বেঁচে আছে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২০৫ | Rupantorer Golpo 205 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২০৫ : ঝড় যাচ্ছে রীতিমতে। মাথার ভিতরটা শূণ্য হয়ে আছে। বন বিভাগের সাথে গোলাগুলির পর থেকেই শান্ত বাহিনীর কোনো খবর নাই। অন্যদিকে গত দুই রাত নির্ঘুম। এক টানা প্রায় ১০ ঘন্টা সফর করেছি। শরীরটা বিদ্রোহ করছে। ভেবেছিলাম সাতক্ষীরা থেকে আসার পথে গাড়িতে বসে একটু ঘুমিয়ে নিবো। কিন্তু টেনশনে ঘুমও হলো না।
মংলা’র পিকনিক কর্নারে রাখা ট্রলারে ট্রলারে মালপত্র তোলা হচ্ছে। রওনা দেওয়া দরকার। কিন্তু যাবো কোথায়? ওদিকে সবকিছু তো উল্টে পাল্টে আছে। গোলাগুলিতে শান্ত বাহিনীর সদস্যরা কী মারা গেলো তাহলে? শুনলাম, তাদের লক্ষ্য করে একটানা ব্রাশফায়ার করেছে স্মার্ট টিম।
বিকালের পর থেকে বশিরের সাথেও ওদিকের কারও যোগাযোগ হয়নি। তাকেই জিজ্ঞেস করলাম কী করা উচিৎ? বশির বললো, চলেন ভাই রওনা দিয়ে দেই। যেখানে অভিযান হয়েছে, সেই জায়গায় চলে যাই। ওই খাল চিনি আমি। ফোন দিলাম মেজর আদনানকে। বললাম, আমাদের মনে হয় রওনা দেওয়া উচিৎ। বললেন, আরেকটু সময় অপেক্ষা করেন ভাই। বেঁচে থাকলে যেখানে অভিযান হয়েছে সেখানে ওরা থাকবে না। জানালেন, তাঁদের দিক থেকেও খোঁজ রাখা হচ্ছে। কেউ ফোন খুললেই জানা যাবে। যোগাযোগের পর গেলে সুবিধা হবে।
পশুর নদীর পাশে পিকনিক কর্নার। সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের জেটিতে আমরা অপেক্ষা করছি। বনদস্যু আলম সরদার ও তার সদস্যদের নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করবে RAB-এর একটি দল। বরিশাল থেকে আসা আরেকটি দল আমাদের সঙ্গে যাবে। যদি শান্ত বাহিনীর একজনও বেঁচে থাকে তাকে নিয়ে আসতে হবে।
দস্যুদের ডেরায় আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান হলে দস্যুরা ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে যায়। গহীন বনের ভিতর দিয়ে কে কোন দিকে দৌড়ায়, কতদূর গিয়ে থামে, কেউ জানে না। এমন গোলাগুলির মধ্যে পড়ার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই আছে। তাই নিরাশ হইনি। ফোনটি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছি। ফোন আসলেই আশা নিয়ে দেখছি। কিন্তু না, গেলো এক ঘন্টাতেও কোনো খবর এলো না।
রাত পৌনে ১২টার দিকে অচেনা একটি নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ওপাশে বনদস্যু মনির। মানে শান্ত বাহিনীর সদস্য মোড়েলগঞ্জ-এর সেই মনির। কোনো একটি গাছের মগডালে উঠে ফোন দিয়েছেন তিনি। মুহুর্তেই সব দুশ্চিন্তা উড়ে গেলো। শুধু জানতে চাইলাম, সবাই বেঁচে আছেন? মনির বললেন, তিনজন একসাথে হয়েছেন। অন্যরা কে কোথায় এভনও বলতে পারছেন না। বললেন, আমরা কুঁই দিয়ে দিয়ে সবাইকে খোঁজার চেষ্টা করছি।
আগে কেন ফোন দেননি? মনির বললেন, জীবনটা বাঁচানোই কঠিন তখন। ব্রাশফায়ারের মধ্যে আমরা গুলি খেয়ে মরিনি, ভাগ্যের ব্যাপার। বনদস্যু মনির বললেন, জঙ্গলের অনেক ভিতরে চলে গেছিলাম ভাই। খালের পাড়ে না আসলে নেট পাওয়া যায় না। সেজন্য দেরি হলো। বললাম, লিডার বারেক তালুকদার কই? বললেন, এখনও খুঁজে পাইনি। তবে সেও বেঁচে আছে।
মনির বলছেন, দুইজন জেলের সাথে দেখা হয়েছে তাদের। তারা বলেছে, সামনের কোন খালের ভিতরে লোকজনের কথাবার্তা শুনেছে। মনে হয় ওরাই আছে সেখানে। আমি বললাম, দ্রুত সবাই একসাথে হন। আমরা রওনা দিচ্ছি। বশিরকে ফোনটি ধরিয়ে দিলাম। বললাম, সুন্দরবনের কোন জায়গায় আমাদের দেখা হবে, জেনে নিন।
