রূপান্তরের গল্প ২২১ | Rupantorer Golpo 221

মাছের ট্রলার হয়ে যায় ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ২২১

মাছের ট্রলার হয়ে যায় ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ২২১ | Rupantorer Golpo 221 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২২১ : সুন্দরবনের দস্যুরা গভীর সাগরে যায় কী করে? তাদের যে জলযানগুলো দেখি সেগুলো দিয়ে গভীর সাগরে যাওয়া সম্ভব না। তাহলে ওই চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের সাগর থেকে তারা জেলেদের অপহরণ কী করে?

আপাতদৃষ্টিতে সুন্দরবনের ডাকাতদের চলাফেরা বনের ভিতরে আর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে। সর্বোচ্চ পশুর ও বলেশ্বর মোহনা থেকে দক্ষিণে ফেয়ারওয়ে বয়া পর্যন্ত। কখনও আরেকটু পূর্ব দিকে বরগুনা ও পটুয়াখালীর নিচ পর্যন্ত। শুরুর দিকে আমিও এভাবেই ভাবতাম। কিন্তু সময়ের সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ছে, জানতে পারছি কিছু নতুন বিষয়। ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১৬ সালে এসে যা জানছি তা হলো, উপকূলের এই সমস্যাটি প্রকট হলেও এনিয়ে সংশ্লিষ্টদের ধারণা সীমিত।

২০০০ পরবর্তী সময়ে সাগরে দস্যুতার প্রকোপ বাড়তে থাকে। দেশের মধ্য ও পূর্ব উপকূল ছিলো ভয়ঙ্কর সব দস্যু দলের দখলে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মাছ কেড়ে নেওয়া, ট্রলার ছিনিয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপার ছিলো না। মাছের মৌসুমে দস্যুতা বাড়তো পুরো সাগর জুড়ে। জলদস্যুদের গুলি বা কোপে জেলেদের মৃত্যু ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা।

২০০৭ এর দিকে এসে ভোলা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলের দস্যু ও ডাকাত দলের ওপর চাপ তৈরি হয়। সরকার নড়েচড়ে বসে। শীর্ষ দস্যু সরদারদের অনেকেই বন্দুকযুদ্ধে মারা যান, বন্দী করা হয় অনেককে, কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ২০১০ সালের দিকে উড়ির চরে RAB-এর একটি বড় অভিযান হয়।

সেবার বন্দুকযুদ্ধে সাত শীর্ষ জলদস্যুর মুত্যু হয়। তারপর একে একে ডাকাতদের অভয়ারণ্য জাহাইজ্জার চর, ভাসান চর নিয়ন্ত্রণে আসে। হাতিয়ার আশেপাশের অঞ্চল, ভোলার কুকড়িমুকড়িসহ নোয়াখালীর জলদস্যুরাও কোণঠাসা হয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর ডাকাত দলগুলোও চাপে পড়ে।

একের পর এক অভিযানে ডাকাত দল কমে। কিন্তু দস্যুতা কমে না। চিহ্নিত জলদস্যুরা আত্মগোপনে থাকে। সুযোগ বুঝে বাঁশখালী, কুতুবদিয়া আর মহেশখালীর কিছু দল মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতি করে।

২০০৭ সালের দিকে সুন্দরবনের দস্যুরা সাগরে যেতে শুরু করে। তখন রাজু, জুলফিকার, জিহাদ, শীষ্য, মোতালেব, মজনু, আলিফ বাহিনীর নাম ছিলো খুব। প্রায়ই ফোন আসতো কক্সবাজার-চট্টগ্রামের ওদিক থেকে। বহদ্দাররা ফোন দিয়ে বলতেন, তাদের ট্রলার ও মাঝি সুন্দরবনের ডাকাত দল ধরে নিয়ে গেছে।

দস্যুরা কখনও মাঝি প্রতি পাঁচ লাখ টাকাও দাবি করতো দস্যুরা। আর ট্রলার নিয়ে গেলে সেটি ছুটিয়ে আনতে ট্রলার মালিকদের দিতে হতো দশ থেকে কুড়ি লাখ টাকা। অনেক বেশি অর্থকরী হওয়ায় সুন্দরবনের দস্যুদলগুলো চেষ্টা করতো সাগরে আসতে। কিন্তু এতো বড় সাগরে দস্যুতা করা কি মুখের কথা?

