দস্যুদের নিয়ে ছুটলো ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ২০৭ | Rupantorer Golpo 207 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২০৭ : ট্রলারের ওপর চলছে মহাযজ্ঞ। সারাদিনের গুমোট পরিবেশটি কেটে গেছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত বনদস্যুরা বন্দুক-গুলি রেখে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে কাঠের পাটাতনের উপর। আধো অন্ধকারে চেহারাগুলো দেখছি। ভাবছি অত্যাচারী এই মানুষগুলো কেমন জানি নিরীহ হয়ে পড়েছে। অসহায়ত্বের পুরোটাই দেখতে পাচ্ছি তাদের চোখে-মুখে। কেউ উঁচু স্বরেও কথা বলছে না।
বেলায়েত সরদার তাদের সেবা করছেন। পানি খাইয়ে এবার ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিচ্ছেন প্লাস্টিকের গ্লাসে করে। সাথে গামলায় মুড়ি আর চানাচুর মাখিয়ে রাখা। বনদস্যুরা গপগপ করে খাচ্ছে। আমাদের সরদার একাই জমিয়ে রেখেছেন পুরো ট্রলার। গত আধা ঘন্টার ঘটনায় আমি নিজেও ক্লান্ত। আগের ক্লান্তি তো রয়েই গেছে। ভাবছিলাম একটা ঘুম দিবো। কিন্তু এই মুহুর্তে আনন্দে আমার ঘুম আসছে না।
গল্পে বসলাম দস্যুদের সাথে। এবার তাদের মুখে জানলাম পুরো ঘটনা। বারেক তালুকদারকে বললাম, কী হয়েছিলো বলেন তো ভাই? বললেন, বড় টেংড়া খালের মুখেই ছিলাম আমরা। আপনি ফোন দিয়ে সাবধান করলেন। বিশ্বাস করিনি। ভাবছিলাম আমাদের তাড়াতাড়ি উঠানোর জন্য হামলা হতে পারে সেই কথা বলেছেন আপনি। এরপর আদনান স্যার ফোন দিলেন যখন তখন বুঝলাম বিষয়টি সিরিয়াস। দিনের বেলা জায়গা পরিবর্তন করা আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা। কিন্তু ততোক্ষণে দেরিও হয়ে গেছে।
দস্যুনেতা বলছেন, ভাটার সময় ছিলো বলে ভিতরের খাল-ভাড়ানী ধরে সরে যেতে পারিনি। বড় টেংড়া থেকে জঙ্গলের কোল ধরে নৌকা বাইলাম। তারপর যেখানে গেলাম সেখানে কয়টা জেলে নৌকা ছিলো। আমরা যেতে যেতে সরে পড়লো তারা। ভাবলাম ওরা চলে যায় যাক। আজকে তো উঠেই পড়বো, পাত্তা দেইনি। পাশ থেকে মনির বললেন, ওরাই প্রশাসনকে খবর দিয়ে দিছে।
বললাম, এতো কিছুর পরও আমার কথা বিশ্বাস করলেন না আপনারা? মনির বললেন, আমাদের লিডার একটু বেশি বোঝে ভাই। তাকে আমি বার বার বলছি যে বিষয়টা সিরিয়াস। সে পাত্তা দেয়নি। ভাগ্যিস খালের মুখে কয়েকটা গাছ পড়া ছিলো। আবার ভাটাও হয়ে আসছিলো। সেজন্য খালের ভিতরে ঢুকতে পারেনি তারা।
বড় নদী থেকে ব্রাশফায়ার করেছে। গুলির রেঞ্জ-এর বাইরে ছিলাম বলে মরিনি আমরা। বললাম, খালের গোঁড়ায় কোনো পাহাড়া ছিলো না? মনির বললেন, পাহাড়া ছিলো বলেই তো পালানোর সময় বন্দুক, গুলি আর মোবাইল ফোনগুলো নিতে পারছি। নৌকা বেয়ে ভিতরে যাওয়ার উপায় ছিলো না তখন।