ফোন রাখতে রাখতে মেজর আদনানের ফোন আসলো। বললেন, সবকিছু জেনেছি ভাই। আপনারা রওনা দেন। বরিশাল RAB-এর একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ট্রলার যাবে আমাদের সাথে সাথে। আমার টিমের সদস্যরা ট্রলারে উঠেছে আগেই। আমরাও চড়ে বসলাম ট্রলারে। বেলায়েত সরদারকে সুকানিতে পাঠালাম। এদিকটা উনারা ভালো চিনেন। মংলা ঘাটের একটি দোকানে আগে থেকে চায়ের কথা বলা ছিলো। দৌড় দিয়ে ফ্লাস্ক ভরে চা নিয়ে আসলেন বশির। রওনা হলাম আমরা।
ভাটা চলছে নদীতে। তার মানে আমাদের নিচে নামাটা সহজ হয়ে গেলো। পশুর নদীতে উঠতেই ভাটা’র স্রোতকে সঙ্গে পেলাম। দ্রুত গতিতে ছুটে চললাম আমরা। সামনে আমাদের ট্রলার। অনুসরণ করছে RAB-এর ট্রলার। আধা ঘন্টার মধ্যে জয়মনিরঘোল অতিক্রম করে উঠলাম সেলা নদীতে। এখানে বন বিভাগের কয়েকটি অফিস আছে। আছে রেঞ্জ কার্যালয়। ওদিক থেকে টর্চ জ্বালিয়ে আমাদের থামতে বলা হলো। কিন্তু এই দফায় আমাদের হাতে একদম সময় নাই।
সেলা নদীর মাঝখান ধরে ট্রলার চালিয়ে গেলাম। সরদারকে বললাম, গতি বাড়ান। বন বিভাগের সাথে এখন কথাবার্তা বলার সময় নাই। বশির বলছিলেন যে একটু থেমে যাই। অফিসের জেটিতে ভিড়িয়ে কথা বলে না গেলে ওরা পিছন পিছন রওনা দিবে, ঝামেলা করবে। বললাম, উনাদের কাজ উনারা করুক। আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেংড়ার খালে ঢুকতে হবে।
সেলা নদীতে ঢুকতেই ডানপাশে নন্দবালা ফরেস্ট অফিস। একটু এগিয়ে হাতের বামে রেঞ্জ কার্যালয়। তারপর আধা ঘন্টা এগুলে বাম পাশে একটি খাল পড়ে যার নাম মৃগামারি। কয়েক বছর আগেও এখানে একটি বন টহল ফাঁড়ি ছিলো। বনদস্যুদের অত্যাচারে এই অফিসটি বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। জুলফু বাহিনী নামের যে দস্যুদলটি ছিলো তারা এই অফিসে এসে বসবাস করতো। একবার অপহৃত জেলেদের নিয়ে এই ফরেস্ট অফিসে এসে ওঠে দস্যুনেতা জুলফিকার। বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপত্তি জানালে সেখানে গোলাগুলি করে বসে জুলফু। আরও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছিলো। তারপর এই অফিসটি বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ।
মৃগামারী পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম। পিছন দিকটা খেয়াল রাখছিলাম। না, কেউ তাড়া করছে না। সাধারণত রাতের বেলা এই জঙ্গলে প্রশাসন বের হয় না। দস্যুরা বলে, দিনের বেলা সুন্দরবন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর রাতের বেলা থাকে চোর-ডাকাতের দখলে।
সামনে টেংড়ার খাল। সেখানে ঢোকার সময় পড়বে আরেকটি বন টহল ফাঁড়ী- আন্ধারমানিক। রাত তখন প্রায় একটা। বনরক্ষীরা ঘুমাচ্ছেন সম্ভবত। আমাদের খেয়াল করেননি। আন্ধারমানিকে ঢুকে পড়লাম। এবার বশিরকে নিয়ে গলুই-এ চলে গেলাম। সাধারণত বনদস্যুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বনদস্যুদের আলোর ইশারা ভালো করে খেয়াল করতে হয়। আবার ওরাও আমাকে দেখতে পেলে আশ্বস্ত হয়।
বড় খালটির মাঝ বরাবর চলছি। কোন পাশে যে ওরা আছে কে জানে? কতোক্ষণ চলতে হবে জানি না। তাই গলুই-এ বসে পড়লাম। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। পাশে দাঁড়ানো বশির। দুই পাশে পা ঝুলিয়ে বসে বসলাম। আমাকে ধরে বসে থাকলেন বশির। পিছন থেকে চা ভর্তি ফ্লাস্কটি পাঠালেন বেলায়েত সরদার। প্লাস্টিকের গ্লাস ভরে চা নিলাম।
ডান পাশ থেকে মনে হলো আলোর ইশারা এলো। উঠে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, বড় টেংড়া কি পার হইছি? বশির বললেন, বড় টেংড়া পার হইছি মেলাক্ষণ আগে। ডান পাশে যে আলো জ্বললো। ওরা কারা? বললেন, ওরা জেলে। আমাদের দেখে খালের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। এই আলো দস্যুদের সিগন্যাল না। তবে ওরা খুব কাছাকাছি কোথাও আছে।
(ছবি: টেংড়ার খাল, পূর্ব সুন্দরবন)