রূপান্তরের গল্প ২০৪ | Rupantorer Golpo 204

হামলা হয়েছে শান্ত বাহিনীর ওপর | রূপান্তরের গল্প ২০৪

হামলা হয়েছে শান্ত বাহিনীর ওপর | রূপান্তরের গল্প ২০৪ | Rupantorer Golpo 204 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প২০৪ : একটি ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসলাম সরদার আর আমি। কয়েকজন কাঁদায় নেমে সেই নৌকা ঠেলছে। জোলা খাল থেকে মূল খাল পালোকাটিতে গেলে ভাসবে নৌকা। ট্রলার রাখা পাশের খালে। সেটিও ভাসতে ভাসতে আরও দুই ঘন্টা লাগবে। আমরা ওদিকে যাবো না। যাবো মালঞ্চ নদীতে।

প্রায় ১৫ মিনিট কাঁদার ওপর দিয়ে চললো নৌকা। তারপর এসে পড়লাম মূল খাল-এ। পালোকাটি খালটি এখন বেশ পরিচিতি। মজনু বাহিনীকেও উঠিয়েছিলাম এই খাল থেকে। জোয়ার এসেছে বলে নৌকা ভাসলো এখানে। বৈঠা বেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম বড় নদী মালঞ্চ-এর দিকে। যারা নৌকা ঠেলে দিলো, তাদের পাঠালাম ট্রলারের কাছে। বললাম, পানিতে ভাসা মাত্র ট্রলাটি নিয়ে খালের এই জায়গায় আসবেন।

মালঞ্চ নদীতে উঠে দেখি RAB এর ট্রলারটি নাই। ভাবলাম তারা কি চলে গেলো? সেটা তো হওয়ার কথা না। এই জায়গাটিতে উনারা না থাকলে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে খালে। দিনের বেলা অন্য কোনো দস্যুদল আসবে না। কিন্তু বন বিভাগ বা কোস্টগার্ড ঢুকে পড়লে নতুন বিপদ শুরু হবে। এমনিতেই বিপদের শেষ নাই। শান্ত বাহিনীকে নিয়ে এমনিতে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।

বড় নদীর ডানে, বামে কোথাও নাই ট্রলার। সরদারকে বললাম, মাঝ নদীতে চলেন। মালঞ্চ বেশ উত্তাল নদী। তবে তখন জোয়ার হচ্ছে, সাথে মৃদু দখিণা বাতাস। নদীর পানি একদম শান্ত। মাঝ নদীতে আসার আগেই নজরে আসলো ট্রলারটি। কোনো কারণে একটু দক্ষিণে চলে গেছে ওরা। এবার উজান ঠেলে নৌকা নিয়ে এগুতে থাকলাম। সরদারের একার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে বৈঠা বাওয়া কঠিন হচ্ছে। গলুই-এ গিয়ে বৈঠা নিয়ে বসলাম। দু’জন মিলে নৌকা বেয়ে চলছি RAB-এর ট্রলারের দিকে।

নৌকা ভিড়িয়ে ট্রলারে উঠলাম। উনাদের টিম লিডার বেশ উদ্বিগ্ন। বললেন, শান্ত বাহিনীর খবর পেয়েছেন ভাই? বললাম, ওদের ওপর কি আক্রমণ হয়ে গেছে? বললেন, উপ অধিনায়ক আদনান কবীর ফোন দিয়েছিলেন। আপনাদের নিয়ে দ্রুত এখান থেকে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সকাল থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনাকে ফোনে পাচ্ছি না। বললাম, নেটওয়ার্ক থাকলে তো আপনাকে ফোন দিতাম। নৌকা বেয়ে আসতাম না। ভদ্রলোক মনে হলো একটু বেশি দুশ্চিন্তায়, আমাদের ওপর একটু বিরক্তও।

সুন্দরবনের ভিতরে মন মতো চলাফেরা করা যায় না সেবিষয়ে সম্ভবত উনার ধারণা কম ছিলো। এছাড়া দীর্ঘ সময় জঙ্গলের ভিতরে থাকাটাও বেশ কষ্টের। সবচেয়ে বড় কথা অপেক্ষা করতে কারও ভালো লাগে না। এছাড়া ভাদ্র মাসের দম বন্ধ করা আবহাওতেও নিশ্চয়ই উনারা বিপর্যস্ত। বেলায়েত সরদার নৌকায় বাঁধলেন ট্রলারের সাথে। আমি উঠে পড়লাম ট্রলারে। এর মধ্যে হাজির হলো চা-বিস্কিট। আমাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে জানালাম। বললাম, জোয়ারে ট্রলার ভাসলেই আমরা রওনা দিবো। আপনারা প্রস্তুত থাকবেন। মুন্সিগঞ্জ-এ আপনাদের গাড়িবহরকে প্রস্তুত থাকতে বলবেন। ওখানে আমাদের গাড়িটিও রাখা। সেই গাড়ির চালককেও তৈরি থাকতে বলবেন। আমরা উঠেই রওনা দিবো মংলার উদ্দেশ্যে। উনাদের কাছে স্যাটফোন আছে। সেই ফোন দিয়ে আবার কথা হলো আদনানের সঙ্গে।

