কথা রাখলো না দস্যুনেতা আলিফ, চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করলো খোকাবাবু বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ২২০ | Rupantorer Golpo 220 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২২০ : আমাকে একটু সময় দেন বাপজান। গলা পর্যন্ত দেনা আমার। মেশিন পত্র যা কিনছি সবকিছুই ধার করা টাকায়। সূদও টানতে হয়। ফোনে কথাগুলো বলছিলো পশ্চিম বাদার ভয়ঙ্কর দস্যুনেতা আলিফ। বললো, খুলনার এক স্বর্ণকার ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে সে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রতি মাসে সূদের টাকা দিতে হয়। আবারও বললাম, সারেন্ডার করো। এসব কথা বলে লাভ নাই। পরে দেখবে সারেন্ডারও হবে না, তোমার দেনাও শোধ হবে না। তখন আবার সেই ফেরারি জীবনেই থাকতে হবে।
আলিফকে বললাম, তোমার বিষয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট কিন্তু ভালো না। আলিফ বললো, তুমি আমার বাপজান। তুমি একটু দেখো। বললাম, তোমার এতো বাপ মা কোত্থেকে আসে বলো তো? সে বললো, সবাই আমার ধর্মের বাবা-মা। বললাম, তোমার আসল বাবা-মা কোথায় থাকে? বললো, ওরা থাকে মুন্সিগঞ্জ বাজারের সাথেই। সেখানেই তার বাড়ি। কিন্তু অনেক বছর বাড়িতে উঠতে পারে না সে। অবশ্য তাতে আলিফ ডাকাতের কোনো ক্ষেদ আছে বলো মনে হয় না। পরিবারের সাথে তার কোনো রকম যোগাযোগ নাই।
বনদস্যু দলের লিডারদের এক এক জনের স্বভাব এক এক রকম। চলা-ফেরা, কথা-বার্তায় বেশির ভাগই বেশ রূক্ষ। আবার হাস্যরসাত্মক কথাবার্তাও বলে কেউ কেউ। বেশির ভাগ দস্যুনেতা বলে, এই জঙ্গলে বিপদে পড়ে আসছি। জেলেদের বলে, তোমরা আমাদের বাঁচায়ে না রাখলে তো না খেয়ে মরবো! বেশির ভাগ দস্যুদল অতি মাত্রায় অত্যাচারী। জেলেদের সবকিছু লুট করতো। খারাপ ব্যবহার করতো, মারপিটও করতো জেলেদের।
হাতে গণা কয়েক জন দস্যুনেতা জেলেদের সন্তুষ্ট রাখতো। চাঁদা নিলেও তাদের ওপর বাড়তি অত্যাচার করতো না। বিপদে আপদে সহযোগিতাও করতো। ভালো ব্যবহারের কারণে এই দস্যুদের বেশ সুনামও ছিলো জেলেদের মাঝে। রাজু বাহিনীর রাজু ছিলো তেমনই এক দস্যুনেতা। আলিফ ছিলো অত্যাচারী দস্যুনেতা। বেশি মারপিট না করলেও জেলেদের প্রতি তার মমতা ছিলো কম। চাঁদা ও মুক্তিপণের টাকায় ছাড় দিতো না একদম। জেলেরা তাকে দয়াল নামে ডাকতো। কিন্তু দয়ামায়ার লেশমাত্র ছিলো না তার মধ্যে। এছাড়া যাকে তাকে বাপজান ডাকা তার পুরনো অভ্যাস।
আলিফ বাহিনীকে সারেন্ডার করানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই। প্রথমে কথা ছিলো মজনুর সারেন্ডারের পর সে উঠে আসবে। কথা রাখেনি সে। তারপর বললো, আলম বাহিনী সারেন্ডার করলে তারপর আসবে। এ দফায় তাই আলিফ বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাবো ভাবলেও সেটিও মনে হয় হচ্ছে না। নানা টালবাহানা করছে সে। এদিকে সরকার জানে এ মাসে সারেন্ডার হবে। নভেম্বর ২০১৬-এর মধ্যে সেই সারেন্ডার করানোর টার্গেট ছিলো। কিন্তু এই দফায় আমার পরিকল্পনা কাজ করলো না। আলিফ কথা শুনলো না।
