জেলেরা আমার গল্প আমাকেই বলেন! | রূপান্তরের গল্প ২১৪ | Rupantorer Golpo 214 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১৪ : জয়মনিরঘোল এক আশ্চর্য জনপদ। পশুর নদীর পূর্ব পাশে সেলা নদীর শুরু এখান থেকে। বড় দুই নদীর মোহনায় লম্বা চর বেরিয়ে গেছে। জোয়ার ভাটায় সেই চরের অনেকটা ডুবছে আর ভাসছে যুগের পর যুগ। অদ্ভুত ভাবে এই জায়গাটি টিকে আছে। দুই নদীর জোয়ার ভাটার চাপ, ঢেউ, স্রোত আর নিম্নচাপের সময়ের উথাল পাথাল পানির চাপ নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে এই চর, কিন্তু ভেঙ্গে যায়নি, বিলীন হয়নি।
সেলা নদীর উল্টো পাশে সুন্দরবন। খালের নাম- নন্দবাল। পশুর নদীর উল্টো দিকেও সুন্দরবন। ওদিকের বড় খাল জোংড়া। জয়মনির ঠোঁটা নামে পরিচিত শেষ অংশে শ’খানেক পরিবারের বসতি আছে। অতি প্রান্তিক, ভাটায় ভাটায় চিংড়ির পোণা ধরে পেট চলে তাদের।
জয়মনির ঘোল সুন্দরবনের অনেক ঘটনার সাক্ষী। বিশেষ করে সুন্দরবন ভিত্তিক অনেক অপরাধের সাক্ষী এই এলাকার মানুষ। বনদস্যু জুলফিকারের বাড়ি এখানেই। বেশ কয়েক বছর দাপটের সাথে দস্যুতা করেছে সে। জুলফু বাহিনী নামে কাঁপতো সুন্দরবনের মানুষ। কিন্তু জয়মনিরঘোলের অনেক জেলে সুবিধা পেতো তার সময়ে। এছাড়া ছোট সুমন ও মোশাররফের যে দস্যুদলটি আছে সেই দলের বেশির ভাগ সদস্য এই জনপদের। মোশাররফের দলটি নাকী এদিকেই ঘুরে বেড়ায়। ভালো করে খোঁজ লাগালাম। ফোনে ওরা ধরা দিতে চায় না।
বৈদ্যমারী নামের আরেকটি গ্রাম আছে এখানে। পাশেই সুন্দরবন ইউনিয়ন। উত্তরে চিলা। পশ্চিমে পশুর আর দক্ষিণে সেলা নদী। বাঘ-কুমিরের সাথে লড়াই-এর গল্প এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে। হরিণ শিকার, গাছ চুরির মতো অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুও ছিলো এই জনপদ।
সবগুলো আইন শৃংখলা বাহিনীর সোর্স আছে এখানে। তাদের জ্বালায় এদিকে চলাফেরা করাই মুশকিল। এসেছি যখন তখন মোশাররফ-ছোট সুমন বাহিনীর খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার এক সোর্স বললো, সেলা নদীতে নামলে তাদের সাথে দেখা হতে পারে, ওরা এদিকেই আছে।
বৈদ্যমারীর প্রবীন এক বড়শির জেলের (স্থানীয় ভাষায় বইশেল) সঙ্গে সেই রাতে রওনা দিয়েছিলাম। সেলা নদীর খাল মৃগামারীতে বড়শি ফেললেন তিনি। বেন্দী জাল, চরপাটা কিংবা খালপাটা জালের জেলেদের চেয়ে এই জেলেদের ব্যস্ততা তুলনামূলক কম। যারা লোকালয় থেকে বড়শির আধার জোগার করে জঙ্গলে নামে, তাদের কাজ আরও কম। বলা যায়, নদী বা খালে নামতেই হয় না। চাচার নাম রহিম হাওলাদার। আমাকে সানন্দেই সঙ্গে নিয়েছেন তিনি।
