রূপান্তরের গল্প ২১২ | Rupantorer Golpo 212

অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে | রূপান্তরের গল্প ২১২

অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে | রূপান্তরের গল্প ২১২ | Rupantorer Golpo 212 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২১২ : চেনা-অচেনা নাম্বার অসংখ্য ফোন এসেছে। কিন্তু সারাদিন ফোনগুলো ধরতে পারিনি। কারণ সকাল থেকে অসংথ্য মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। প্রত্যকের সাথে কথা বলেছি। ফোনের দিকে নজর দেওয়ার সময় পাইনি একদম। এছাড়া লবণাক্ত এই জনপদের মানুষদের মধ্যে অদ্ভুত এক টান কাজ করছে। কতো মানুষ, তাদের জীবনে কতো গল্প! সবগুলো গল্পই অন্যরকম।

এর মধ্যে মিসড কল দেখে একে একে ফিরতি ফোন করলাম। শান্ত বাহিনীর সদস্য হিসাবে সারেন্ডার করা বনদস্যু বশিরের সাথে কথা হলো। জয়মনির বশির বললেন, তার বাড়িতে এক চক্কর যেতেই হবে। একটু বিপদে আছেন তিনি।

ভেবেছিলাম পরদিন ঢাকা ফিরবো। আপাতত সাবেক বনদস্যুদের বাড়িতে ফেরা, সামাজিক পুণর্বাসনে বেশি নজর দিতে হবে। এছাড়া মানুষগুলো আমার হাত ধরেই আত্মসমর্পণ করেছে। সকালে মংলার জয়মনি যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

মধ্য রাত পর্যন্ত গল্প-আড্ডায় ছিলাম। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় প্রত্যকেই বললো সতর্ক থাকতে। সবাইকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

শ্যামনগরের কলবাড়ি’র বর্ষা রিসোর্ট এ আছি। এর অন্য অতিথিরা অভিযোগ করছেন। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরের মানুষদের আনাগোণা উনাদের বিরক্তির কারণ। বিষয়টি বেশ অস্বস্তির। মনে মনে ভাবছি, এদিকে আসলে এসব হোটেল-মোটেলে না থাকাই ভালো। আমাদের নৌকা-ট্রলার জীবনটা বেশি সুন্দর। তবে বর্ষায় একটু কষ্ট হয়।

সাবেক দস্যুনেতা আলম সরদার বাড়ি যাননি। হোটেলে আমাদের সাথেই আছেন। আলমগীর আর মিলনও আছে। উনাদের নিয়ে আবার বের হলাম। হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্তিত ঘরের ওই আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে গিয়ে বসলাম জেটিতে। চুনা নদীর পাশের জেটিতে বসেই কাটলো রাত। সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছে আশপাশের বেশ কয়েকজন যুবক। কথায় কথায় তারা বললো, সতর্ক থাকবেন ভাই।

এই দফায় সুন্দরবনে যাওয়ার পরিকল্পনা নাই। কোনো দস্যু দলের আত্মসমর্পণ নিয়ে কোনো সফরও নাই। সাতক্ষীরার বন উপকূলে গেছি শুধুই ফলোআপ করতে। অথচ এদিকে প্রশাসন, পুলিশ, RAB, কোস্টগার্ড সদস্যরা আমাকে অনুসরণ করছে। ওদের সোর্সরা নাকী সারা রাত জেগে আছে, আমাদের আশেপাশেই আছে।

ভোরবেলা বৃষ্টি আসলো আকাশ ভেঙ্গে। নদী পাড়ের ওই জেটিতে ছাদ আছে। কিন্তু বৃষ্টিতে কিছুই মানছে না। ভিজতে খারাপ লাগছে না। তখন জোয়ার শেষের দিকে। দূর দূরান্ত খেকে জেলেদের নৌকা ফিরছে। পাশেই মাছের আড়ত আছে। রাতের বেলায়ও অনেকগুলো নৌকা এসেছে সুন্দরবন থেকে। কলবাড়ি আড়তে মাছ-কাঁকড়া তুলবে তারা। ছই আর পলিথিনে ঢাকা নৌকা। বৃষ্টি থামলেই ঘাটে ভিড়বে তারা। বৃষ্টিতে অবশ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সরা ঘরে ফিরেছেন। বিশেষ করে পাশেই খুলনা RAB -এর একটি ক্যাম্প আছে। তারাই আমার গতিবিধি নিয়ে বেশি খোঁজ খবর করছে। বুঝলাম, সতর্ক থাকতে হবে আমাকে।

বৃষ্টি গায়ে নিয়ে পথে নামলাম। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম কলবাড়ি বাজারে। আড়ত তখনও খোলেনি। তবে আশেপাশের ঘেরের মাছ পৌঁছে গেছে, উঠেছে সুন্দরবনের কাঁকড়া। একটি চায়ের দোকান খালো আছে। ছোট্ট দোকান, তবে চা-কফির বেশ আয়োজন করা আছে। ভোরবেলা এই বৃষ্টির মধ্যে এক কাপ চা শক্তি জোগালো। ওই চায়ের দোকানের কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। তখনও জানতাম না, পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুতার অন্যতম সহযোগী তারা, বিষ দিয়ে মাছ শিকারের হোতাও তারা। ভাবলাম, ওদের থেকেও সতর্ক থাকতে হবে।