এদিকে মেজর আদনাদের নেতৃত্বে খোকা বাবু বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরালো হলো। সঠিক পরিকল্পনা, সোর্সদের পর্যাপ্ত ব্যবহার ও আভিযানিক কর্মকান্ডে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লো দস্যুদলটি। নভেম্বরের শেষ দিকে তীব্র হলো সে অভিযান। দফায় দফায় তাদের ধরার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু কাজ হচ্ছিলো না। তবুও হাল ছাড়েননি।
সচরাচর দস্যুবিরোধী অভিযানগুলো দীর্ঘমেয়াদী হয় না। তাই ওরা ভেবেছিলো RAB চলে গেছে। খুলনায় তাদের সোর্স আছে। তারা নাকী বলেছে যে RAB-এর কোনো অভিযান নাই। এতেই বিভ্রান্ত হয় দস্যুরা। এই RAB যে খুলনার না, বরিশালের! বিভ্রান্ত হয়ে ভুল করে ফেলে তারা। গাবুরার সুন্দরবন উপকূলে মেজর আদনানের নেতৃত্বে RAB-এর ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে যায় তারা।
যতদূর মনে পড়ে ২৬ নভেম্বর রাতের ঘটনা। পুরো রাত আটকা পড়ে থাকে দস্যুদল খোকা বাবু বাহিনী। পরিস্থিতি বেসামাল হলে গোলাগুলি হতে পারতো। কিন্তু বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে দুই পক্ষই। গোলাগুলি হলে রক্তপাত হতে পারে। বন্দুকযুদ্ধে হতাহত হতে পারে যে কেউ। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় দস্যুনেতা কবিরুল। গভীর রাতে তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। বিনা রক্তপাতে পুরো দস্যুদল তাদের অস্ত্রসহ চলে আসে মেজর আদনান কবীরের হেফাজতে।
পুরো রাত ধরে চলা এই নি:শব্দ অভিযানের খবর কেউ জানতে পারেনি। সাতক্ষীরা ও খুলনা সুন্দরবন উপকূলের আইন শৃংখলা বাহিনীগুলো কিছুই জানতে পারেনি। কারণ তাদের সোর্সরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন। অভিযান চললো, একটি গুলিও ফুটলো না। নি:শব্দে একটি বনদস্যুদল বন থেকে হারিয়ে গেলো, টের পেলো না কেউ।
সকাল হতেই শুরু হলো আলোচনা। খোকা বাবু বাহিনী ধরা খেলো? নাকী সারেন্ডার করলো? এনিয়ে চলছে প্রচার-অপপ্রচার। কেউ বলছে, বনের মধ্যে দস্যুদের সলিল সমাধি হয়েছে। কেউ বলছে পালিয়ে গেছে। আবার কেউ বলছে, বনদস্যুদের ধরে নিয়ে গভীর সুন্দরবনে চলে গেছে RAB। সকাল হতে হতে গল্পের ডালপালা গজিয়ে অনেক দূর চলে গেলো। এদিকে সদর দপ্তর থেকে জানানো হলো, পরদিন ২৮ নভেম্বর ২০১৬ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন বরিশালে।
ফোন পেলাম আমিও। মেজর আদনান বললেন, চলে আসেন ভাই। খোকা বাবু বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনাকেও চাই। দ্রুত গুছিয়ে রওনা হলাম। জঙ্গল থেকে হেফাজতে নেওয়া, সেখান থেকে বরিশালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দস্যুদের আত্মসমর্পণ, সবটুকুর সাক্ষী হলাম। সুন্দরবনের ষষ্ঠ বনদস্যু দল হিসাবে আত্মসমর্পণ করলো খোকা বাবু বাহিনী।
একবেলে সময় পেয়েছিলাম। এর মধ্যে যেটুকু জানলাম তা হলো, কবিরুলের নেতৃত্বে এই খোকা বাবু বাহিনীর জন্ম হয়েছিলো খোলপেটুয়া আর কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন খাল কলাগাছিয়ায়। এদের বেশির ভাগের বাড়ি দ্বীপ জনপদ গাবুরায়।