বর্ষা কাল বলে একটু বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হলো। আমার সোর্স সঙ্গী হলেন। সহযাত্রী অন্যদের মংলায় পাঠিয়ে দিলাম। বশির চাচা পিছনে, সামনে আমার সোর্স। সেলা নদীর বাম তীর ধরে নৌকা বেয়ে চলছি। বর্ষায় বেড়ে পোকার উৎপাত বেশি থাকে। এদের কামড় থেকে বাঁচতে সারা গায়ে শ্যাম্পু মেখে নিলাম।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে মৃগামারী খালে এসে নোঙ্গর করলাম। লোকালয়ের কাছে হলেও বেশ গভীর এখানকার বন। বন্ধ হয়ে যাওয়া ফরেস্ট অফিসটি ভরে গেছে ঝোপ ঝাড়ে। রহিম চাচা বললেন, জুলফু ডাকাতের অত্যাচারে এই অফিস বন্ধ হইছে। তাতে আমাদের ভালোই হলো, বুঝলেন? ফরেস্ট থাকলে এই খালে ঢুকে মাছ ধরতে দিতো না। বললাম, ও চাচা, এখানে একটু ওঠা যায় না? বললেন, কেউটে সাপের আখড়া এই অফিস। উঠলে ওরা ধাওয়া করে। বললাম, এমনিতেই সাপ ভয় পাই। উপরে ওঠার দরকার নাই। আসলে ডিঙ্গি নৌকায় লম্বা সময় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা খুব কঠিন, দম বন্ধ বন্ধ লাগে। কিন্তু কিছু করারও নাই। বৃষ্টিটা না নামলে আপাতত মানিয়ে নিতে পারবো।
রাতের অন্ধকার, সাথে নিস্তব্ধতা। দারুণ এক পরিবেশ। এদিকে কুমিরের চাপ বেশি। তবে খালের ভিতরে ভয়ের কিছু নাই। রহিম চাচা বললেন, নদী একটু গরম আছে। সব সময় কিছু একটা ধরে বসবেন। পড়ে গেলে স্রোতের তোড়ে কোথায় চলে যাবেন ঠিক নাই। অন্ধকারে খুঁজেও পাবো না। উনি ভেবেছেন আমি এই জঙ্গলে নতুন মানুষ। বললাম, আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আপনি মাছ ধরার কাজ শুরু করেন।
এক ধরনের কাঁকড়া হলো মাছের আধার। দাওন বড়শির এক একটি বড়শিতে একটি করে কাঁকড়া গাঁথলেন। এর পর জোয়ার ভাটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে বড়শি ফেললেন খালের এক পাশ থেকে।
রহিম কাকা বললেন, এক সময় এই অঞ্চলে কাউইন মাছের অভাব ছিলো না। এক ভাটার মাছ দিয়ে হাপড় ভরে যেতো। হাপড় হলো বাঁশের তৈরি এক ধরনের খাঁচা। বেশ বড় হয়। মাছ জিঁইয়ে রাখা হয় এই খাঁচায়। পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়।
হাপড়গুলো সাধারণত নির্দিষ্ট কোথাও ভাসানো থাকে। আবার কোনো কোনো নৌকায় হাপড় বাঁধা থাকে সাথেই। কেউ কেউ নৌকার সাথে সূতায় বেঁধে কাউইন মাছ জিঁইয়ে রাখে। আমাদের নৌকার সাথেও হাপড় আছে। একটি খালের ভিতরের দিকে বাইন গাছের সাথে বেঁধে রেখেছেন চাচা।
বড়শি ফেলা হলো। একসাথে দুইশ’র বেশি বড়শি। মৃগামারির মুখ থেকে খালের মাঝ বরাবার উজানে। তারপর ছোট এক খালের মুখে নৌকা বাঁধলেন রহিম চাচা। বললাম, আগের মতো মাছ হয় না বলছিলেন, বিষয়টা কী? বললেন, বিষ দিয়ে সব শেষ করে দিচ্ছে মানুষ। প্রতিটা খালে বিষ মারা হয়। সারা বছর চলে এই অপকর্ম।
বললাম, এরা সবাই তো আপনাদের পরিচিত। তাদের বলেন না কেন? বললেন, এখনকার বনদস্যুরা এই বিষের কারবার করার সুযোগ করে দেয়। বিষ যারা মারে তারা সবাই ওই মোশাররফ বাহিনী আর বড় সুমন বাহিনীর কাছের লোকজন। ওদের কিছু বললে আর জঙ্গলে আসা লাগবে না। বললাম, ফরেস্টাররা কিছু বলে না? চাচা বললেন, ফরেস্টাররা শুধু আমাদের ধরে। যারা আকাম করে, বিষ মারে, হরিণ শিকার করে, তাদের কিছু বলে না।
