রূপান্তরের গল্প ২০৩ | Rupantorer Golpo 203

মুহুর্তেই সবকিছু উল্টে পাল্টে গেলো | রূপান্তরের গল্প ২০৩

মুহুর্তেই সবকিছু উল্টে পাল্টে গেলো | রূপান্তরের গল্প ২০৩ | Rupantorer Golpo 203 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২০৩ : সেই দুপুর থেকে মনটা খচখচ করছে। শুধু মনে হচ্ছে শান্ত বাহিনীকে নিয়ে ঝামেলা হবে। কিন্তু আমরা জঙ্গলের যেখানে আছি সেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। গত কয়েক দিন ধরে শান্ত বাহিনীকে নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা হচ্ছে। সারেন্ডার করা না করা নিয়ে দলের ভিতরে বিভক্তি ছিলো। সেটা মিটেছে। অন্যদিকে বাইরেও সমস্যা চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সগুলোর অতি ব্যস্ততা আমাকে বেশ দুশ্চিন্তায় রেখেছে। ওদের সারেন্ডার বন্ধে নানা রকম খবর আসছে। সমস্যা হলো, আলম বাহিনীর এখানে আসার পর থেকে কারও সাথে যোগাযোগ হয়নি।

একটু ফোনে কথা বলা দরকার। কিন্তু রাতের বেলা সেটি আর সম্ভব হবে না। জঙ্গলে নেমে দূরের একটি কেওড়া গাছে উঠতে হবে। মগডালে উঠলে নেটওয়ার্ক পেলেও পেতে পারি। এই রাতে ওই গাছ পর্যন্ত আমার পক্ষ্যে সম্ভব না। ঝুঁকিও অনেক।

সারা রাত উসখুস করে কাটলো। চারপাশে ঘুটঘুরে অন্ধকার। এদিকে গরমও পড়েছে। বৃষ্টি আর বন্যা জোয়ারে জঙ্গলের সবগুলো বাইড়ে পোকা জেগে উঠেছে। হাত, পা ফুলে ফুলে গেছে। শরীরের অনাবৃত অংশে তাদের আর কামড় দেওয়ার জায়গা নাই। বর্ষায় এই পোকার বাড় বাড়ন্তে অতিষ্ট থাকতেই হয়।

রাতের বেলা নতুন করে রান্না হলো। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া সারলাম। আলম বাহিনীর অন্ত্র-গুলিগুলো গুছিয়ে রাখা হলো। দুই অস্ত্র বাইরে রেখে বাঁকীগুলো বেঁধে রাখলো হালিম। ভাদ্র মাসে সরু খালের ভিতরের এই জীবন অসহনীয়। সুন্দরবনের মানুষেরা অবশ্য অভ্যস্ত এ জীবনে। গান, আড্ডা আর গল্পে গল্পে কাটলো রাত। সহযাত্রীদের ঘুমাতে পাঠালাম।

ভোরবেলা দুইজনকে সাথে নিয়ে জঙ্গলে নামলাম। উঁচু একটি গাছে উঠবো। ফোন দিতে হবে শান্ত বাহিনীকে। কাঁদা, কাঁটা আর ঝোপঝাড় পেরিয়ে হাঁটা দিলাম। শরীরটা এমনিতেই বিদ্ধস্ত। তার ওপর আগের দুই রাত ঘুমাইনি। ওই জঙ্গলে হাঁটতে গিয়ে পা দুটো থেমে যাচ্ছিলো বার বার। কিন্তু থামলে চলবে কী করে? কতোক্ষণ হাঁটতে হবে জানি না। এদিকে বড় আর উঁচু গাছও হাতর গণা।

প্রায় চল্লিশ মিনিট হেঁটে একটি গাছ পেলাম। মৃত কেওড়া গাছ। দেখতে দেখতে হালিম উঠে পড়লো গাছটির মগডালে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলো না। এরপর আবার হাঁটা দিলাম উত্তর দিকে। হালিম বললো, জোয়ার আরেকটু বাড়লে নেট পাবেন ভাই।

আরও প্রায় আধা ঘন্টা পর আরেকটি গাছ পেলাম। মগডালে উঠে হালিম জানালো, নেট পাওয়া গেছে। উঠে আসেন ভাই। বেশ হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠলাম। অভ্যস্ত নই। তবুও উঠতে হলো। শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদারের নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। এখনও তারা ফোন খোলেনি, অথবা নেটওয়ার্কে আসেননি।

ফোন দিলাম আমার এক সোর্সকে। তিনি যা জানালেন তাতে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। শান্ত বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জেনে গেছে একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। দস্যু দলটি বড় একটি খালে এসে দাঁড়িয়েছে গত রাতে। সমস্যা হলো, তাদের অবস্থান জানাজানি হয়ে গেছে। অন্যদিকে নেটওয়ার্কে না থাকায় এই ঝুঁকির খবরটি তারা পায়নি। রীতিমতো দায়ুত্ব জ্ঞানহীন কাজ করে ফেলেছে ওরা। এদিকে আমিও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।

