ভাড়ায় অটোরিক্সা চালান আলম সরদার | রূপান্তরের গল্প ২১১ | Rupantorer Golpo 211 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১১ : সুযোগ পেলেই জেলখানায় থাকা সাবেক দস্যুদের সঙ্গে দেখা করি। কয়েদীদের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মেনে সাবেক দস্যুদের সঙ্গে দেখা করি। একটু খোঁজ খবর নেওয়া, জেলখানার অভিজ্ঞতা কম-বেশি আছে তাদের। ইদানিং আমারও একটু অভিজ্ঞতা হচ্ছে। জেলখানার অভিজ্ঞতা না, জেল গেইট-এর অভিজ্ঞতা।
জেলখানায় জেলখানায় ঘুরছি এখন। কয়েদী হিসাবে না, দর্শনার্থী হিসাবে। আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে নিয়ম মেনে কখনও বাগেরহাট আবার কখনও খুলনা জেলখানার গেইট-এ গিয়ে টিকেট কেটেছি, দাঁড়িয়েছি দর্শনার্থীদের সারিতে।
আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের মধ্যে মাস্টার বাহিনীর সবাই জামিনে আছে। আলম ও শান্ত বাহিনীর দস্যুরাও জামিন নিয়ে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু এদেরও আগে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু দল মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর সদস্যরা এখনও আছে জেলখানায়। খুলনা জেলখানায় প্রচুর ভিড়। ঠেলেঠুলে দেখা করলাম দু্ই দস্যুনেতার সঙ্গে। জামিন নিয়ে কিছু জটিলতা চলছে। সাবেক এই দস্যুদের পরিবারের সদস্যরা বেশ উৎকণ্ঠায়। বললাম, প্রয়োজনে আমাকে জানাবেন। আর আইন আদালতের বিষয় নিয়ে জোর করবেন না। আইনকে আইনের পথে হাঁটতে দিন। বদনাম হয় এমন কোনো কাজ আপনারা করবেন না।
মজনু ও ইলিয়াসের স্ত্রী’র সঙ্গে দেখা হলো খুলনায়। জামিনের বিষয়টি একটু দেখার জন্য অনুরোধ করছেন তাঁরা। বললাম, ওরা জেলখানায় আছে। জঙ্গলে তো আর নাই। বললাম, এতো বছর ধৈর্য ধরেছেন। আর মাত্র কয়েকটা দিন। উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে। মাস খানেকের মধ্যে হয়তো জামিন হবে তাদের।
দস্যুনেতা মজনু’র বাড়ি খুলনায়। স্ত্রী আর দুই সন্তান থাকেন সেখানে। শহরের বাসিন্দা। সুন্দরবনের দস্যু জগতের সাথে তার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। খুলনা ভিত্তিক অপরাধ জীবনের সাথে সম্পর্ক তার। একটা সময় আসে যখন ডাঙ্গায় বসবাস তার জন্য ঝুঁকির হয়ে পড়ে। সেই সময় জঙ্গলের দস্যু মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেব নিহন হন বন্দুকযুদ্ধে। সেই দস্যুদলের সদস্যরা মজনুকে দলের প্রধান বানিয়ে নিয়ে যায় সুন্দরবনে। তারপর আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। ক্রসফায়ারের আতঙ্কে কয়েকশ’ বনদস্যুর মতো জঙ্গলেই আটকা পড়েন তিনি। মজনু’র স্ত্রীকে বললাম, সরকার তাদের বিষয়ে সংবেনশীল। আপনারও ধৈর্য ধরেন।
আরেক দস্যুনেতা ইলিয়াসের এক মেয়ে, নাম ফাতেমা। দস্যু জীবন আর ফেরারি জীবন থেকে সারেন্ডার করে জীবনে ফিরেছে সে। আছে খুলনা জেলখানায়। বাড়ি কয়রার তেঁতুল তলায়। তবে পরিবার থাকে ডুমুরিয়ায়। জামিন নিয়ে সেখানেই থাকবেন ইলিয়াস। সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে ইলিয়াসের স্ত্রী সন্তানদের বাড়িতে নামিয়ে রওনা হলাম সাতক্ষীরার পথে।
দুপুরের খাওয়ার বিরতি নিলাম চুকনগরে। চুঁইঝাল দিয়ে খাশির মাংস। বিখ্যাত আব্বাসের হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে এগিয়ে চললাম। রাস্তা বেশ খারাপ। সাতক্ষীরা সদর পেরিয়ে শ্যামনগর পৌঁছাতে বিকাল হলো। শ্যামনগর থেকে আরও দক্ষিণে মুন্সিগঞ্জ। সেখানে অপেক্ষায় আলম সরদার। রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ আছে আরেক সাবেক বনদস্যু হালিমের বাড়িতে।
