রূপান্তরের গল্প ২১৭ | Rupantorer Golpo 217

দোলাচলে দোলে সুন্দরবন জীবন | রূপান্তরের গল্প ২১৭

দোলাচলে দোলে সুন্দরবন জীবন | রূপান্তরের গল্প ২১৭ | Rupantorer Golpo 217 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২১৭ : বৃষ্টিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ছোট্ট নৌকায় হুড়োহুড়ি পড়লো। বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচতে আগা গোঁড়া পলিথিন টানানো হলো। অবশ্য ততোক্ষণে ঘুম ভেঙ্গে গেছে আমার। পলিথিনের উপর টপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো বলে মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। তবে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সব মনে পড়লো। উঠে বসলাম।

কয়টা বাজে এখন? রহিম চাচা বললেন, ঘড়ি তো দেখি না আমরা। তবে মনে হয় পাঁচটার মতো বাজে। জোয়ারে পানি বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে স্রোত। সরসর করে পানি বয়ে যাচ্ছে নৌকার দুই পাশ দিয়ে। তবে গোন শেষের দিকে বলে পানির চাপ কিছুটা কম।

বইশেলরা মাছ ধরতে নামে মরা গোনে। রহিম চাচা হয়তো নামতেন আরেকদিন পর। কিন্তু আমি নামবো বলে একদিন আগেই নেমে পড়েছেন তিনি। ভাটির গোন না পড়লে বড়শিতে মাছ হয় না। যদিও আমাদের বড়শির প্রথম খ্যাওনেই ভালো মাছ পড়েছে।

ভরা গোন বা জো-এর সময় বড়শিতে মাছ হয় না কেন কাকা? আমার প্রশ্ন শেষই হয় না। চাচা বললেন, এতো বড় বড় চোর-ডাকাত ধরে ফেললেন, তাও এগুলো জানেন না? বললাম, এই জঙ্গল বিরাট রহস্যের জায়গা। মাথায় ধরে না।

রহিম হাওলাদার বললেন, গত ৪০ বছর ধরে বড়শি বাই। সুন্দরবনের অনেক কিছু আমরা বুঝি না। বলতে বলতে জানালেন, গোন বা জো-এর সময় নদী-খালে স্রোত বেশি থাকে। মাছগুলো দাঁড়ায় না, দাঁড়াতে পারেও না। আর মরা গোনে পানির চাপ কমে যায়। এসময় পানির নিচে মাছগুলো দাঁড়ায়। বড়শি ফেলা-তোলার কাজও করা সহজ হয়।

পলিথিনের তলায় বসে গল্প হচ্ছিলো। চুলা জ্বলছে খোলের ভিতর। রান্না শেষ পর্যায়ে। এদিকে চুলার ধোঁয়ায় দম বন্ধ অবস্থা। পলিথিনের ভিতর থেকে মাথাটা বের করে শ্বাস নিলাম। বৃষ্টি যা হচ্ছে তাতে পুরো ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। শরতের বৃষ্টি। থেমে যাবে। কাঁথা বালিশ গুটিয়ে বস্তায় ঢুকালাম।

রান্না শেষ হলো। ঠান্ডা ভাতের সাথে আগুন গরম তরকারি। ক্ষুধা পেটে গরম গরম খাবার। টুপ টুপ করে পানি ঝরছে। আকাশ ভরা ভারী মেঘ। আবার মনে হয় বৃষ্টি নামবে। খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে পূর্ব আকাশে আলো ফুটছে। সুন্দরবনে ভোর হওয়া, সূর্য ওঠা দেখার অভিজ্ঞতা অনেক বার হলো। তবুও মনে হয় নতুন দেখছি। প্রতি বারই ভালো লাগে। বিমোহিত হই।

ভাত খেয়ে পা গুটিয়ে শুয়ে পড়লেন আমার সহযাত্রী, সেই সোর্স। এদিকে চুলা জ্বলছে এখনও। চা তুললেন রহিম চাচা। বললেন, চা খেয়ে আরেকটা টান দিবো। এবারের টানে রাতের মতো মাছ হলে আজকেই মাছ নিয়ে ফিনবেন তিনি। বললাম, তাহলে তো ভালোই হবে। সাথে আমিও ফিরতে পারবো।

