দস্যু যায়, দস্যু আসে, জঙ্গল দখলে চলে নতুন লড়াই | রূপান্তরের গল্প ২০৯ | Rupantorer Golpo 209 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২০৯ : সহকর্মীরা আপ্লুত। অফিসে ফিরতেই সবাই অভিনন্দন জানালেন। নিউজরুমে ঢুকতেই পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। একজন মাঠের সাংবাদিকের জন্য এটি সবচেয়ে বড় পুরস্কার। সহকর্মীদের হাত তালি পাওয়া সৌভাগ্যের। জীবনে কয়েকবার সেই পুরস্কার জুটেছে ভাগ্যে। বনদস্যু শান্ত বাহিনী ও আলম বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে আমার প্রতিষ্ঠান- যমুনা টেলিভিশন।
মুহুর্তেই গত কয়েক দিনের কষ্ট-যন্ত্রণার কথা উড়ে গেলো। ঢাকা ফিরে পুরো একদিন ঘুমিয়েছি। শরীরটা চাঙ্গা। সেই সাথে সহকর্মীদের উৎসাহ মানষিক ভাবেও উদ্দীপ্ত করলো। সুন্দরবনে আর ফিরবো না এমন সিদ্ধান্ত এক বেলাতেই বদলে গেলো। নিউজ রুমের প্রধান ফাহিম আহমেদ বললেন, কাজ চালিয়ে যান।
সুন্দরবন থেকে একের পর এক ফোন আসে এখন। যাদের রীতিমতো হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পেতাম না, সেই দস্যুরা অনেকেই ফোন দেয়। পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুনেতা আলিফকে বলি সারেন্ডার করো। সে বললো, একটু সময় লাগবে। অস্ত্র কেনাকাটায় অনেক টাকা নাকী বাঁকী পড়েছে। সেই টাকা পরিশোধ না করে বাড়ি ফিরতে পারবে না। আলিফ আমাকে কখনও ডাকে আব্বাজান, কখনও বাপজান। শুনেছি এই আলিফকে দেখেই জেলেরা ভয় পায়। বড় দাড়ি-মোচসহ অদ্ভুত সেই চেহারা। জঙ্গলের জেলেরা তাকে দয়াল নামেও ডাকে।
সেপ্টেম্বরে আর সুন্দরবনে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। আলিফকে বলেছি, সামনের মাসে তোমাকে সারেন্ডার করতে হবে। তবে সে ধরা দেয় না।
নোয়া মিয়া তখন বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটা করেছে। খুলনা থেকে গুলি কিনেছে। শুনলাম, ভারত থেকে একটি বন্দুক কিনেছে তারা। থ্রি নট থ্রি’র চেয়েও কার্যকর সেই বন্দুক। কয়েকশ’ গুলিও আনিয়েছে তারা। নোয়া মিয়াকে বললাম, সারেন্ডারই যখন করবেন তখন নতুন করে এসব কেনাকাটা করছেন কেন?
নোয়া মিয়ার মতলব ভালো না। নতুন করে দস্যুদলের শক্তি বাড়াচ্ছে সে। পুরনো দস্যুদের অনেকে ভিড়েছে সেই দলে। শুনেছি, মাইজে ভাই নামে খুলনার এক পুরনো জলদস্যু তাকে অস্ত্র-গুলি জোগাড় করে দিচ্ছে। প্রথম যেবার রাজি বাহিনীর সাথে দেখা করতে যাই, সেবার খুলনার রূপসা থেকে আমাদের নিয়ে যায় এই বনদস্যু। মাইজে ভাই দারুণ ভাবে সুন্দরবনেও থাকতো, আবার সময় সময় লোকালয়েও থাকতো। নিজেকে লুকিয়ে রাখার কৌশল জানতো সে।
নোয়া মিয়া প্রায় প্রতিদিনই ফোন দেয়। আমি বলি সারেন্ডার করেন। উনি বলেন, মেশিন-পত্র কিনতে গিয়ে মেলা টাকা দেনা হয়ে গেছে। বললাম, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের এই টাকা শোধ না করলে সমস্যা কোথায়? সারেন্ডার করবেন। তখন কি আর পাওনা টাকা নিতে আসবে কেউ? দস্যুনেতা বললেন, আত্মসমর্পণ করলে হয়তো সরকার ছাড় দিবে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ছাড়বে না কিছুতেই।
এদিকে পশুর বাওনে নাকী নতুন একটি দস্যুবাহিনী নেমেছে। লোকালয়ের কাছ থেকে জেলেদের ধরে নিয়ে যায় তারা। সুন্দরবনের মধ্যাঞ্চল পুরো গরম। সাগর বাহিনী নাম। দস্যুদলটি খুব বড় না। কিন্তু ঘন ঘন অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। RAB, কোস্টগার্ড, পুলিশ, বন বিভাগ ব্যতিব্যস্ত এই সাগরকে নিয়ে।
খুলনা জেলখানায় এই দসুনেতার পরিচয় হয় এক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে। জেলখানায় বসেই তিনি সাগরকে দস্যুতায় নামার পরামর্শ দেন। বলেন, অস্ত্র-গুলি তিনিই সরবরাহ করবেন। কিন্তু সাগরের তো টাকা নাই। ওই বড় ভাই বলেছেন, ডাকাতি করে অস্ত্রের দাম কিস্তিতে দিলেই চলবে। জামিন নিয়ে বের হয়ে সাগর সোজা জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। সময় মতো তাকে অস্ত্র সরবরাহ করে সেই গডফাদারের লোকজন।
