আত্মসমর্পণ করলো বনদস্যুরা, অস্ত্র জমা দিলো শান্ত ও আলম বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ২০৮ | Rupantorer Golpo 208 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২০৮ : আবারও আত্মসমর্পণ। এবার সুন্দরবনের দুটি দস্যু দল- আলম ও শান্ত বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। বরিশালে RAB এর কার্যালয়ে এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ জন বনদস্যু-জলদস্যু অস্ত্র জমা দেয় ২০টি। তারা গুলি জমা দিয়েছে এক হাজারের বেশি। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বরের এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ ৫টি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করে। এর আগে দুই দফায় মংলায় ৫২টি অস্ত্র ও প্রায় পাঁচ হাজার গুলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবনের বনদস্যু মাস্টার বাহিনী। ১৪ জুলাই ২০১৬ বনদস্যু ইলিয়াছ ও মজনু বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তারা ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ হাজার ২০টি গুলি জমা দেয়।
বারেক তালুকদার, আলম সরদারসহ বনদস্যুরা একে একে অস্ত্র জমা দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে। এই নামধারী জলদস্যুদের সামনা সামনি দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইন শৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বেশ অবাক হলেন। এতো নাম-ডাক ওয়ালা দস্যুদের বেশভুষা এমন কেন? এদের দেখে কিছুতেই মনে হয় না কোটি কোটি টাকার কারবার চলে এদের ঘিরে। গোয়েন্দা তথ্য এদের সবাইকে ডাকসাইটে বনদস্যু বলা হয়েছে। সারেন্ডারের আগে আগে এদের বাড়ি-ঘর ও অর্থ সম্পদের খোঁজ খবর নিয়েছে গোয়েন্দারা। তাতে বলা হয়েছে এই ১৪জন বনদস্যুর কারও অঢেল সম্পদ নাই। বরং এক একজনের আর্থিক অবস্থা অতি করুণ। দিনের খাবারটুকুও থাকে না এদের বেশির ভাগ পরিবারের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের দেখে বন-উপকূলের দস্যুতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। দস্যুতা করে কামানো অর্থসম্পদ তাহলে কোথায় যায়? এমন প্রশ্নও করেন তিনি। এদের পৃষ্ঠপোষক, অস্ত্র-গুলির যোগান দাতাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন তিনি। বনদস্যু নেতা বারেক তালুকদার বলেন, একটু খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার সুযোগ চান তাঁরা।
আত্মসমর্পণ করে বারেক তালুকদার ওরফে শান্ত বলেন, ‘ভুল পথে থেকে প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। একদিকে শুধু বদনাম হয়েছে, অন্যদিকে ছিলো ফেরারি জীবন। পরিবার নিয়ে এখন শুধু স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ চাই। একই অনুভূতির কথা জানান আলম বাহিনীর প্রধান আলম সরদারও। অতীতের অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চান এই বনদস্যুরা।
বরিশালে আয়োজিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচার হয় যমুনা টেলিভিশনে। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যস্ততা করতে গিয়ে এবার বেশ ক্লান্ত আমাদের পুরো টিম। সুন্দরবনের দুই প্রান্তের দুই দস্যুদলকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একসাথে নিয়ে আসাটাই কঠিন। তার ওপর শান্ত বাহিনীকে নিয়ে যা হলো! আত্মসর্পণের আনুষ্ঠানিকতার সময় ক্লান্তি কাটিয়ে পুরোটা সময় থাকতে পারিনি। সংবাদ প্রচারে সহযোগিতা করলো যমুনা টেলিভিশনের বরিশাল টিম। অনুষ্ঠান শেষে বিদায় নেওয়ার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুঁজেছেন আমাকে। সেদিন আর দেখা করার অবস্থায় ছিলাম না। পরে RAB-এর সিনিয়র কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমার কাছে সেই ধন্যবাদ বার্তা আসে।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে দস্যুদের নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। নতুন একটি অস্ত্র মামলা হয়। যেহেতু সাধারণ ক্ষমা না, তাই অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি মামলার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়। এছাড়া আইনগত কোনো পথ খোলা নাই। অবশ্য এই মামলাটি নিয়ে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুতের আপত্তি নাই। তাদের একটাই চাওয়া, আর তাড়ার ওপর থাকতে চাই না। মামলা নিয়ে জেলখানায় থাকলেও অন্তত ঘুমাতে পারবো। আর মামলা এক সময় শেষ হবে। সরকার মামলা প্রত্যাহার করবে বলে কথা দিয়েছে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও কারও আপত্তি নাই।