সুন্দরবন ও সাগরে সময় বেঁধে চলা প্রায় অসম্ভব। হেরফের হবে নানা কারণে। জোয়ার-ভাটার সাথে তাল মিলাতে হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে না পারলে পুরো একটা দিন চলে যায়। এদিকের মানুষ দিন হিসাব করে তিন দিনে। কারণ আবহাওয়ার কারণেও প্রায়ই সময় মতো রওনা দেওয়া যায় না। ডিঙ্গি নৌকার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও অনিশ্চিত।

কড়া লিকারে গুঁড়া দুধ দিয়ে চা হলো। দারুণ স্বাদ। একদম চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। বললাম, চলেন চাচা, বড়শি তুলি। মনে মনে একটু হতাশ। ভেবেছিলাম রাতের বেলা আলো দেখে হলেও কোনো দস্যুদল হয়তো আসবে আমাদের কাছে। কাছাকাছি আছে মোশাররফের দল। এমনিতে ধরা দিচ্ছে না অনেক দিন হলো। তাই সুযোগ বুঝে নেমে পড়েছি। সামনে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই তাকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে পারবো। এমনিতে ফোনে খুব ভালো ভালো কথা বলে সে। কিন্তু সামনে আসতে চায় না।

বইশেল রহিম চাচা একটু গলা নামিয়ে বললেন, আপনি যাকে সাথে নিয়ে আসছেন, সে থাকলে কোনো পার্টি কাছে আসবে না। ওই আসতে দিবে না। বিড়বিড় করে উনি বললেন, এই দালালেরাই তো সব শেষ করে দিলো!

একারণেই দস্যুদের চাঁদা আদায়কারীদের নিয়ে কিছু বলছেন না তিনি। গলা নামিয়ে আমিও বললাম, বুঝছি কাকা। বললাম, এবিষয়ে পরে কথা হবে। চলের বড়শি তুলি।

বৈঠা হাতে বসলাম। নৌকার মাঝখানে বসে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এমনিতেই বৈঠা হাতে দুর্বল। আমি। তবুও চেষ্টা করলাম। দুইজন মিলে নৌকা বেয়ে চলে গেলাম। তারপর বড়শির নোঙ্গর তোলা হলো। শুরু হলো টান। বইঠা নিয়ে এলোমেলো চেষ্টা করছি। নৌকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। কাকা বললেন, রাখেন আপনি। বসে থাকেন। বলেই বৈঠা বাওয়া আর বড়শি তোলার কাজ একই সাথে করছেন রহিম চাচা।

রাতের মতো মাছ হয়নি। তবে কাউইন মাগুর আর টেংড়া মাছ ছাড়াও একটা মাছ উঠলো। ইলশে তাইড়েল নাম। দেখতে যেমন সুন্দর, মাছটি খেতেও মজা। তাজা মাছ কেটেকুটে কাঁচা পাক দিলেই হয়।

রহিম চাচা বললেন, এই জায়গায় তাইড়েল মাছ পাওয়া যায় না। কপালে ছিলো বলে ধরা পড়েছে। রহিম হাওলাদার আজ মহা খুশি। দুই টানের মাছ দিয়ে তার মাসের খরচ উঠে যাবে। বললেন, সকালে এই তাইড়েল মাছ রান্না করবো।

পুরো রাত কেটেছে পূর্ব সুন্দরবনের এই খাল- মৃগামারী। সকাল হলো। এবার ফরেস্ট অফিসের ধ্বংসস্তুপটি পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বন বিভাগের এই অফিসটি বন্ধ হয়েছে তিন/চার বছর আগে। বনদস্যু জুলফিকার বাহিনী একবার এই অফিসে উঠে তান্ডব চালিয়েছিলো। তার পর থেকেই বন বিভাগ এই অফিস তুলে নেয়।