সাগরের আসল নাম আলমগীর। বাড়ি মংলায়। তার সঙ্গীরাও সবাই মংলা’র বিভিন্ন গ্রামের যুবক। সুন্দরবনের করমজল থেকে মরাপশুর পর্যন্ত চলাফেরা করে তারা। পশ্চিমে ঝাপসি, ভদ্রা পর্যন্ত তাদের দৌড়। সারাদিন জোংড়া খালের ভিতরের ছোট ছোট খালের আগায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে ওরা। টগিরবগির খালটি তাদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। আমার এক সোর্স বললো, সাগর আমাকে খুঁজছে।
পূর্ব সুন্দরবনের আরেকটি দস্যুদল বেশ গরম করে রেখেছে সেলা নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে পশুর নদীর পূর্ব পাশ পর্যন্ত। দক্ষিণে ঘসিয়াঙ্গাড়ী খাল পর্যন্ত তাদের চলাফেরা। বড় সুমন বাহিনী নামে দলটির সবার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ-এর পঞ্চগড়ন। শুনেছি বেশ দুর্ধর্ষ তারা। যোগাযোগ হয়নি তাদের সাথে।
মধ্য সুন্দরবনে বেশ আয়েশী সময় পার করছে জাহাঙ্গীর। অস্ত্র-শস্ত্র আর লোকবলে এই মুহুর্তে (২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) সবচেয়ে মজবুত দস্যুবাহিনী। মাস্টার বাহিনী, মজনু-ইলিয়াসের আত্মসমর্পণের পর সুন্দরবনে তাকে ঠেকানোর কেউ নাই। একবার মাস্টার বাহিনী আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে তাদের। ট্রলারসহ কয়েকটি অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলো তারা।
মাস্টার বাহিনীর তাড়া খেয়ে তিন/চারদিন জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছে সে। সাথে স্ত্রী-সন্তান ছিলে বলে মহা বেকায়দায় পড়েছিলো তারা। এরপর বড় দস্যুদলগুলো আত্মসমর্পণ করে। কয়েক মাস আগেও যে দস্যুদলটি অন্য দলের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো, লুকিয়ে লুকিয়ে চলতো, সেই জাহাঙ্গীর বাহিনী এখন সবচেয়ে দাপুটে দল। মধ্য সুন্দরবন কাঁপিয়ে বেড়ায় তারা। মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগরেও দস্যুতা করতে যায় তারা।
দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর ইদানিং বেশ গরম। তার সাথে কথা হয় না। তবে তার ভাগনে বাছের কথা বলে নিয়মিত। সোর্সরা বলে এই দস্যুদলটি এখন সোনার খণি। লোকালয়ের দস্যুদের মাছ ও টাকার যোগান দেয় এরা। শুনেছি জাহাঙ্গীর আমার নামেও টাকা পাঠায়। শুনি, তবে নিশ্চিত না। এটুকু নিশ্চিত যে সে আমাকে একদমই পছন্দ করে না।কোনো দিন সারেন্ডারও করবে না।
মোশাররফ আর ছোট সুমন মিলে ডাকাতি করছে পশুর নদীর বাওনে। পশুরের এপার ওপারে তারা ছোট ছোট নৌকাগুলোকে ধরে, জেলেদের জিম্মি করে, মাছ-কাঁকড়া কেড়ে নেয়। বেশ জ্বালাচ্ছে তারা।
এদিকে খোকা বাবু নামের এক পুরনো দস্যু পশ্চিম সুন্দরবনে নেমেছে। গাবুরার কয়েকজনকে নিয়ে লোকালয় ঘেঁষা জঙ্গলে দস্যুতা করে তারা।
পাঁচটি দস্যুদল আত্মসমর্পণের পরও এতোগুলো দস্যুদল সুন্দরবনে আছে? অনেকের মনেই প্রশ্ন, তাহলে কাজের কাজ হচ্ছে না? সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বলা হচ্ছে, একটি দল সারেন্ডার করছে, আরেকটি দল নামছে। সুন্দরবনে দস্যুমুক্ত থাকছে না কোনো অঞ্চল। একই প্রশ্ন করলেন RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান। বললাম, রূপান্তরের তো কেবল শুরু। হতাশ হবেন না। গডফাদারদের কাছে পরাজিত হবেন না। অবৈধ অস্ত্র-গুলি বিক্রি আর সুন্দরবনের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের বনদস্যু প্রয়োজন। ফেরারি অপরাধীদের তারা ব্যবহার করছে। কিন্তু একটানা আত্মসমর্পণ চালিয়ে গেলে দেখবেন একদিন গডফাদাররাও ক্লান্ত হবে। অবৈধ আয় রোজগারের জন্য তারা অন্য পথ ধরবে। কর্নেল আজাদ বললেন, আপনার অভিজ্ঞতা ও মতামতের প্রতি আস্থা আছে। কিন্তু এই কথা তো সিনিয়রদের বুঝাতে পারছি না। বললাম, চেষ্টা করেন।
আসলে বনদস্যুদের দিয়ে সুন্দরবন দখলে রাখার এই অপচেষ্টা চলতেই থাকবে। বসে বসে অনেক টাকা রোজগারের ক্ষেত্র এই সুন্দরবন। ওদের পরাজিত করতে হলে লেগে থাকতে হবে। আমি লেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেজর আদনান কবীরকে ফোন করে বললাম, আমি কাজ চালিয়ে যেতে চাই। তিনিও বললেন, চলবে ভাই, চলবে।
(ছবি: আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের অস্ত্রশস্ত্র)