শান্ত ও আলম বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি আমরা গোপন রেখেছিলাম। নানা কারণে বিষয়টি অতি স্পর্শ্বকাতর। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরোধীতা এমন এমন জায়গা থেকে হচ্ছিলো যে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। দস্যুতার সুবিধাভোগীরা এটি চাইবে না। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা বিভিন্ন জায়গায় এবিষয়ে নেতিবাচক খবর ছড়াচ্ছিলো। কেউ বলতো RAB-এর এই উদ্যোগ পুরোটাই নাটক।
কেউ বলেছে এই সাংবাদিক কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এমন সব অপপ্রচারে সাংবাদিকরাও বিভ্রান্ত। এছাড়া বন উপকূলের কিছু সাংবাদিক পরশ্রীকাতর হয়ে এই অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। ফলে কোনো একটি দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করানোর আগে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায়ে রাখার চেষ্টা করি। সবশেষ শান্ত বাহিনীকে নিয়ে যা হলো, তারপর এই উদ্যোগটি আমি চালিয়ে যাবো বলে মনে হচ্ছে না। আলম ও শান্ত বাহিনীর সারেন্ডারের পর আর এনিয়ে কাজ করবো না বলেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বরিশাল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বারেক তালুকদারের ছোট মেয়েটা আসলো। খুব খুশি সে। জীবনে ফেরা অন্যদের স্ত্রী-সন্তানরাও খুশি। জেলখানায় থাকলেও বেঁচে তো আছে। অন্তত প্রতি মুহুর্ত স্বজন হারানোর আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হবে না তাদের। এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা। আত্মসমর্পণের এই প্রক্রিয়া কি আরও এগিয়ে নিবো? না কী এখানেই শেষ করবো আমার কাজ? ভয়ঙ্কর জটিল-কুটিল আর ঝুঁকির এই কাজ আরও করবো? না কী ঢাকায় দুশ্চিন্তামুক্ত সাংবাদিকতার জীবনে ফিরে যাবো?
সুন্দরবন কখনও দস্যুমুক্ত হলে শুধু সুন্দরবন না, পুরো বঙ্গোপসাগর উপকূলের কোটি মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে। বেঁচে যাবে অনেকগুলো প্রাণ। রক্তক্ষরণ ছাড়াই একটি সংগঠিত অপরাধের চক্র বিলুপ্ত হবে। হয়তো আমার নাম হবে না। হয়তো অপপ্রচারের বদনামগুলোই সামনে চলে আসবে। হয়তো পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারই বেশি হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নিজেকে নিরাপদ রাখবো? না কী বারেক তালুকদার-মাস্টারদের সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর কাজটি চালিয়ে যাবো?
বিকালের মধ্যে থানায় পৌঁছে দেওয়া হলো আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের। মামলা হলো। এরপর পাঠানো হলো বাগেরহাট জেল হাজতে। বনদস্যুদের পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফিরলো। জেল গেইট-এ পরদিন দেখা করে আমরাও ঢাকার পথ ধরলাম। ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদ। বললেন, দারুণ হচ্ছে সবকিছু। এই কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। বললাম, ক্লান্ত আমি।
পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে ছাপানো হলো সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের খবর। তবে কোথাও নাই এই প্রক্রিয়ার মধ্যস্ততাকারী মোহসীন উল হাকিমের নাম। সেদিন বিবিসি লন্ডন অফিস থেকে ফোন আসলো। ওপাশ থেকে আন্তর্জাতিক এই সংবাদ মাধ্যমের জ্যেষ্ঠ প্রযোজক মাসুদ হাসান খান বললেন, জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করতে চায় বিবিসি।
(ছবি: অস্ত্র জমা দিলো আলম ও শান্ত বাহিনী। বরাশাল। ৮ মে ২০১৬)