জঙ্গল থেকে উঠিয়ে নিলাম বনদস্যুদের | রূপান্তরের গল্প ২০৬ | Rupantorer Golpo 206 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২০৬ : রাত বাজে দেড়টা। আমার নির্ঘুম তৃতীয় রাত। শরীরটা ভেঙ্গে পড়ছে। একদম নিতে পারছি না। গলুই ছেড়ে উঠে আসলাম নিজে থেকে। ক্লান্তি থেকে পানিতে পড়ে যেতে পারি। চলমান ট্রলারে রাতের অন্ধকারে পড়ে গেলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে? সুকানি আরেক জনের হাতে দিয়ে পাশে এসে বসলেন বেলায়েত সরদার। বললেন, এখানে একটু শুয়ে পড়েন। মাথাটা বানায়ে দেই। বললাম, তাহলে তো ঘুমায়ে পড়বোনে! সরদার বললেন, আলোর সিগন্যাল দিলে ডেকে দিবোনে। আপনি একটু পিঠ লাগান। বশির দাঁড়ানো গলুই-এ। ট্রলারের সামনের দিকে কাঠের পাটাতনের উপর শুয়ে পড়লাম। দুই চোখ ভেঙ্গে ঘুম চলে এলো।
আধা ঘন্টার মতো বিশ্রাম হলো। ঘুম ভাঙ্গলো শোরগোলে। বশিরের চিৎকার শুনে উঠে বসলাম। দেখি খালের পশ্চিম পাশে কয়েকটি ছোট ছোট বাতি জ্বলছে। ইশারা দিচ্ছে দস্যুরা। লাফ দিয়ে উঠলাম। কয়টা বাজে এখন? বশির বললেন, রাত দুইটা। গলুই-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ততোক্ষণে ট্রলারের গতি কমে এসেছে।
আপনারা কারা? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম। ওদিক থেকে মনির সাড়া দিলেন। ভান্ডারী বললো, ও ভাই, এই যে আমরা এখানে, ভান্ডারী আমি। বললাম, সবাই বেঁচে আছেন? কেউ গুলি খাননি তো? মনির বললেন, গুলি খাইনি, তবে কাঁটা খাইছি আমরা। কাঁটা আর বাইড়ে পোকের কামড়ে শেষ অবস্থা। তাড়াতাড়ি আমাদের তুলে নেন। বললাম, চলে আসেন ট্রলারে। লিডার কোথায়? জঙ্গলের ভিতর থেকে বারেক তালুকদার বললেন, বেঁচে আছি ভাই।
ওদের পেয়েছি। একটা বড় দুশ্চিন্তা মাথা থেকে নামলো। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। রাত দুইটা বাজে। এদেরকে নিয়ে মংলা ফিরতে হবে। সেখান থেকে যেতে হবে বরিশাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে আসার আগে আমাদের সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
কী ব্যাপার? আপনাদের আসতে দেরি হচ্ছে কেন? ওরা বললো, আমরা তো জঙ্গলে দাঁড়ানো। সাথে কোনো নৌকা নাই।
বেলায়েত সরদারকে বললাম, ট্রলার নিয়ে কূলে ভিড়ান। সুকানিতে দাঁড়িয়ে তিনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু চর পড়ে গেছে এদিকটায়। আবার শেষ ভাটা বলে খালে পানিও নাই। তীর পর্যন্ত যাবে না ট্রলার। কী আর করা? পানি আর কাঁদা ভেঙ্গেই আসতে হবে ওদের। RAB-এর ট্রলারটি নিয়ে মাঝ খালে নোঙ্গর করতে বললাম। আমরা চেষ্টা করছি যতোট সম্ভব তীরের দিকে যেতে।
বনদস্যুরা কাঁদা পানি ভেঙ্গে এই পর্যন্ত এসেছে। যেখানে গোলাগুলি হয়েছে সেখান থেকে এই জায়গার দূরত্ব না হলেও পনেরো কিলোমিটার। সুন্দরবনের ভিতরে এই দূরত্ব বিশাল। বুঝতেই পারছি, ভীষণ ক্লান্ত তারা। অন্যদিকে এই অঞ্চল ভীষণ ঝুঁকির। বাঘ-কুমিরের চাপ আছে। তবে এই ভাটার সময় খালে কুমিরের আক্রমণের সম্ভাবনা কম। এসব নিয়ে আমরা ধারণাও কম। আমাদের ট্রলারের কর্মীরা সবাই মংলার। পর্যটকদের নিয়ে ঘোরাফেরা করে। সরদারের ট্রলার হলে এতোক্ষণে সহযাত্রীরাই নেমে পড়তো।
বেলায়েত সরদার ট্রলার নোঙ্গর করা নিয়ে ব্যস্ত। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বশির। জিজ্ঞেস করলাম এখানে পানি কতোটুকু? বললেন, এক হাঁটুর চেয়ে একটু বেশি। দেরি না করে নিজেই নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফোনগুলো পাশে রেখে নেমেও পড়লাম হুট করে।
