রূপান্তরের গল্প ২১০ | Rupantorer Golpo 210

ফেরারি বাবারা ঘরে ফিরেছে | রূপান্তরের গল্প ২১০

ফেরারি বাবারা ঘরে ফিরেছে | রূপান্তরের গল্প ২১০ | Rupantorer Golpo 210 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২১০ : খবরদার সারেন্ডারের কথা বলবা না। আমার দলের সদস্যদের কেউ সারেন্ডারের আশায় থাকলে তার খবর আছে! তোমাদের উঠায়ে দিবো, প্রশাসসনের হাতে উঠায়ে দিবো… জঙ্গলে বসে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর তার সদস্যদের হুসিয়ার করে দিচ্ছে এভাবেই। সুন্দরবনের দস্যু জগতে জাহাঙ্গীর পরিচিত নাটা জাহাঙ্গীর নামে। কারণ এই নামে আরও কয়েকজন পুরনো দস্যু ছিলো সুন্দরবনে। একটু খর্বাকার হওয়ায় তাকে এই নাম দিয়েছিলো পুরনো দস্যুনেতা রাজু।

আমার সাথে তার সম্পর্ক বেশ খারাপ। একবার বেশ বকাঝকা করেছিলাম। অবশ্য দস্যুদের মধ্যে যাদের সঙ্গে পুরনো পরিচয়, তাদের মধ্যে এই জাহাঙ্গীর একজন। সম্পর্ক ভালোই ছিলো।

মংলা’র এক সোর্স ফোন করে বললো, সুন্দরবনে ঢুকলে জাহাঙ্গীর থেকে সতর্ক থাকবেন ভাই। ও আপনার ক্ষতি করতে পারে। বললাম, ওকে কবে সারেন্ডার করাবো সেই কথা ভাবছি। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে আমাকে এই বাহিনীর নাম বলেছেন।

এই দস্যুদলটির নামে জেলেদের অত্যাচার নির্যাতনের খবর বেশি, গোয়েন্দা তথ্যেও নাকী জাহাঙ্গীর বাহিনীর নামে বিশেষ চিঠি ইস্যু হয়েছে। মন্ত্রী বলেছেন, জাহাঙ্গীরকে সারেন্ডার করাও। অবশ্য সেই সোর্সকে এসব কথা বলিনি। শুধু বললাম, আপনার এই ভাইকে বলবেন, দ্রুত সারেন্ডার করতে। সরকার কিন্তু তার বিরুদ্ধে সামনে বড় অভিযান শুরু করবে। অন্য দস্যুরাও কিন্তু ছাড়বে না তাকে।

নাটা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা অনেক। ভয়ঙ্কর এই বনদস্যুর বিয়ের বিষয়ে দূতিয়ালী করেছি আমি। বছর দুই আগে ফোনে নিয়মিত কথা হতো। একদিন জাহাঙ্গীর বললো, তার প্রেমিকার নাম ময়না। দীর্ঘ সম্পর্ক। তবে এখন কথা শুনছে না। বললাম, আপনি দস্যুতা না ছাড়লে উনি কেন আপনাকে বিয়ে করবেন? টেলিফোনে কনফারেন্স এ তিনজনে মিলে কথা বলেছি। জাহাঙ্গীর দস্যুতা ছাড়ার কথা দিয়েছিলো। তারপর তাঁরা বিয়ে করেন। অবশ্য পুরো বিষয়টি গোপনে করা হয়। আমাকে জানানি তাঁরা।

এটিও জানতাম না যে জাহাঙ্গীর বিবাহিত, সন্তানও আছে। বিষয়টি কেন গোপন রেখেছে সে, এবিষয়েও অসন্তুষ্ট ছিলাম। সবশেষ ২০১৬ সালের শুরুর দিতে মাস্টার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়ে মাস্টার বাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ হয় সে। মাস্টারের সুসম্পর্কের কারণেও আমার প্রতি নেতিবাচক ছিলেন তিনি। অবশ্য তার দলের অন্যরা সারেন্ডার করতে চায়। এবিষয়ে নিরিবিলি কিছু কথা বলতে চায় জাহাঙ্গীরের ভাগনে, সেই দস্যুদলের উপ প্রধান বাছের। বললাম, সময় করে কথা হবে।

