ডাকাতরা আর আসলো না সে রাতে! | রূপান্তরের গল্প ২১৬ | Rupantorer Golpo 216 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১৬ : ডাকাতরা আসে না কেন? একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। বড়শি তুলতে তুলতে রহিম চাচা উত্তর দিচ্ছেন। এতোটুকু বিরক্ত হন না। বললেন, ডাকাত খুঁজলে পাওয়া যায় না। ওরা আর মামারা না চাইলে দেখা পাওয়া যায় না। বললাম, মামা বলতে? বাঘের কথা বলছেন? বললেন, ওর নাম তো আমরা মুখে আনি না। ডাকাতের নামও নেই না। যদি নাম নিতে গিয়ে সামনে চলে আসে?
সুন্দরবনে বাঘ অথবা বিপদ আপদ নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিছু রীতি জেলেরা মেনে চলেন। বিপদ এড়াতে বাস্তব জ্ঞানকে কাজে লাগান তাঁরা। তারপর জীবনের দায়িত্ব দিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। রহিম চাচা বললেন, সুন্দরবনে বাঘ খুঁজবেন, পাবেন না। কিন্তু বাঘ তো আছে। ওরা জঙ্গল থেকে ঠিকই আমাদের দেখে। ডাকাতেরাও আমাদের দেখে। লুকিয়ে থাকে বলে আমরা দেখি না। যতোই খুঁজি, ওরা দেখা না দিলে বাদাবনে ডাকাতও খুঁজে পাবেন না।
সুন্দরবনে বিপদের শেষ নাই। বিপদ কাটাতে কেউ নোয়া পাড়ার পীর সাহেবের পড়া রুমাল ব্যবহার করে। অনেকেই ব্যবহার করে তাবিজ-কবজ। কাউকে কাউকে বিচিত্র মন্ত্র পড়তেও শুনেছি। কিন্তু বেশির ভাগ জেলে-বাওয়ালী-মাওয়ালী সুনির্দিষ্ট কিছু রীতি পালন করে। শুক্রবারে জঙ্গলে পা ফেলে না সবাই। অনেকে সুন্দরবনে কলা নেওয়াকে অশুভ মনে করে।
সুন্দরবনে শুধু বাঘ-কুমিরের হাত থেকে বাঁচলেই চলবে না। আরও কিছু বিষয় আছে। অশরীরী কিছুর অস্তিত্বও আছে বলে শুনি। যদিও আমার চোখে কখনও পড়েনি। বিশ্বাস নাই এসবে। তবুও রাতের বেলা একটু ভয় ভয় লাগে।
জেলেদের অনেকেই বলেন, পোরো নামের এক ধরণের দৈত্য আছে। আর এদের হাত থেকে বাঁচতে ওই তাবিজ আর নোয়া পাড়ার পীর সাহেবের দেওয়া লাল রুমাল নাকী কাজ করে। যদিও আমাদের দলনেতা বৈশেল রহিম চাচা এসবে বিশ্বাস করেন না। ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ পড়েন। বললেন, জীবন বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। অন্য ধর্মের মানুষেরা যে যার ধর্ম মতো চলেন। জীবনের দায়িত্ব দিয়ে রাখেন সৃষ্টিকর্তার ওপর।
দাওন বড়শি পেতেছেন চাচা। মৃগামারীর মুখে ফেলানো দাওনের এক প্রান্ত। লোহার অ্যাংকর দিয়ে ডুবানো। বড়শি তুলতে হলে প্রথমে এই নোঙ্গর উঠাতে হবে। রহিম চাচা সেই কঠিন কাজটি করছেন। পিছনে বসে আমার সোর্স বৈঠা ধরে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাঝখানে ভারসাম্য ঠিক রেখে বসাটাই আমার কাজ।
নোঙ্গর উঠলো। রাখা হলো নৌকায়। এর সাথে কয়েকশ’ ফুট লম্বা নাইলনের সূতায় বাঁধা দুই শতাধিক বড়শি। মাঝে আরও দুটি ছোট নোঙ্গর আছে। একদম শেষে ডুবানো আছে আরেকটি বড় নোঙ্গর।
বড়শি উঠছে। ছোট্ট একটি টর্চ ধরে আছি আমি। কিন্তু সেই আলো ধরে ছুটে আসছে হাজার হাজার পোকা। কেওড়া পোকা নাম এদের। কয়েক সেকেন্ডে পুরো নৌকা ভরে গেলো। আমাদের সার শরীর ভরে গেলো পোকায়। কী একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। রহিম কাকা বললেন, আলো নিভান। তা না হলে টিকতে পারবো না। সারা রাত জালাবে ওরা। আলো নিভিয়ে গামছা দিয়ে পোকা তাড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
একটি, দুইটি করে বড়শি উঠছে। এভাবে প্রায় পঞ্চাশটির মতো বড়শি উঠালেন কাকা। নাহ! মাছ নাই। হতাশ হবো না বুঝতে পারছি না। মনটা একটু খারাপ। ভাবছি, আমাকে খাওয়াবেন বলে আগেভাগে বড়শি তুলছেন রহিম চাচা। হয়তো একারণে মাছ হচ্ছে না।
অন্ধকারে কিছু দেখছি না। শুধু পানির শব্দ শুনছি। দুই পাশের জঙ্গল। তান ঝালাপালা করে ডাকছে ঝিঁঝি পোকা। আগে প্রচুর জোনাকি জ্বলতো। ইদানিং দেখি না। চাচা বললেন, এতো বিষ দিলে জোনাকী পোকা বাঁচবে কী করে?