আবার খালের মুখে ফিরবো। তবে তার আগে বাঁশের তৈরি হাপড়ে সকালের মাছগুলো রাখলেন। নৌকার সাথে বেঁধে এগিয়ে গেলাম। নোঙ্গর করলাম বড় নদীর মুখে। জোয়ার শেষ হতে আরও ঘন্টা খানেক লাগবে। ভাটায় নৌকা ছাড়বো। যাবো সোজা বৈদ্যমারী।

দিনের বেলা কি ওরা সামনে আসবে? বশির হাওলাদার বললেন, জীবনেও না। ওরা চলে গেছে খালের আগায়। আজ আর দেখা দিবে না। গল্প চলছে, সঙ্গে হাতও চলছে। মসলা বাটা, পাতিল ধোয়া, চুলা জ্বালানো। সব কাজ কেমন করে যে করে এরা! মাছটাও কেটে ফেললেন দেখতে দেখতে। আস্ত মাছের আঁশ ফেলানো, কাটাকুটি করতে সময় লাগলো পাঁচ মিনিট। লবণ, মসলা মাখিয়ে মাছ উঠলো চুলায়। সরিষার তেল দিয়ে সেই মাছ ভাজার স্বাদ কখনও ভুলবো না।

জোয়ার শেষ হলো। পানি নামতে শুরু করলো বড় নদী পশুরের দিকে। সেই স্রোতে ভাসলো নৌকা। আমার সহযাত্রী তখনও ঘুম। পিছনে বসে বৈঠা বাইছেন রহিম হাওলাদার। ফিরে যাচ্ছি লোকালয়ে। ডাকাতদের সাথে দেখা হলো না। কিন্তু এক রাতের যে অভিজ্ঞতা হলো, তা মনে থাকবে অনেক দিন।

বৈদ্যমারীর আগেই দেখি কয়েকটি নৌকা ডাঙ্গায় ভিড়ানো। নৌকা বোঝাই চিংড়ি। প্রথমে বেশ ভালো লাগলো। তারপর শুনলাম, জেলেরা বিষ দিয়ে ধরেছে মাছগুলো। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। বইশেল কাকা বললেন, এরা হলো বড় ডাকাত। ফরেস্ট আর বনদস্যুরা এদের ডেকে নিয়ে মাছ ধরায়। এভাবে চললে, মাছ থাকবে? এতো বিষ পড়লে সুন্দরবন বাঁচবে? বললাম, একটু প্রতিবাদ করেন আপনারা। বললেন, এদের নিয়ে কিছু বললে আমাদের আর জঙ্গল করা হবে না।

ভালো মন্দ মিলিয়ে অদ্ভুত এক সময় পার করলাম। ডাঙ্গায় উঠে ধন্যবাদ জানালাম রহিম চাচাকে। কিছু টাকা দিতে চাইলাম। পারলাম না। উনি বললেন, আপনার মতো মানুষ পাই না কাকা, মাঝে মাঝে আসবেন।

ঘাটে দাঁড়ানো একজন মাছ ব্যবসায়ী। দর কষাকষি করে মাছগুলো কিনে নিলেন তিনি। রহিম চাচা’র বড়শির মাছগুলো বিক্রি হলো ২৭ হাজার টাকায়। কিন্তু মাছের টাকার নগদ লেনদেন হলো না। শুনলাম, ওই ব্যবসায়ীর কাছে ঋণ আছে রহিম চাচা’র। সেই টাকা কেটে মাছের দাম দিবেন ওই ব্যবসায়ী। বিদায় দেওয়ার সময় রহিম চাচা বললেন, কুড়ি হাজার টাকার দেনা একবারে শোধ হবে। আপনি অনেক ভাগ্যবান। এমন মাছ অনেক দিন পাইনি!

সোর্সকে বিদায় দিলাম। পথে চিলা বাজারে দেখা হলো বেলায়েত সরদারের সাথে। সেখান থেকে মংলা হয়ে ঢাকার পথ ধরলাম।

(ঘটনাগুলো ২০১৬ সালের। সেই সময়ের সাথে এখনকার বাস্তবতার মিল নাই। ঘটনাগুলো জীবন থেকে নেওয়া। কিছু তুলে ধরছি আপনাদের জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top