসান তো হচ্ছেই। আবারও জেলেদের অনুরোধ করলাম। বললাম, এই একটা দিন থাকেন কষ্ট করে। তারপর তো ডাকাতেরা উঠেই যাচ্ছে।

আমাদের এই কথোপকথন দেখে হাঁক দিয়ে উঠলো মিলন। এই তরুণ যদিও এই মুহুর্তে দস্যুতা করছে না। কিন্তু এক সময় ডাকসাইটে ভয়ঙ্কর ডাকাত ছিলো। মিলন বললো, ভালো হয়ে গেছি বলে তোমরা কথা শোনো না। যখন ডাকাতি করতাম তখন তো ঠিকই আমাদের কথায় উঠতে বসতে। তাকেও থামালাম। বিনয়ের সাথে আবারও ক্ষমা চাইলাম ওই জেলেদের কাছে। এবার মনে হলো একটু নরম হলেন তাঁরা।

পরিবেশ একটু ভারী দেখে এগিয়ে আসলেন বেলায়েত সরদার। বললেন, ও ভাইয়েরা শোনেন, আপনাদের রান্নাবান্নার কোনো দরকার নাই। আজকের দিনটা আমাদের সাথেই খাবেন। তাই বলে বসে বসে খাবেন? তা হবে না।

শেষের নৌকার দিকে যান। ছাগলটা নিয়ে আসেন। জঙ্গলে উঠাবেন না। নৌকার উপরেই সব কাজ সারতে হবে। সবাই মিলে হাত লাগালো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মাংস কাটাকুটির কাজ শেষ হলো। এর মধ্যে মসলা বেটে ফেললেন সরদার। এদিকে প্যাকেট মসলা চলে না। জেলেরাও বাটা মসলা খান।

সুন্দরবনের প্রতিটি নৌকায় মাটির নোংড়া থাকে। নোংড়া হলো মাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র। হামাম দিস্তার মতো কাঠ দিয়ে তৈরি একটি বাটনা দিয়ে মসলা বাটা হয়। সুন্দরবন এবং এই উপকূলে এখনও বাটা মসলার রান্না চলে। সুন্দরবনে তাই যেকোনো জেলের রান্না খেতে ভালো লাগে। সেই পুরনো স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়।

বলতে বলতে বৃষ্টি নামলো। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হতেই জেলে নৌকাগুলোতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। সবগুলো নৌকাতেই ছই টানানোর কাঠামো করা চিকন চিকন সুন্দরী গাছ দিয়ে। এক প্রান্তে মোড়ানো নিল রঙ এর পলিথিন। দৌড়ে গিয়ে দড়ির বাঁধন খুলে পলিথিনটি টেনে দেওয়া হলো। একদম এই মাথা থেকে ওই মাথা ঢেকে গেলো পলিথিনে। দেখতে দেখতে বৃষ্টি বাড়লো। আমাদের ট্রলারে ভারী বৃষ্টি ঠেকানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নাই।

ক্যামেরা ও অন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে সবাই ঢুকে পড়লো ট্রলারের কেবিনের ভিতরে। পরের কয়েক মিনিটের বৃষ্টি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অনুভূতি! এতো সুন্দর বৃষ্টি সচরাচর দেখা যায় না। মুহুর্তেই চারপাশ শীতল হয়ে আসলো। এই সুযোগে মনের মতো করে ভিজলাম। ট্রলারের ছাদে আমার সাথে এসে যোগ দিলেন সহযাত্রীরাও।

বৃষ্টি পুরোপুরি থামতে থামতে আরও আধা ঘন্টা পার হলো। এদিকে ভাটা শেষে শুরু হলো জোয়ার। পানি আরও অনেকটা না বাড়লে এই জায়গা ছাড়তে পারবো না। অথচ এই জায়গায় আগামী জোয়ার পর্যন্ত থাকাটা নিরাপদও না। ভাড়ানী দিয়ে আরও নৌকা যাতায়াত করতে পারে। কখন কে কাকে খবর দিয়ে দেয় কে জানে।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। ট্রলারের রান্নাঘরে তখন ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। অনেকগুলো মানুষের রান্না হবে। সরদার শুধু তরকারি রান্নার দায়িত্ব নিলেন। কারণ বড় হাঁড়ির সংকট। সেজন্য প্রতিটি নৌকার চুলায় হবে ভাত রান্না। সবাইকে ডেকে আনুমানিক দুই কেজি করে চাল দেওয়া হলো। দারুণ পরিকল্পনা! রান্নার ঝামেলাও কমলো। আবার একই সময়ের মধ্যে রান্না শেষ হবে। রান্না হতে হতে বিকাল হলো। নৌকা বহরের সবাই মিলে বসে পড়লাম।

সন্ধ্যার দিকে জোয়ারে ভরলো খাল। বিদায় দিলাম জেলে নৌকাগুলোকে। তারপর ট্রলারটি রেখে আমরা চলে গেলাম আরেকটি নাম না জানা খালে। রাতে ওখানেই থাকবো। পরদিন ৭ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ধীরে সুস্থ্যে উঠে পড়বো আমরা। RAB-এর হেফাজতে যাবে সুন্দরবনের দস্যু আলম বাহিনী।

সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে কালকেই মানে ৭ সেপ্টেম্বর রওনা দিবো। মংলা থেকে ট্রলার নিয়ে নেমে পড়বো পূর্ব সুন্দরবনে। সেলা নদীর কোনো এক খালে দেখা হবে আরেক দস্যুদল শান্ত বাহিনীর সাথে। তারাও চলে আসবে RAB হেফাজতে। পরশুদিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে (২০১৬) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র-গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবনের আরও দু’টি দস্যুদল।

(ছবি: আলম সরদার ও হালিম। সেলফিতে সাতক্ষীরার সহকর্মী আহসান রাজীব। ৭ মে ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top