হঠাৎ করে ঝপাৎ করে শব্দ হলো। বড় মাছ বেধেছে মনে হয়। চাচা বললেন, কাজ হয়ে গেছে কাকা! রাতে খাওয়ার মাছ উঠে গেছে। বলেই জালতি নিয়ে পানি থেকে তুলে আনলেন মাছ। বিশাল বড় কাউইন মাছ! চার কেজি’র বেশি হবে। এই বড়শির মাছ খুলে রাখতে রাখতে আরেকটা মাছ উঠলো। এটা আরও বড়। মাছগুলো খুলে নৌকার খোলের ভিতরে রাখা হচ্ছে। নৌকায় মনে হলো ভূমকম্প লেগেছে। ছটফট করছে মাছগুলো। কাকা বললেন, পা যেন কিছুতেই ঝুলিয়ে না বসি। কাউইন মাছে কাঁটা দিলে আর টিকতে পারবেন না। বিষয়টি জানা। তবুও সতর্ক হলাম। সুন্দরবনে এসব বিষয়ে অযথা ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
নৌকা আগাচ্ছে উজানের দিকে। বড়শি উঠছে। মাছ উঠছে একটার পর একটা। ভালো লাগছে এখন। দারুণ লাগছে। মাছ ধরা তাদের জন্য পেশা আবার নেশাও। নির্বিকার ভাবে মাছগুলো তুলছেন রহিম হাওলাদার। টেমি বাতির আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সেই আধো আলোতে হাত চলছে বইশেলের। পরের আধা ঘন্টায় বড়শি টানা শেষ হলো। বড় কাউইন মাছ উঠলো ১৫টি। মাঝারি উঠেছে ত্রিশটির বেশি। এছাড়া টেংড়া উঠলো কয়েকটা। নৌকার খোল প্রায় ভরে গেলো মাছে। সূতা আর বড়শি গোছাতে গোছাতে কাকা বললেন, আপনি কপালওয়ালা মানুষ। ীনেনেক দিন এমন মাছ পাইনি।
রহিম হাওয়াদার হাসছেন। ভীষণ খুশি। এক টানে যে মাছ উঠলো তার দাম ২০ হাজারের বেশি হবে। বাজার ভালো থাকলে ত্রিশ হাজারও হতে পারে। চাচার চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি টেমির আলোয়। চোখ দুটো চকচক করছে।
নিজেকে এবার বেশ নির্ভার লাগছে। গোটানো বড়শিগুলোতে আধার গাঁথা হচ্ছে। এখান থেকে আবার বড়শি ফেলতে ফেলতে যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকে যাবো। ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। বড়শি ফেলে তারপর শুরু হবে রান্না। বললাম, ওই বড় নদীতে গিয়ে নোঙ্গর করবেন। খালের ভিতরে বাতাস নাই, গরম লাগছে।
যাওয়ার পথে পাশ খালে রাখা হাপড়টি নৌকায় বেঁধে নিলাম। খালের মুখে গিয়ে শেষ হলো কাজ। নোঙ্গর করে নৌকার খোলের ভিতর থেকে মাছগুলো হাপড়ের ভিতরে ঢুকাতে হবে। তা না হলে মাছ নষ্ট হয়ে যাকে। জীবিত না থাকলে এই মাছের দাম পাওয়া যায় না।
একে একে হাপড়ের ভিতর তোলা হচ্ছে মাছগুলো। একটা বড় মাছ রান্না করার জন্য রাখছেন। বললাম, ও কাকা, মানুষ মাত্র তিনজন। এই মাছ খাবে কে? চাচা নাছোড়বান্দা। বললাম, নৌকায় যে হাঁড়ি আছে তাতে এতো বড় মাছের জায়গা হবে? এবার একটু দমলেন তিনি। বললেন, তাই বলে ছোট মাছ আপনাকে খাওয়াতে পারবো না। নষ্ট হয় হোক, বড় মাছই কাটবো।
অনেক কষ্টে থামালাম। বললাম, মাঝারি একটি মাছ কাটেন। আমি খুশি হবো। বলেই একটি মাছ দেখিয়ে দিলাম। সেটি রেখে বাঁকীগুলো ঢোকানো হলো বাঁশের তৈরি হাপড়ের ভিতর।
রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। কাউইন মাছ কেটে-বেছে চুলায় তুললেন কাকা। সেই সঙ্গে চললো রাতভর গল্প। জোয়ার আসলো নদীতে। সেলা নদীর উল্টো পাশ দিয়ে একটার পর একটা নৌকা নামছে। চরপাটার জেলেরা গেলো বিশ্রামে। পুরো জোয়ার হতে আরও পাঁচ ঘন্টা। তখন জালগুলো টেনে দিতে হবে। তারও ছয় ঘন্টা পর, ভাটায় ধরবে মাছ। খালপাটার জেলেরাও মাছ ধরে একই পদ্ধতিতে।
আমাদের পাশ দিয়ে কোনো নৌকা গেলো না। দূর থেকে নৌকার বাতি দেখা যাচ্ছে। ওরা সাহস করে আসবে না। আমি মনে মনে দস্যুদের নৌকা খুঁজছি। উনারা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত। গত রাতেই তেমন ঘুম হয়নি।
এদিকে বেশ সুন্দর বাতাস ছেড়েছে। নৌকায় বিছানো কাঁথার শরীরটা এলিয়ে দিলাম। সোজা হয়ে শোওয়ার জায়গা নাই। হাত-পা গুটিয়ে শুয়ো পড়লাম। তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। ডাকাত দলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়লাম। ডাকাতরা এলো না।
(ছবিটি সেই রাতের না। ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। ছবিটি সুন্দরবনের মেহের আলীতে তোলা। সরদারের পাশের বাতিটিকে টেমি বলে)