ঢাকায় বসে সুন্দরবনের প্রায় সবগুলো দস্যুবাহিনীর প্রধান ও সদস্যদের সাথে নিয়মিত কথা বলি। নানা বিষয়ে কথা হয়। তবে সবাইকে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকি, সারেন্ডার করতে বলি। এই পর্যায়ে এসে কিছু বিষয় সহজ হয়েছে। আবার কিছু বিষয়ে জটিলতা বেড়েছে, নতুন কিছু সংকটের মুখেও পড়তে হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো, সুন্দরবনের ভিতরের সক্রিয় দস্যুদের নানা ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে, অনেককে লোভ দেখানো হচ্ছে। একই সঙ্গে আমার বিষয়ে অপপ্রচারও বেড়েছে অনেক বেশি। দস্যুদের মধ্যে বিষয়টি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তবে জাহাঙ্গীর ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তবে আমি বিচলিত নই। এসব নিয়ে ভাববার সময় আছে। আপাতত সারেন্ডার করা দস্যুদের সময় দিতে হবে, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে।

এদিকে আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের দেখভাল করছে সরকার। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ খবর রাখছেন। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নিজেও খোঁজ নিচ্ছেন। অন্যদিকে RAB আন্তরিকতার সাথে সাবেক বনদস্যুদের খোঁজ রাখছে। মামলা পরিচালনার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। আবার সারেন্ডার করা দস্যুদের পরিবারের খোঁজ খবরও রাখছে। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন তাঁরা। কখনও খাবার-দাবারও পৌঁছে দিচ্ছে RAB।

বিষয়টি বেশ ভালো কাজ করছে। সাবেক বনদস্যুদের সমাজের মূল স্রোতে মিশতে সাহস যোগাচ্ছে, উৎসাহিত করছে।

জেলখানায় থাকার কারণে আত্মসমর্পণ করা শান্ত ও আলম বাহিনীর দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ নাই। তবে পরিবারের সদস্যরা ফোন করছেন। জানতে পারছি যে, বেশ খারাপ সময় যাচ্ছে তাদের। আমি একজন ব্যক্তি হিসাবে তেমন কিছু করতে পারি না। তাই সশরীরে আবারও বাগেরহাট জেলখানায় গেলাম।

কিছু করতে না পারলেও আমাকে পেয়েই বেশ খুশি তারা। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যরা মনে সাহস পাচ্ছেন। ঘুরতে ঘুরতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাদের প্রতিবেশিদের সাথে দেখা করলাম। এদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা চাইলাম। স্থানীয় থানায় গিয়ে সাবেক এই দস্যুদের হয়ে সহযোগিতা চাইলাম। মূলত সোর্সরা যাতে এদের বিরক্ত না করে বা নতুন কোনো বিপদে না ফেলে সেবিষয়ে তাঁরাও সতর্ক আছেন বলে জানালেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ।

লবণ পানির এই জনপদে ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম, সাবেক দস্যুদের সামাজিক পুনর্বাসন সম্ভব। বেশির ভাগ মানুষ এই অপরাধীদের পুনরায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত। গত কয়েক মাসে ফিরে আসা দস্যুদের নিয়ে তেমন কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটেনি।

দিন পনেরো’র মধ্যেই জামিন পেলো শান্ত ও আলম বাহিনীর সদস্যরা। জেল গেইট থেকে তাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিলো RAB। কয়েক দিনের মধ্যে আমিও গেলাম। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে নিজের বাড়িতে উঠেছেন বারেক তালুকদার। এই দলের অন্যরাও যে যার বাড়িতে ফিরেছে।