বৃষ্টি থামতেই মাছ উঠতে শুরু করলো। আধা ঘন্টার মধ্যে কলবাড়ির এই কাটা (আড়তকে এদিকে কাটা বলে) ভরে উঠলো মাছ আর মানুষে। মণকে মণ চিংড়ি মাছ উঠছে সেখানে। উঠছে পাতাড়ী, জাবা, সিলেট, পায়রা, দাতিনা, পারশে, কাকিলাসহ অনেক রকমের মাছ। সঙ্গীরা বললো, বেশির ভাগ মাছ ধরা হয়েছে অভয়াশ্রমে অবৈধ জাল দিয়ে, বিষ দিয়ে। মানে পুরো প্রক্রিয়াটি অবৈধ এবং ক্ষতিকর।

এগুলো দেখার কেউ নাই? মানে এই যে বিষ দিয়ে ধরা মাছ এখানে দেদারসে বেচাকেনা হচ্ছে, এদের ধরতে আসে না কেউ? সবাই তো অপরাধ করছে। জানলাম, এখানে বন বিভাগ থেকে শুরু করে বনদস্যু, সবাইকে ম্যানেজ করে চলে সুন্দরবনের ব্যবসা। নদীর তীর ধরে অনেকগুলো রঙ ঘর আছে, মানে শুঁটকি তৈরির ঘর। সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি মাছগুলো সব চলে যাবে রঙ ঘরগুলোতে। সেখানে মাছ শুকানো হয় আগুন দিয়ে। কাঠ পুড়িয়ে সারা বছর চলে শুঁটকির কারবার। বলা হয় কাঠগুলো লোকালয় থেকে কেনা। কিন্তু আমরা সবাই জানি, রঙ ঘরের জ্বালানী আসে সুন্দরবন থেকেই। কী অত্যাচার চলছে এই জঙ্গলে! এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। তাই সহযাত্রীরা বললো, সতর্ক থাকতে হবে।

বন উপকূলের জীবন যাপন সব জায়গায় এক রকম না। কোনো কোনো জায়গার মানুষ একটু বেশি অপরাধ প্রবণ। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছের আড়ত পর্যন্ত বিশাল সিন্ডিকেট কাজ করে। মাছের সিন্ডিকেট, অবৈধ অস্ত্রের সিন্ডিকেট আর পশ্চিম পাশ ধরে আছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। ধীরে ধীরে জানছি এসব। জানতে হবে, কারণ সুন্দরবনের এই অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েছি আমি। জেনে শুনে সামনের পথগুলো পাড়ি দিতে হবে।

আলম সরদারের দলের অন্য সদস্যদের ডেকেছিলাম মুন্সিগঞ্জ বাজারে। সকালের নাস্তা সেখানেই করবো। ছোট্ট দুইটি খাওয়ার হোটেল আছে সেখানে। ভাতের সাথে আলু ভর্তা, মরিচ ভর্তা, পাতলা ডাল। সাথে কড়া করে ভাজা ডিম দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। রওনা হলাম মংলা’র পথে। সাতক্ষীরা হয়ে খুলনা হয়ে বাগেরহাট গেলাম।

দৃপুরে খাওয়া দাওয়া করলাম সাবেক দস্যুনেতা মাস্টারের বাড়িতে। এরপর মংলা যাওয়ার পথে দিগরাজে বিরতি নিলাম। বাজারে মাস্টার বাহিনীর সদস্য ফজলু শেখ একটি দোকান দিয়েছে। দেখা করলাম তার সাথে। মংলায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো। রাতে থাকলাম পর্যটনের হোটেল- পশুর এ।

আগের রাতে ঘুমাইনি। এই রাতেও কখন যে ঘুমাই! বেলায়েত সরদার এসেছেন দলবল নিয়ে।ট্রলার ভরে মনে হলো পুরো চিলা বাজার চলে এসেছে। সেই রাতও কাটলো আড্ডায়। লবণ জলের এই জনপদে এক রকমের রূপান্তর শুরু হয়েছে। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ধরে থাকলে হয়তো এর শেষ টানা সম্ভব। ওই রাতে জানতে পারলাম, পশুর নদীর এপাশ ওপাশের কয়েকটি দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে চায়।

সামনের কাজগুলো করা বেশ সহজ হতো। কিন্তু অনেকেই বিরোধীতা করছেন। কখন যে কোন বিপদে পড়ি বলতে পারছি না। কোথায় থেকে কে এই সারেন্ডার বিরোধী কলকাঠি নাড়ছেন সেটিও বুঝতে পারছি না পরিস্কার ভাবে। তাই একাধারে সাবেক জলদস্যুদের ফলোআপ করছি, আবার এই পথের জটিলতাগুলোকে বুঝার চেষ্টা করছি। আপাতত আমার নামে কুৎসা রটানোর অপচেষ্টা চলছে। সামনে হয়তো আরও কিছু করবে। সময়ের সাথে সাথে ওদিকের দল ভারি হচ্ছে। সতর্ক না হলে নিজেকেই বিপদে পড়তে হবে।

(ঘটনাগুলো ২০১৬ সালের শেষ দিকের)

(ছবিটি একটি বনদস্যুদের ট্রলারে তোলা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top