শুকনো গাছটিতে উঠতে গিয়ে বুক ও হাতের বেশ খানিকটা জায়গা ছিঁড়ে-কেটে গেছে। যে ডালে বসেছি সেটিও এবড়োথেবড়ো। গাছের মগডালের এমন জায়গায় বসে থাকাটা আমার জন্য খুব বেশি কঠিন। পড়ে যাওয়ার ঝুঁকির কথা বাদই দিলাম। অথচ দীর্ঘক্ষণ এখানেই বসে থাকতে হবে।

ঘন্টা খানেক গাছের ডালে বসে রইলাম। একটু পর পর ফোন দিচ্ছি। শান্ত বাহিনীর খবর নাই। এই ডাল, ওই ডাল করে বসার জায়গা বদলাচ্ছি, কিন্তু স্বস্তি পাই না। কিন্তু নামতেও পারছি না। আরও আধা ঘন্টা পর ফোন ঢুকলো। বললাম, আপনাদের অবস্থান জানাজানি হয়ে গেছে। একটু সরে অন্য খালে যান। দস্যুনেতা বারেক তালুকদার বেশ নির্বিকার। বললেন, আত্মসমর্পণ করবো সরকারের কাছে। তাহলে সরকারি বাহিনী কেন আমাদের আক্রমণ করবে? জোর দিয়ে বললাম, বিস্তারিত বলতে পারছি না। আপনারা খাল পরিবর্তন করেন।।

বারেক তালুকদার এমনিতে সাদামাটা মানুষ। এখন মনে হচ্ছে একটু বোকাসোকাও। বললাম, মনির ভাইকে একটু দেন। মনির ওই দস্যুদলের একজন সদস্য। গেলো সফরে বেশ খাতির হয়েছে। ফোন ধরতেই এই কথা বললাম। উনি বললেন, তারা আছেন পূর্ব সুন্দরবনের বড় টেংড়া খালে। বললাম, পারলে, ছোট টেংড়ার দিকে যান। এখানে থাকবেন না, আর এক মুহুর্তও না। আপনাদের হাতে দুই ঘন্টাও নাই।

মংলা’র সেই সোর্সকে আবার ফোন দিলাম। বললাম, আপনি ওদের সাথে যোগাযোগে থাকেন। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের তথ্য ত
দিবেন না। ওদের ফোন নিশ্চয়ই ট্যাপ হচ্ছে। এর পর প্রয়োজনীয় আরও কয়েকটি ফোন দিলাম। সবশেষ ফোনটি ছিলো বরিশাল RAB-এর উপ অধিনায়ক মেজর আদনান কবীরের ফোনে। বিস্তারিত জানালাম। উনি বললেন, শান্ত বাহিনীকে আর সময় দেওয়া যাবে না। আপনারা আলম বাহিনীকে নিয়ে রওনা দেন।

ফোন রেখে হাঁটা দিলাম। প্রায় দেড় ঘন্টার পথ পেরিয়ে নৌকার কাছে আসলাম। বললাম, দশ মিনিটের মধ্যে রওনা দিবো আমরা। হাতে সময় নাই। সবাই রেডি হন। দস্যুনেতা আলম সরদার বললেন, আমরা তো রেডি। কিন্তু খালের ভিতরে পানি নাই। জোয়ারে এই খাল পর্যন্ত পানি আসতে আরও এক ঘন্টা লাগবে। আমাদের ট্রলার ভাসবে তারও এক ঘন্টা পর।

সহকর্মীরা বলছেন, সমস্যাটা কী? বললাম, যে সমস্যায় এবার পড়লাম, তার শেষ কোথায় জানি না। বললাম, শান্ত বাহিনী কোন খালে আছে সেই খবর সবাই জেনে গেছে। আগামী এক দেড় ঘন্টার মধ্যে ওখানে অভিযান চালাবে মংলার একটা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বিপদ কোন পর্যন্ত হবে জানি না এখনও!

আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো এক মিনিটও সময় নাই। অথচ এই জোয়ার ভাটার প্যাঁচে পড়ে এখান থেকে রওনা দিতেই অন্তত তিন ঘন্টা লাগবে। নৌপথ শেষ করে ডাঙ্গায় উঠতে সময় লাগবে আরও দুই ঘন্টা। সেখান থেকে রওনা হতে আরও এক ঘন্টা। তারপর শ্যামনগর হয়ে সাতক্ষীরা, সেখান থেকে খুলনা পার হয়ে মংলা পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত চার ঘন্টা। মংলা থেকে সাথে সাথেও যদি নদীতে নামি, সেখান থেকে বড় টেংড়া খাল পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে না হলেও তিন ঘন্ট। তার মানে এখন থেকে শান্ত বাহিনীর কাছ পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে ১২/১৩ ঘন্টা।

ঘড়িতে এখন সকাল নয়টা। তার মানে ওদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১০টা পার হবে। ততোক্ষণ ওরা বেঁচে থাকলেই হয়!

(ছবি: গাছের মগডালে উঠে নেটওয়ার্ক খুঁজছি আমরা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top