বারেক তালুকদার বললেন, সবকিছু নিয়ে পালাইছি। শুধু একটা জিনিষ নিতে পারিনি। আপনার জন্য এক হাঁড়ি শিং মাছ রাখছিলাম। সেই পাতিল নৌকায় ছিলো। প্রশাসন সেই মাছগুলোও নিয়ে গেছে। বললাম, ভালো হয়েছে। কিন্তু শিং মাছ কেন? এখানে তো লবণ পানির মাছ থাকার কথা! তখন ছোট টেংড়ার খাল থেকে বড় টেংড়া খালে উঠে পড়েছি আমরা। আরেকটু এগুলেই আন্ধারমানিক। তারপর সেলা নদী হয়ে উঠে পড়বো পশুর নদীতে।
বশিরের কাছে জানলাম, সুন্দরবনের এই অঞ্চলে একটি বিল রয়েছে। টেংড়ার বিল নামে পরিচিত এই জলায় দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। পূর্ব বাদায় এরকম আরও কয়েকটি বিল আছে। পশুর নদীর পশ্চিমে আছে আন্ধারিয়ার বিল। এই জলাশয়গুলো সুন্দরবনের ভিতরে কী ভাবে গড়ে উঠেছে জানি না। তবে এই জলাগুলো দখলের লড়াই চলে মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বনদস্যুরা নিয়ন্ত্রণ করে এসব।
মহাজন, বনদস্যু আর বন বিভাগের সমঝোতায় জেলেরা মাছ ধরতে যায় এখানে। যদিও বিলগুলো সব অভয়াশ্রম। মাছ ধরা নিষেধ, প্রবেশও নিষেধ। বললাম, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু এখানে মিঠা পানির মাছ কেন?
জানলাম, বছরের বেশির ভাগ সময় সুন্দরবনের পূর্ব দিকের পানি মিষ্টি থাকে। বর্ষার শুরু থেকে এদিকের নদীগুলো উজান থেকে নেমে আসে বৃষ্টির পানি নিয়ে। এছাড়া সুন্দরবন উপকূলেও প্রচুর বৃষ্টি হয়। তাই এদিকের খাল নদীতে সাগরের লবণ পানির চাপ থাকে কম। অন্যদিকে বিলগুলোর অদ্ভুত ভাবে এক রকমের স্বকীয়তা আছে, প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছে সেটি।
মূল নদী-খাল থেকে বেশ ভিতরের এই বিলগুলোতে চাইলেই ঢোকা যায় না। বেশ খানিকটা পথ সরু খাল দিয়ে বেয়ে যেতে হবে। বশির বললেন, আন্ধারিয়া বা টেংড়ার বিল-এ অজগর সাপও দেখা যায়। বিশাল বিশাল কুমির আর নানা প্রজাতির সাপে ভরপুর এই জলা। বড় গাছ নাই বললেই চলে। কই, মাগুর, শিং মাছের মতো দেশি প্রজাতির মিঠা পানির মাছ হয় এখানে। পাওয়া যায় সুন্দরবনের মাছও।
গল্পে গল্পে অনেকটা পথ এগিয়েছি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আন্ধারমানিক। বন বিভাগের অফিস থেকে কেউ টর্চ জ্বালিয়ে ইশারা দিচ্ছে। আমি পাল্টা ইশারা দিয়ে ডানে মোড় নিলাম। সেলা নদীতে জোয়ার লেগেছে ঘন্টা খানেক আগে। তীব্র স্রোতের সাথে চলছে দুটি ট্রলার। পর পর ট্রলার দেখে সম্ভবত ওরা ধারণা করেছে কিছু। তাই আলোর ইশারা দিয়ে আমাদের চলে যেতে বলা হলো।
বিশ্রাম নিয়ে এখন একটু নড়েচড়ে বসেছেন দস্যুনেতা বারেক তালুকদার। খুব মন খারাপ। বললেন, আমরা ছোট পার্টি। আপনাকে বিশেষ কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নাই। তাই জেলেদের কাছ থেকে বড় এক হাঁড়ি শিং মাছ কিনে রাখলাম। আপনাকে দিবো বলেই রাখছিলাম। কিন্তু সেই মাছ তো বাঁচাতে পারলাম না।