এদিকে বনদস্যু কারা আছে? এমন ভাবে বললাম যেন কিছুই জানি না। চাচা বললেন, জঙ্গলের কোথায় যে ডাকাত দল থাকে কে জানে? নামার আগে আমরা চাঁদা দিয়ে আসি। তারপরও দেখা হলে ডিউটির টাকা নেয়, মাছ যা পায় সব নিয়ে যায়। এজন্য সাথে হাপড় রাখি না। পার্টির লোকজন আসলে জ্বালাবে। সেজন্য পাঁচশ টাকা রাখি।
পাটাতন খুলে নিচ থেকে প্লাস্টিকের কৌটা থেকে বের করলেন পাঁচটি একশ টাকার নোট। তার ভিতরে আছে দুইটি দস্যু দলের চাঁদার স্লিপ। বন বিভাগের অনুমতির কাগজ-পত্র। বললেন, ফরেস্টের সাথে দেখা হলে দিতে হয় একশ’ টাকা। ডাকাতদের সাথে দেখা হলে দেই দুইশ’। এদিকে দুইটা পার্টি আছে। তাদের জন্য রাখছি খুচরা চারশ’ টাকা।
এই টাকা জেলেরা দেয় ডিউটির টাকা নামে। ফরেস্ট বা বনদস্যুরা কী ডিউটি করে? বললাম, ও চাচা, ডিউটির টাকার বিষয়টা বুঝায়ে বলেন তো! যা বুঝালেন তা হলো, দস্যু বা ফরেস্ট যে ঘুরে বেড়ায়, তারা নাকী আমাদের পাহাড়া দেয় যাতে অন্য কেউ এসে আমাদের না ধরে। মোট কথা, জেলেদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তারা নাকী ডিউটি করে। সেই হিসাবে টাকাটা দিতে হয়।
রহিম হাওলাদার বললেন, আগে যখন জুলফি বাহিনী ছিলো তখন এতো ঝামেলা ছিলো না। শুধু ওদের চাঁদা দিলেই হতো। ইদানিং একটা দল সারেন্ডার করছে, শান্ত বাহিনী। বললেন, এদিকে মাছ ধরতে আসলে শান্ত বাহিনীকেও টাকা দিতে হতো। ওরা উঠে গেছে বলে আর দেয়া লাগলো না।
শান্ত বাহিনী কী করে উঠলো চাচা? উনি বললেন, ঢাকার এক সাংবাদিক এসে উঠায়ে নিয়ে গেছে। সেই সাংবাদিকের অনেক কানেকশন। বেশ মজা পাচ্ছি। জানতে চাইলাম, সাংবাদিকের নাম কী? বললেন, তা জানি না। তবে সে ডাকাতদের সাথে যোগাযোগ করে আসে। বড় বড় সব ডাকাত দলকে সেই সাংবাদিকই সারেন্ডার করাইছে।
চারপাশে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। বশির চাচার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। পরিশ্রম করা মানুষ। বয়স হলেও শারীরিক গঠন বেশ মজবুত। সুন্দরবনের মানুষ বলে কথা। বললাম, একটু বাতিটা জ্বালানো যায় না কাকা? বললেন, পাগল নাকী? জঙ্গলে বাতা জ্বাললে দূর থেকে দেখা যায়। ডাকাতেরা সুযোগ খোঁজে। সারা রাত চোরের মতো ঘুরে বেড়ায়। টেমি (কেরোসিনের বাতি) জ্বালালে দূর থেকে আলো দেখে চলে আসে দস্যুরা। বললাম, চাঁদা তো দেওয়াই আছে আপনারা। বললেন, ওদের কোনো বিশ্বাস নাই। টাকা নেওয়ার জন্য কতো কাহিনী করে তারা! এছাড়া আপনি আছেন সাথে, কোনো ঝুঁকি নিবো না।
আমার সোর্স ফিসফিস করে বললেন, ডাকাত কোনো সমস্যা না। এতোক্ষণ যেই সাংবাদিকের গল্প তুমি বললা, সেই সাংবাদিক তোমার সামনেই বসা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেন রহিম চাচা। বাতি জ্বালানো থাকলে তাঁর চেহারাটা দেখতে পেতাম! তবে অন্ধকারেই রূপান্তর দেখতে পাচ্ছি। ভালো লাগছে খুব….!!
(ছবি: মৃগামারী খালের মুখ, সাম্প্রতিক ছবি)