কোথায় হাঁটু পানি? বুক পর্যন্ত ডুবে গেলাম। আমাকে নামতে দেখে লাফ দিয়ে বসলেন বশির। পিছন থেকে এসে সঙ্গী হলেন বেলায়েত সরদার। পানি এখানে হাঁটু পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু কাঁদা কোমড় পর্যন্ত। এই হলো সুন্দরবন। চোখে দেখা যায় অনেক সুন্দর। নামলে বোঝা যায় কতোটা কঠিন, কর্কষ এই বাদা-বন।
টেনে হিঁচড়ে পৌঁছে গেলাম কূলে। কাঁদা থেকে দুই দিক থেকে ধরে টেনে তুললেন সরদার ও বশির। জঙ্গলে উঠে দেখি সেখানেও কাঁদা। প্রায় কোমড় পর্যন্ত কাঁদায় আটকে আছে দস্যুরা। সেই বিকাল ৫টার দিকে গোলাগুলি হয়েছে। তারপর যে যেদিকে পারে ছুটেছে। দৌড়ানোর সময় কাঁটা আর শুলোয় (শ্বাসমূল) কেটে-ছিঁড়ে গেছে হাত-পা। টর্চ মেরে দেখি ওদের প্রত্যেকের সারা গায়ে বেড়ে পোকা। কামড়ে পুরো শরীর ফুলিয়ে ফেলেছে। এছাড়া গত আট ঘন্টা তারা খাবার ও পানি খায়নি। ক্লান্তিতে এক ধাপ এগুনোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে।
বেলায়েত সরদার এই সময়ও ঠাট্টা করে চলেছেন। বলছেন, ওরা তো ডাকাত। পোকায় খায় খাক। কিন্তু আপনাকেও তো খেয়ে ফেললো বাইড়ে পোকায়। আমার দুই হাতের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি পুরোটাই সেই পোকায় ভরা। উত্তেজনায় এর কামড় টের পাইনি এতোক্ষণ।
এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এমনিতেই সময় কম। তার ওপর এই কাঁদা ভরা বাদায় বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদও না। মনির, ভান্ডারী, বারেক তালুকদারসহ অন্য দস্যুদের নিয়ে হাঁটা দিলাম। বললাম ট্রলারে উঠে বাঁকী কথা হবে। ওদের সবাইকে নিয়ে জঙ্গল থেকে বের হলাম। ভাটার সময় বলে কষ্ট বেশি হলো। তবে দস্যুদের সবাইকে জীবিত পেয়ে ভালো লাগছে।
ট্রলারে উঠতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। সবাই উঠে পড়লো। কিন্তু আমি থেকে গেলাম নিচে। এই জায়গা থেকে ট্রলারে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব না। সরদার আর বশির আবার নেমে পড়লেন। তারপর মোটা দড়ি দিয়ে সিঁড়ির মতো কিছু একটা তৈরি করলেন। ধরে বেঁধে তোলা হলো আমাকে। সুন্দরবন আসলে দূর থেকে অনেক সুন্দর। কাছে থেকে ভয়ঙ্কর কর্কষ, কঠিন।
ট্রলারের গলুই-এ দাঁড়িয়ে গোসল সেরে নিলাম আমরা। হাত-পায়ের কাঁদা পরিস্কার করতে করতে কেটে গেলো আরও দশ মিনিট। বেলায়েত সরদারকে বললাম, RAB-এর ট্রলার ছাড়তে বলেন। এবার ওরা সামনে যাবে, পিছনে থাকবো আমরা। ইঞ্জিন চালু হলো, আমাদের ট্রলারও যাত্রা শুরু করলো। সুকানিতে এবার ট্রলারের মূল মাঝি। বেলায়েত সরদারকে বললাম, এদের জন্য একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
দস্যুনেতা বারেক তালুকদার বললেন, আমাদের একটু পানি খাওয়ান ভাই। এরপর হাতের বন্দুকটি নামিয়ে রাখলেন পায়ের কাছে, ট্রলারের পাটাতনের ওপর। গুলির ব্যাগটিও খুলে ফেললেন, রাখলেন বন্দুকের পাশে। সাথে সাথে দস্যুরা সবাই তাদের বন্দুক আর গুলিগুলো নামিয়ে রাখলো। একসাথেই বলে উঠলো, এই বন্দুকের ওজন আর বইতে পারছি না ভাই। এই অভিশাপের জীবন থেকে মুক্তি দেন।
নদীতে জোয়ার এসেছে। ট্রলার ছুটছে লোকালয়ের দিকে। হাজারও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সফল হতে যাচ্ছে আরেকটি আত্মসমর্পণ। দ্রুত ছুটতে হবে। সকালের মধ্যে পৌঁছাতে হবে বরিশাল।
(ছবি: আত্মসমর্পণের আবেদন পত্র তুলে দিচ্ছেন দস্যুনেতা বারেক তালুকদার)