মুন্সিগঞ্জ-এ নামতেই দেখা আলম সরদারের সাথে। চেহারা ঝকঝক করছে। হাফ হাতা শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে দাঁড়ানো। অপেক্ষায় কয়েকশ’ মানুষ। মুন্সিগঞ্জ বাজারের সাথেই চুনা নদী। ওপাশে সুন্দরবন। এদিকের সাধারণ মানুষদের সাথে এর আগে সেভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
বনদস্যু ইলিয়াস, মজনু আর আলম বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর সফরগুলো করেছি রাতে রাতে, গোপনে। এদিকের লোকজন আমাকে নামে চিনে। কিন্তু সামনা সামনি হইনি আগে। খবর পেয়ে অনেকেই এসেছেন। তাঁদের কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করে, কেউ ছাত্র, কেউ এনজিওতে চাকরি করে আবার কেউ সুন্দরবনের জেলে। এছাড়া স্থানীয় অটোরিক্সা চালকদের অনেকেই এসেছেন দেখা করতে।
একের পর এক চা খেলাম। চা খেতে খেতে রীতিমতো হয়রান। আমার দুধ চা খাওয়ার অভ্যাসের কথা তারাও জানে। কিন্তু কতো আর খাওয়া যায়। বন উপকূলে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ঘন্টা দুই পার করলাম সেখানেই। তারপর অটো রিক্সা বা ইজি বাইক নিয়ে সামনে দাঁড়ালেন আলম সরদার।
জেলখানা থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ি ফিরেছেন সাবেক দস্যুনেতা আলম। তারপর একদিনও অপেক্ষা করেননি। পুরনো প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এক লাখ টাকা থেকে আশি হাজার টাকায় একটি পুরনো অটোরিক্সা কিনেছেন। ব্যাটারিচালিত এই বাহন নিয়ে নেমে পড়েছেন পথে, রোজগারে। মুন্সিগঞ্জ থেকে নোয়াবেঁকী, বুড়িগোয়ালীনি, কখনও শ্যামনগর পর্যন্ত ভাড়ায় চলে তাঁর অটোরিক্সা। এলাকার সবাই জানে, চিনে এই যুবককে।
দস্যুতা ছেড়ে আসা আলম সরদারকে সাদরে গ্রহণ করেছে এলাকার মানুষ। আলম সরদারের পাশে বসে এক বেলা ঘুরে বেড়ালাম পুরো এলাকা। তারপর উঠলাম স্থানীয় একটি হোটেল-এ। কলবাড়ীর বর্ষা রিসোর্টটির অবস্থান একদম সুন্দরবনের পাশেই।
সন্ধ্যার পর গেলাম আরেক সারেন্ডার করা বনদস্যু হালিমের বাড়ি। বুড়িগোয়ালীনিতে চুনার নদীর পাশেই তার বাড়ি। ছোট্ট ছাপড়া ঘরে বাবা-মা, স্ত্রী সন্তানদের সাথে থাকছে সে। হালিমের মা’র বয়স ভালোই। শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য। নদীতে জাল টানেন এখনও। চিংড়ির পোণা ধরে চালান সংসার।
লবণ পানিতে অতিরিক্ত সময় থাকার কারণে পুরো শরীরে তাঁর চর্মরোগ। লবণ জলের জীবন বলে কথা। মায়ের মুখে দারুণ সুন্দর হাসি। ছেলেটাকে ফিরে পাবেন তা চিন্তাও করেননি কখনও। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন সেই মা। বলছেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না। ছেলেটা নিশ্চিত ভাবে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মারা যাবে। বললেন, মৃত্যুর পর তার লাশটাও পাবো বলে বিশ্বাস ছিলো না। কিন্তু সেই ছেলে বাড়ি ফিরেছে, কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
রাতের খাবার দাবারের আয়োজন ছিলো বিশাল। রাজহাঁস, পাতিহাঁস, দেশি মুরগি, কয়েক পদের ভর্তা আর অনেকগুলো মাছের আইটেম। এক বেলায় এতো খাওয়া যায় না। উনাদের খুশি করতে সবগুলো খাবার চেখে দেখতে হলো।
খাওয়া শেষে চুনা নদী ধরে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম। নৌকায় করে এই ঘাট ওই ঘাট করলাম। অনেকের সাথে গল্প হলো, আড্ডা হলো। রাতের দিকে ফিরলাম রিসোর্ট-এ। সাথে ছিলেন আমার এদিককার সোর্স। কানে কানে তিনি বললেন, পশ্চিম বাদায় পুরনো ডাকাতরা নতুন করে নামছে।
জেলেরা বলছেন, সীমান্ত সংলগ্ন সুন্দরবনে দস্যুতা বাড়ছে নতুন করে। গভীর রাতে আলিফ ডাকাতের এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। দস্যুতা করছে এমন বেশ কয়েকজনের স্বজনরা এসেছেন দেখা করতে। আলম সরদারদের ফিরে আসা দেখে তারা বেশ আশান্বিত। হাত ধরে তাঁরা বললেন, দস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজটা বন্ধ করবেন না। আমরাও আমাদের প্রিয়জনদের ফিরে পেতে চাই।