বললাম, মংলার টিম বিকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে। পুরো পথে আমাদের কারও খাওয়াদাওয়ার সুযোগ হবে না। মংলায় আমাদের সবার জন্য খাবার প্যাকেট করে রাখতে বলবে। কারণ মংলা থেকে যে ট্রলারটি নিয়ে আমরা বনে যাবো, তাতে রান্নার ব্যবস্থা থাকবে না।

নৌকা ছাড়লাম। RAB সদস্যদের বললাম, এক ঘন্টা পর আপনারা ওই পালোকাটি খালের মুখে এসে নোঙ্গর করবেন। মাঝি বললো, ওখানে চর আছে ভাই। বললাম, জোয়ার হচ্ছে। তোমরা যখন আসবে তখন আধা জোয়ার হয়ে যাবে। ট্রলার কোথাও ঠেকবে না। আসলে এই ট্রলারের মাঝিরা পর্যটকদের নিয়ে আসেন। তাদের চলার পথ ভিন্ন, এদিকে আসেন না। তাই এদিকের পথঘাটও ভালো চিনেন না। বললাম, এই খাল-নদী আমার চেনা হয়ে গেছে। যেভাবে বলছি সেভাবে চলে আসবেন।

নৌকা ছাড়লাম আমরা। সরদার বললেন, আপনার বৈঠা বাওয়া লাগবে না ভাই। এখন সুজন স্রোত পাবো। সুজন স্রোত মানে স্রোতের সাথে সাথে যাচ্ছি আমরা।

এর মধ্যে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। পালোকাটি খালের পানি বেড়েছে। কিন্তু আমাদের নৌকাগুলো যে খালে আছে সেখানে পানি উঠতে আরেকটু সময় লাগবে। পরের এক ঘন্টার মধ্যে ভাসবে ট্রলারও। নৌকা নিয়ে আর সরু খালে ঢুকলাম না। চিৎকার করে ডাকতেই সাড়া এলো। বললাম, নৌকাগুলো নিয়ে বড় খালে আসেন। সবাই একসাথে হলাম। বনদস্যুদের অস্ত্র আর গুলিগুলো রাখা হলো ট্রলারের গলুই-এ।

আমাদের ট্রলারটি ভাসতে আরেকটু সময় লাগলো। এরপর পুরো বহর নিয়ে পৌঁছে গেলাম বড় নদীতে। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবো না। তাই ট্রলার দুটি পাশাপাশি বেঁধে ফেলা হলো। রওনা হলাম আমরা। চলতে চলতে বনদস্যু আলম বাহিনীর সদস্যরা উঠে গেলো RAB-এর ট্রলারে। এরপর অস্ত্র আর গুলিগুলো বুঝিয়ে দিলাম। আলম বাহিনী চলে গেলো RAB হেফাজতে।

এবার আমাদের কাজ একটাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ব সুন্দরবনের আরেক দস্যুদল- শান্ত বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে হবে। লম্বা পথ। কারণ আমরা আছি পশ্চিম সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীতে। ডাঙ্গায় উঠে লম্বা সড়ক পথ পারি দিতে হবে। মংলা থেকে আবার শুরু হবে পানি পথ। সেলা নদী ধরে বড় টেংড়া খালে যেতেও সময় লাগবে।
দু’টি ট্রলার চলছে পাশাপাশি।

মালঞ্চ নদী থেকে উঠলাম চুনা নদীতে। এখানে ডানপাশে সুন্দরবন, বাম পাশে লোকালয়। আমাদের ট্রলার আর নৌকার বহরের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে মানুষ। এদিকে এভাবে ট্রলার চলাফেরা করে না বলেই অবাক তারা। এছাড়া দিনের বেলা দস্যুদের নিয়ে লোকালয়ে ফেরার ঘটনাও প্রথম। জোয়ারের স্রোত থাকায় শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ বন বিভাগের ঘাটে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না। সেখানে প্রস্তুত গাড়ি বহর। ঘাটে ভিড়ে আধা ঘন্টার মধ্যে যে যার গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি ছুটলো মংলার উদ্দেশ্যে।

শ্যামনগর থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা ভীষণ খারাপ। গাড়ি টানতেই পারছি না। এরপর সাতক্ষীরা সদর পার হয়ে আবার শুরু হলো ভাঙ্গা রাস্তা। তখন খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের কাজ চলছিলো। কিছু করার নাই। ধীরে ধীরে চললো গাড়ি বহর। পুরোটা পথ একটু পর পর শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদারের সাথে কথা বলছি। আমাদের এই তাড়াহুড়ো দেখে তিনি বেশ বিরক্ত। বলছেন, জঙ্গলে এসে আমাদের খুঁজে পাবে না কেউ। আপনারা খালি খালি তাড়া দিচ্ছেন আমাদের।

