সোর্সরাই চালায় সিন্ডিকেট | রূপান্তরের গল্প ২১৮ | Rupantorer Golpo 218 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১৮ : মাস্টার বাহিনীর সাবেক দস্যুরা ভালো আছে। যে যার কাজ করছে। শান্ত ও আলম বাহিনীর সদস্যরাও জামিনে বের হয়ে বাড়ি ফিরেছে। জামিন নিয়ে জটিলতার মধ্যে আছে মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী। উকিল বদল করে নতুন করে জামিনের চেষ্টা করছে তারা।
ঢাকা ফিরে নিয়মিত কাজে নেমেছি। দৈনন্দিন খবর নিয়ে পেশাগত কাজ। তবে এর ফাঁকে সুন্দরবনের আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের খোঁজ-খবর রাখছি। ফোনে কথা বলছি বিদ্যমান দস্যুদলগুলোর সাথে। ইদানিং একটু বেশি বেশি যোগাযোগ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সরা।
এই সোর্সদের নিয়ে বিপদে আছি। বিশেষ করে মংলা’র এক সোর্স খুব বেশি ঝামেলা করছে। নাটা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তিনি আমার নাম বলে টাকা নিয়েছেন। আমার অসুস্থ্যতার কথা বলে পশ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর দস্যুর কাছ থেকে আগেও নাকী আমার নামে টাকা তুলেছেন তিনি। সাদা ফতুয়া, সাদা লুঙ্গি পড়া এই সোর্স আমাকে অনেক তথ্য দেন। কিন্তু ক্ষতি করেন তার চেয়ে বেশি। সন্ধ্যার আগেই কথাবার্তা বলে টাকাগুলো জাহাঙ্গীরের কাছে ফেরত পাঠানো হলো। সোর্স সাহেব সেই থেকে চটেছেন, ছড়াচ্ছেন বিভ্রান্তি।
বন উপকূলের মধ্যম্বত্বভোগীদের অনেকেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স। বলতে গেলে সবাই। তারাই আবার দস্যুদের সোর্স হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এই শ্রেণির মানুষেরা সুন্দরবনে মাছের ব্যবসাও করে। বিভিন্ন দস্যু বাহিনীর নামে নামে চাঁদা দেয় জেলেরা। মাঝখানে থাকে এই সোর্সরা। দস্যুদের সাথে সুসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে জঙ্গলে মাছের ব্যবসা করে। আবার চাঁদা তোলার কাজটি তারা সরাসরি করে।
এই দালালরা দস্যুদের চাঁদা, মুক্তিপণ নিয়ে সাজানো দর কষাকষি করে। তখন জেলেরা মনে করে ওরা তাদের লোক। আবার দস্যুদের চাঁদা সংগ্রহ করে সেই টাকা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়। মাঝখান থেকে বড় অংকের টাকা অবশ্য সরিয়েও ফেলে তারা।
এগুলো আবার সবাই কম-বেশি জানে। কিন্তু এদের ছাড়া তো উপায়ও নাই। কারণ এই মানুষগুলোই আবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স। মোটকথা মাঝখানে বসে শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে লাখ লাখ টাকা কামাই করে দালাল বা সোর্সরা।
লোকালয়েও ব্যাপক দাপট সোর্সদের। নানা মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামীদের ধরিয়ে দেওয়া এদের কাজ। তবে সেই কাজ করার চেয়ে ভয় দেখিয়ে অপরাধীদের ফেরারি বানাতে ওস্তাদ তারা। তাদের ধাওয়া ও চাপে সাধারণ অপরাধীরা ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়, ফেরারি হয়। সেই পালিয়ে বেড়ানো অপরাধীরা ঢুকে পড়ে সুন্দরবনে, দস্যুতায়।
জঙ্গলে ডাকাতি করা কঠিন কাজ, তবে সোর্সদের তাড়ায় তাদের ঘরে থাকার উপায় থাকে না। পুলিশের নামেও টাকা তোলে এরা। এই ভয়ের রাজ্যে সোর্সগুলোই সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। সুন্দরবনে দস্যু না থাকলে তাদের লোকসান হয়ে যাবে।
এতো ডাকাত ক্রসফায়ারে মরলো! কিন্তু সুন্দরবনের ডাকাত তো কমে না! আবার সরকার যে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিলো। তারপরও তো সুন্দরবনের দস্যুদলের সংখ্যা যা ছিলো তাই আছে… এই কথাগুলো সত্য।
২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কয়েকশ’ বনদস্যুর বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই নিরুদ্দেশ। আবার গেলো কয়েক মাসে সারেন্ডার করেছে ৫টি দস্যুবাহিনী। এরপরেও হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে দেড় ডজনের বেশি বনদস্যু দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সুন্দরবন। সারেন্ডার শুরুর আগেও দস্যুদলের সংখ্যা এমনই ছিলো।
তার মানে কি এতো সব আয়োজন কোনো কাজে আসছে না? এই প্রশ্ন তুলছেন যাঁরা, তাঁরাও এর উত্তর খুঁজছেন না। মনে হয় উত্তরগুলো দেওয়ার দায়িত্ব সব আমার।
কেউ বুঝতে চাইছেন না, সুন্দরবনে যে রূপান্তর চলছে তা এখনই দেখা যাবে না। সময় গড়াতে হবে আরও অন্তত এক বছর। আত্মসমর্পণ তো সবে শুরু হলো। একই সাথে চলছে আইন শৃংখলা বাহিনীগুলোর দস্যুবিরোধী অভিযান। এগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব।
সমন্বয় নাই বলে, দস্যুমুক্ত সুন্দরবন মুখে বললেও তার বাস্তবায়ন এখনও অনেক দূরের পথ। সমন্বয় ছাড়া কোনো কাজই সফল হয় না। বরং অরাজকতা বাড়ে। সুন্দরবনে এখন সেই অরাজক পরিস্থিতি চলছে বলা যায়।
আপাতত ঝামেলার কাজ তুলে রাখলাম। জলদস্যু বনদস্যুদের নিয়ে নানা রকমের খেলা চলছে। সক্রিয় এখন বনদস্যুদের প্রকৃত গডফাদাররা। আগামী কয়েকদিন একটু চুপ থাকবো।
ওদিকে একটি অভিযানের খবর পাচ্ছি। বরিশাল RAB সুন্দরবনে গেছে। পশ্চিম বাদায় খোকা বাবু নামের একটি দস্যুদলকে ধরতে ঘন ঘন অভিযান চলছে সুন্দরবনে।
(ঘটনাগুলো ২০১৬ সালের শেষ দিকের)