জেলেদের যম ছিলো বশীর ডাকাত, এখন ক্ষমা চাইছেন জনে জনে | রূপান্তরের গল্প ২১৩ | Rupantorer Golpo 213 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১৩ : পাশাপাশ দু’টি কবর। চিরনিদ্রায় দুই ভাই জুলফিকার বার মর্তুজা। মংলা’র জয়মনিরঘোল-এ খুব সাধারণ একটি বাড়ি। সেখানেই কবর দেওয়া হয়েছে দুই ভাইকে। কবরের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা মা। দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পড়ছে পানি। আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন। হাত ধরে বললেন, দুইটা বছর আগে কেন আসলা না? বললাম, আমি তো আরও অনেক আগে এসেছি। আপনার ছেলেরা কথা শোনেনি।
২০১১ সালের দিকে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলাম। তখন রাজু, জুলফিকার, গামা, কাশেম, মজনু, আলিফসহ বেশ কয়েকটি দলের সাথে যোগাযোগ হতো। রাজু সারেন্ডার করতে চেয়েছিলো। তার সাথে দেখাও হয়। কিন্তু জুলফিকার ছিলো বেপরোয়া। সারেন্ডারের কথা চিন্তাও করে না। তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলি। তবে সে পথে না হেঁটে উল্টো আমাকেই ধমক দিয়েছিলো।
শান্ত বাহিনীর সাথে আত্মসমর্পণ করা দস্যু বশিরকে দেখতে গেছি জয়মনিরঘোল। আত্মসমর্পণের পর জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তারপর থেকে স্থানীয় ভাবে সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাঁকে। এলাকায় নিজের বাড়িতে থাকতে চান বশির। কিন্তু প্রতিবেশিদের কেউ কেউ তাকে সহ্য করতে পারছে না।
বশির পুরনো বনদস্যু। তার ভাগ্নে জুলফিকার ও মর্তুজা। দুজনই ছিলো পূর্ব সুন্দরবনের ডাকসাইটে দস্যুনেতা। পর পর RAB-এর দুটি অভিযানে তাদের মৃত্যু হয়। এরপর দলটি ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে যায়।
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই ভাইয়ের মা’কে বললাম, আপনার ছেলেরা আমার কথা শুনলো না। কয়েক বার বলেছি সারেন্ডার করতে। কিন্তু কথা শোনেনি। চোখে পানি নিয়ে আমার হাতটা ধরেই থাকলেন মা। মনটা খারাপ হচ্ছে। বললাম, ওরা তো বনদস্যু ছিলো। কতোজনকে অত্যাচার করেছে তারা। কতো মা-স্ত্রী-সন্তানদের কান্নার কারণ ছিলো ওরা! তখণ ওদের ফিরাতে পারেননি?
জুলফু বাহিনী ছিলো পূর্ব সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দস্যুবাহিনী, এর প্রধান ছিলো জুলফিকার। পশুর নদীর পূর্ব পাশ আর পুরো বঙ্গোপসাগর ছিলো তার দখলে। সেই দস্যুনেতার আপন মামা বশীর। ভাগ্নে বশির ছিলো সেই দস্যুদলের সাধারণ সদস্য। তবে দস্যুনেতা’র মামা হিসাবে তার দাপট ছিলো খুব। একই দলে জুলফিকারের এক চাচাও ছিলো, নাম দেলোয়ার। দস্যুতা চলাকালে তাকে হত্যা করা হয়। বশিরেরও একই পরিণতি হতে পারতো।
জুলফু বাহিনীর পতনের পর শুরু ফেরারি জীবন। কিছুদিন খুলনায় আত্মগোপনে ছিলেন। তারপর পালিয়ে ভারতে থেকেছেন বেশ কয়েক বছর। সেখান থেকে ফিরে আবারও দস্যুতায় নেমেছিলেন তিনি। এভাবেই কেটে গেছে প্রায় এক যুগ। অপরাধের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ছেড়ে চলে গেছেন স্ত্রী, সন্তানেরাও দূরে সরে গেছে।
এরপর শান্ত বাহিনীর সদস্য হিসাবে করেছেন আত্মসমর্পণ। জামিনে মুক্ত হয়ে নিজের এলাকায় ফিরেছেন। অতীতে তার অত্যাচারের শিকার জেলেরা প্রতিশোধ নিতে পারে, সেই শঙ্কা ছিলো মনে। ফিরে আসার পর তেমন কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। জঙ্গলে মার খাওয়া জেলেদের কেউ কেউ তাকে মারতে এসেছিলো। এমন পরিস্থিতিতে গণপিটুনিতে মারাও যেতে পারে সে।
জনে জনে ক্ষমা চাইতে হবে। বশিরকে বললাম, ঘরে লুকিয়ে না থেকে বের হন। এরপর সাথে করে নিয়ে আশেপাশের বাজার, লোকসমাগমের এলাকা, খেয়া ঘাট, জেলেদের বসতিতে ঘুরে বেড়ালাম সারাদিন। সবাইকে বললাম, বশিরকে আপনারা ক্ষমা করে দিন। তাকে এলাকায় থাকতে দিন। তা না হলে সে আবারও সুন্দরবনে চলে যাবে। আবার দস্যুতা শুরু করবে। তার শিকারও হবেন আপনারাই। আর যদি মারপিট করেন, মেরেও ফেলেন তাহলে বর্তমানের দস্যুরা ভয় পেয়ে যাবে। তারা আর সারেন্ডার করবে না।
বশিরকে বললাম, সবার কাছে ক্ষমা চান। অতীতের কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা চাইতেই থাকবেন। বিনয়ী হন। বললাম, প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বেন। মসজিদে মসজিদে গিয়ে সবার কাছে ক্ষমা চাইবেন। আমার কথা শুনেছেন বশির। সেদিন থেকেই ক্ষমা চাওয়ার মিশনে নেমে পড়েন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে প্রতিবেশিরা তাকে মেনে নেয়।
তারপর আবারও শুরু জীবনযুদ্ধের। পঞ্চাশোর্ধ সাবেক এই দস্যুর জন্য সে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপরও নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা তো করতেই হয়। একাকী জীবন। জয়মনির ঠোঁটায় ছোট্ট করে নিজের একটা ঘর তুলেছেন। পোণা মাছ আর কাঁকড়ার ব্যবসা করছেন একসময়ের বনদস্যু বশির।
সেদিন এক বেলা পুরোটা কাটিয়েছি বশিরের সাথে। তার পক্ষ্যে নিজেও চেয়েছি ক্ষমা। আমার হাত ধরে আত্মসমর্পণ করা প্রত্যেক দস্যুর প্রতি আমার দায় আছে। সেই দায় থেকে তার পাশে দাঁড়িয়েছি। ভবিষ্যতে যারা সারেন্ডার করবে তাদের কাছে এই বার্তাটা গেছে, কাজ করেছে দারুণ ভাবে।
(ছবি: বাড়ি ফেরার পর জয়মনিরঘোলে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন বশির)