বছর দুই/তিন আগের ঘটনা। একটি মামলায় ওয়ারেন্ট হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় পালাবে ওরা? এলাকার এক বড় ভাই তাদের সুন্দরবনে চলে যেতে বলে। মাছ ব্যবসায়ী সেই বড় ভাই তাদের নৌকার ব্যবস্থা করে দেয়। কয়েক দিনের বাজার সদাও করে দেয় সে। এরপর দশ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি পাইপ গানের ব্যবস্থা হয়। সেই অস্ত্রটি তৈরি হয় স্থানীয় এক লেদ মেসিনে। বাঁকীতে কেনা একটি পাইপ গান নিয়ে শুরু হয় দস্যুতা।
হাতে তাদের একটি পাইপ গান। কিন্তু গুলি ছিলো না একটিও। এদিকের জেলেরা তাতেই ভয়ে জড়োসড়ো। রাতের বেলা একটি পাইপ গানকে তারা কী না কী মনে করলো। নাম ছড়িয়ে গেলো চারপাশে। এক গোন অর্থাৎ দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের কালেকশন হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। বাঁকীতে কেনা পাইপ গানের দাম দিয়ে দেয় তারা। অর্ডার করে আরও দুইটি বন্দুকের। সেই সাথে এক সোর্স এর মাধ্যমে সংগ্র করে কয়েকটি বন্দুকের গুলি।
তিন মাসের মধ্যে খোকা বাবুর নাম-ডাক আরও ছড়িয়ে পড়ে। এবার সোর্সরা তাদের নামে চাঁদা সংগ্রহ শুরু করে। মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন তাদের পৃষ্ঠপোষক হন। বাহিনীর নামে চাঁদার স্লিপ সরবরাহ করতেন তিনি। এক থেকে তিনটি পাইপ গানের মালিক হলো খোকা বাবু। এভাবে চললো আরও ছয় মাস। চাঁদা পাচ্ছে, সঙ্গে চলছে অপহরণ বাণিজ্য।
মুক্তিপণের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠলো তারা। এবার যোগাযোগ হলো খুলনার এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে। একসাথে ছয়টি বন্দুক কিনে ফেললো দস্যুদলটি। দেড় লাখ টাকা করে ছয়টি একনলা বন্দুকের দাম পড়লো নয় লাখ টাকা। গুলি কিনলো আরও ছয় লাখ টাকার। ছোট দস্যুদল থেকে এবার খোকাবাবু বাহিনী হয়ে উঠলো মাঝারি আকারের দস্যুদল।
দস্যুদলটি আত্মসমর্পণ করলো। কবিরুলের নেতৃত্বে ১২ জনের এই দস্যুদল অস্ত্র জমা দিয়েছে ২২টি। গুলি জমা দেয় ১০০৩টি। খালি হাতে জঙ্গলে নেমে একটি দস্যুদলের ২২টি বন্দুকের মালিক হওয়া অনেকটা বিনা পূঁজির ব্যবসার মতো। তবে দিন শেষে তাদের সম্পদ বলতে এই অস্ত্র-গুলিগুলো। সেগুলো জমা হয়ে গেলো। মামলা হলো থানায়। এক রকম কপর্দকহীন অবস্থায় তারা থানা থেকে গেলো জেলখানায়। RAB-এর দেওয়া জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা ছিলো তাদের সম্বল। এই টাকার মধ্যে তাদের জেলখানা থেকে জামিন পর্যন্ত খরচ চালাতে হবে।
বিদায় নেওয়ার সময় দস্যুনেতা বললো, টাকার অভাবে আমাদের জামিন হবে না। একটু খেয়াল রাখবেন। বললাম, প্রধানমন্ত্রী আপনাদের এক লাখ করে টাকা দিবেন। চিন্তা করবেন না। জামিন হয়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে। তারপর বের হয়ে ভালো পথে চলবেন। আপনারা সুপথে থাকবেন। তাহলে আমরাও আপনাদের দেখভাল করবো, সরকার তো পাশে আছেই।
ঝড়ের মতো কাটলো দুই দিন। আলিফ বাহিনী সারেন্ডার না করলেও মেজর আদনাকের চৌকষ অভিযানে সারেন্ডার করতে বাধ্য হলো খোকা বাবু বাহিনী। ঢাকা ফেরার পথে আলিফকে বললাম, তোমার আত্মসমর্পণের দায়িত্ব আমি নিবো না। বললাম, কথা তো শুনলে না। এবার গুলি খেয়ে মরবে তোমরা। ডাকাত জঙ্গলে মরলে কবরও হয় না কিন্তু!
(ছবি: বনদস্যু খোকাবাবু বাহিনীর আত্মসমর্পণ, বরিশাল, ২৮ নভেম্বর ২০১৬)