বললাম, জঙ্গলের অর্জিত আপনাদের সবকিছুই জুলুমের। বুঝলাম কিনে নিয়েছেন জেলেদের কাছ থেকে। কিন্তু যে টাকা দিয়ে কিনেছিলেন সেই টাকা কি বাড়ি থেকে আনা? উত্তরের অপেক্ষা করলাম না। শুধু বললাম, এ পর্যন্ত যে অত্যাচার নির্যাতন করেছেন সেই পাপের শাস্তি কতোদিন টানবেন জানি না। কিন্তু এই যে আজ থেকে আপনাদের দস্যুতা বন্ধ হলো, এটাই পাওয়া। বাড়ি ফিরে ভালো হয়ে চলবেন, আমি তাতেই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। এসময় একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো।
পশ্চিমের এক বনদস্যু দলের সাথে দেখা করে ফিরছিলাম। উপহার হিসাবে অনেকগুলো গলদা চিংড়ি জোর করেই তারা উঠিয়ে দিলো। পাগড়াতলী-মাটিয়া খাল থেকে বের হলাম। ট্রলারের সামনে রাখা সেই টুকরিটি। শীতকাল ছিলো বলে নদী বেশ ঠান্ডা। আড়পাঙ্গাসিয়া নদী অবশ্য সারা বছরই কম-বেশি উত্তাল থাকে।
ট্রলারের সহযাত্রীরা মাছগুলো বড়ফে দিবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এসময় হঠাৎ করেই একটা বড় ঢেউ আসলো। ট্রলার দুলে উঠলো, নদীতে পড়ে গেলো বিশাল বিশাল গলদা চিংড়ি ভর্তি সেই টুকরি। এখানে পানি সম্ভবত দেড়-দুইশ হাতের কম না। সবাই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, কেউ হায় হায় করে উঠলো, মন খারাপ সবার। পিছনে বসে আমি হাসছিলাম। একজন এসে পাশে দাঁড়ালো। বললাম, যেটা গেছে যেতে দাও। এই মাছ আমার বাসায় যাবে না, কিছুতেই না। আল্লাহ এই খাবার আমাকে বা আমার পরিবারকে খাওয়াবে না, বুঝছো?
রাতের অন্ধকারে আমরা এগিয়ে চলছি। শেষ এক কাপ চা দিলেন সরদার। বললাম, চা এখনও আছে? বললেন, আপনার জন্য এক কাপ না রাখলে হয়? সেলা নদী পারি দিয়ে উঠলাম পশুর নদীতে। এই নদীতেও তীব্র স্রোত। জোয়ারের চাপে তড়তড় করে এগিয়ে চলছি আমরা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মংলায়। দুটি দস্যুদলের সদস্যদের নিয়ে RAB রওনা দিলো বরিশালের উদ্দেশ্যে। পিছনে আমরা। গাড়িতে বসে একটা ঘুম দিলাম। তিন রাত পর সেই ঘুমটি অনেক জরুরি ছিলো।
এদিকে মংলায় চাউর হয়ে গেছে একটি খবর। বনরক্ষীদের গোলাগুলিতে নাকী মারা পড়েছে শান্ত বাহিনীর প্রধানসহ কয়েকজন। RAB নাকী গেছে সেই লাশ উদ্ধারে। অবশ্য পরদিন দুপুর পর্যন্ত কেউ জানতেও পারেনি যে দস্যুদের নিয়ে আমরা চলে গেছি বরিশালে। টেলিভিশনে শান্ত ও আলম বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর দেখে ঘুম ভাঙ্গলো তাদের।
হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো একটি মহল। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া বন্ধে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা ডেকে পাঠালেন মংলার সোর্সদের। আবারও ভয়ে এদিক সেদিক পালিয়ে গেলো সেই সোর্সরা। এই সোর্সগুলো আমার কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই এরা দূরে থাকলে, বিচ্ছিন্ন থাকলে কাজ আগাতে সুবিধা হয়।