খুলনার জিরো পয়েন্ট পার হলাম। তখন বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হবে হবে। এসময় শান্ত বাহিনীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ফোনে পাচ্ছি না কিছুতেই। অথচ কথা ছিলো আমরা না আসা পর্যন্ত পুরোটা সময় তারা নেটওয়ার্ক-এ থাকবে। সকাল থেকে চা-বিস্কিট ছাড়া অন্য কিছু খাইনি। ক্ষুধার্ত সবাই। কিন্তু দাঁড়ানোর সময় নাই।

রূপসা সেতু অতিক্রম করার সময় মংলা থেকে আমার সোর্স ফোন দিলো। বললো, অ্যাটাক হয়ে গেছে ভাই। মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে আসলো। সাথে সাথে দস্যুনেতা বারেক তালুকদারের ছোট মেয়েটার কথা মনে পড়লো। ওকে কথা দিয়েছিলাম যে তার বাবাকে ফিরিয়ে আনবো। অন্যদিকে পরের দিন সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন। আলম বাহিনীর সাথে শান্ত বাহিনীরও আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করার কথা।

গাড়ি বহর নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। কী করবো বুঝতে পারছি না। আমার সব রকমের সোর্সকে কাজে নামালাম। সবার কাছে একটাই খবর- বড় টেংড়া খালে বিরাট অভিযান হয়েছে। কোন বাহিনী অভিযানটি করেছে জানতে পারছি না। গোলাগুলি হয়েছে জলদস্যুদের আস্তানায়। সন্ধ্যার আগে আগে প্রশাসনের স্পিডবোট গিয়ে আক্রমণ করেছে শান্ত বাহিনীর আস্তানায়।

এবার হিসাব মিললো। যখন থেকে ওদের ফোন বন্ধ পাচ্ছি তখনই ঘটেছে এই অভিযানের ঘটনা। মেজর আদনান কবীরের সাথে কথা হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। RAB কিংবা কোস্টগার্ড এই অভিযান চালায়নি। তাহলে কারা গেলো সেখানে? স্পিডবোট নিয়ে অভিযান করার মতো আর একটি বাহিনীই আছে। সেটি হলো বন বিভাগ। আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানলাম, বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস থেকে বন বিভাগ এই অভিযানটি করে।

স্মার্ট পেট্রোলিং টিম নামের বন বিভাগের বিশেষায়িত টিম কাজ করে সুন্দরবনে। অভিযান শেষে জলদস্যুদের নৌকাগুলি ধরে এনেছেন তাঁরা। জানার চেষ্টা করলাম কেউ আহত বা নিহত হয়েছে কী না। ঘন্টা খানেক পর মংলার জয়মনিরঘোলের এক সোর্স এর কাছে বিস্তারিত জানতে পারলাম।

শান্ত বাহিনী আজ সারেন্ডার করবে এমন খবর ছড়িয়েছিলো সকাল থেকেই। তারপর তারা জায়গা পরিবর্তন করে ছোট টেংড়া খালে যায়। দিনের বেলা বলে জেলেরা তাদের এই চলাফেরার বিষয়টি দেখে ফেলা। তারাই খবর দেয় লোকালয়ে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বলে বন বিভাগ ছাড়া আর কারও পক্ষ্যে অভিযানটি চালানো সহজ ছিলো না। এছাড়া সেই জায়গা থেকে চাঁদপাই ফরেস্ট অফিসের দূরত্বও সামান্য, স্পিডবোটে খুব বেশি হলে আধা ঘন্টার পথ।

অভিযান শেষে ফিরে এসেছে বন বিভাগের স্মার্ট টিম। দস্যুদের দুইটি নৌকা জব্দ করেছে তারা। সেখানে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ছিলো আর ছিলো বড় একটি হাঁড়ি ভর্তি শিং মাছ। হাতে নাতে কাউকে ধরতে পারেননি তাঁরা। কোনো অস্ত্রও আটক হয়নি।

সন্ধ্যা পেরিয়েছে। রাত আটটার দিকে পার হলাম বাগেরহাটের কাঁটাখালী। এরপর রামপাল পেরিয়ে মংলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হলো প্রায় সাড়ে নয়টা। মংলার পিকনিক কর্নারের ঘাটে প্রস্তু আছে দুইটি ট্রলার। একটি RAB-এর। আরেকটি আমাদের ভাড়া করা ট্রলার। মংলার বশির সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছেন। সবকিছুই ঠিকঠাক কিন্তু যাদের আনতে যাবো তারা যে কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না।

শান্ত বাহিনীর ওদিক থেকে কোনো খবরও আসছে না অভিযানের পর থেকে। সকাল থেকে বিরাট বড় দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দৌড়াচ্ছি। জানি না এর শেষ কোথায়!

(ছবি: শান্ত বাহিনীর সাথে প্রথম দেখার ছবি)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top