মোড়েলগঞ্জে সাবেক দস্যুনেতা বারেক তালুকদারের বাড়িতে গেলাম। ছোট্ট কাঠ-বাঁশের ঘর। পরিবার নিয়ে বেশ আছেন তিনি। প্রতিবেশিরা এই দস্যুনেতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাই নিজের বাড়িতে বসবাস তাঁর জন্য সহজ হয়ে গেছে। দলের অন্যরাও ভালোই আছে। শুধু শান্ত বাহিনীর এক সদস্য, জয়মনি’র বশিরকে নিয়ে একটু সমস্যা চলছে। সময় পেলে বশিরের বাড়িতেও যাবো।

পাশের বাজারে একটি মুদির দোকান দিয়েছেন বারেক। ছেলেটির বয়স ১৭/১৮। অটোরিক্সা চালিয়ে প্রতিদিন কিছু টাকা রোজগার করে সে। সাথে মুদির দোকানের রোজগার মিলিয়ে চলছে সংসার।

এই দস্যুদলের সারেন্ডারের দিনটি ছিলো ঘটনাবহুল। আমার জন্য রাখা শিং মাছগুলো দিতে না পারার দু:খ তখনও রয়ে গেছে বারেক তালুকদারের। বললাম, ওই মাছ তো ফরেস্টের স্মার্ট টিম নিয়ে গেছে। সাবেক এই দস্যুনেতার বাড়িতে সেদিন দুপুরের খাবার খেলাম। চিংড়িসহ কয়েক পদের মাছ ছিলো। ছিলো দেশি মুরগি আর রাজহাঁসের ভুনা।

বারেক তালুকদারের ঘরে ঢুকতেই ছুটে আসলো তাঁর ছোট্ট মেয়েটি। আমার কোল হয়ে গেলো বাবার কোল-এ। এই দৃশ্য রূপান্তরের। মনে হলো এটুকু দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। অবাক হইনি। কারণ ফেরারি বনদস্যু বাবাকে ফিরে পেলে তাঁর সন্তান, স্ত্রী’র মুখে হাসি ফুটবেই।

এই দশ্যগুলো আমাকে ছুঁয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছে সাবেক এই দস্যুনেতার মা-এর দোয়া। দূরে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাকে সম্মান দিক। সেই ভালো লাগাগুলোই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

আরেকটি দারুণ বিষয় নজরে পড়লো। দস্যুনেতার সেই ছোট্ট ঘরে ঢুকতেই দেখলাম, দেয়ালে মৃত বাবার ছবির পাশে আমার একটি ছবি প্রিন্ট করে ঝুলানো। দারুণ সেই অনুভূতি। মনে হলো কিছু একটা করছি। রূপান্তর হচ্ছে। এই পথের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। সেদিন আশেপাশে শান্ত বাহিনীর অন্য সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গেলাম। মনে হলো, পরিবারের হারিয়ে যাওয়া কেউ ফিরে এসেছে। আনন্দের সীমা নাই।

সেই রাতে বাগেরহাটে থেকে গেলাম। ভোরবেলা রওনা হবো সাতক্ষীরার শ্যামনগরের উদ্দেশ্যে। জীবনে ফেরা আরেকটি দস্যুদল আলম বাহিনীর সদস্যরাও বাড়ি ফিরেছে, তাদের সাথেও দেখা করবো কাল। ফিরার পথে খুলনা জেলখানায় ঢুঁ মারতে হবে। ইলিয়াস ও মজনু বাহিনীর সদস্যদের এখনও জামিন হয়নি। যেতে হবে যেতে হবে জয়মনিরঘোলে। সারেন্ডার করা সাবেক বনদস্যু বশির নাকী একটু বিপদে আছে!

(ছবি: দস্যুনেতা বারেক তালুকদার। বামের ছবিটি দস্যুতার জীবনের। ডানের ছবিটি বাড়ি ফেরার পর। রূপান্তরের দারুণ এক উদাহরণ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top