শুধু অস্ত্র-শস্ত্র থাকলেই হবে না। সাগরে দ্রুত চলার মতো বড় ট্রলার লাগবে। পথঘাট চিনতে হবে। নিজেদের আড়াল করে চলাফেরা করতে হবে। এছাড়া অস্ত্রশস্ত্রও লাগবে পর্যাপ্ত। সাগরে ডাকাতি করতে গেলে যুৎসই লোকলজনও লাগবে। সাগরে দীর্ঘ পথ পারি দেওয়ার অভিজ্ঞতা, বড় বড় ঢেউ ও রোলিং-এ টিকে থাকার মতো সদস্যদেরও প্রয়োজন। সবকিছু মিলানো কঠিন। তাহলে কী ভাবে সুন্দরবনের দস্যুরা সাগরে তান্ডব চালাতো?

প্রশ্নটি অনেক দিন মাথার ভিতরে নিয়ে ঘুরছি। উত্তর মিলাতে পারি না। কেউ পরিস্কার করে বলে না। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম সুন্দরবনের দস্যুদের এ কাজে সহযোগিতা করে কয়েকজন ব্যক্তি। যাদের নিজেদের দ্রতগামী ফিসিং ট্রলার আছে। আছে দক্ষ মাঝি, অস্ত্রশস্ত্র। পটুয়াখালীর খোকন মাঝি তেমনই একজন।

খোকন মাঝির নিজের একটি বড় মাছ ধরার ট্রলার ছিলো। সেই ট্রলার দিয়ে তিনি মাছ ধরতেন। তবে মাঝে মাঝে ভাড়াও দিতেন। ভাড়া নিতো কারা? সুন্দরবনের দস্যুরা। যখন দস্যুরা সাগরে কোপ দেওয়ার পরিকল্পনা করে তখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নৌযান। তারা যে ট্রলার ব্যবহার করতো সেগুলো বেশ দ্রুতগামী, মজবুত। কিন্তু উত্তাল সাগরে গেলে টিকবে না। বিশেষ করে বর্ষায় ও ইলিশ মৌসুমে নদী সাগর এতো উত্তাল থাকে যে বড় বড় ফিসিং ট্রলার ছাড়া সম্ভব না।

সুন্দরবনের দস্যুদের এই কাজে সহযোগিতা করতো খোকন মাঝি। সহযোগিতা করতো খুলনার একজন চোরাকারবারী। সাগরে দস্যুতা করার জন্য সুন্দরবনের ডাকাতদের ট্রলার ভাড়া দিতো কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীও।

সাগরে ডাকাতি করার জন্য আগে থেকে যোগাযোগ চলতো। নির্দিষ্ট সময় লোকালয় থেকে রওনা দেয় সাগরে মাছ ধরার ট্রলার। দেখা যাবে ছাই রঙ-এর একটি ফিসিং ট্রলার, জাল বোঝাই করে রওনা দিবে সাগরের উদ্দেশ্যে। তারপর এক রাতের মধ্যে সোজা ঢুকে পড়তো সুন্দরবনে। আমাদের সাথে যেভাবে দস্যুদের সাথে দেখা হয়, সেভাবেই নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখা হয় দস্যুদের সাথে। তারপর গহীন বনের ভিতরে ঢুকে পড়ে।

বনের ভিতরে তৈরি করা হয় অস্থায়ী ডক। তাতে তোলা হয়ে ফিসিং ট্রলারটি। আগে থেকে রঙ আর মিস্ত্রি প্রস্তুত থাকে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বদলে ফেলে ট্রলারের রঙ। দেখা যাচ্ছে ছাই রঙ-এর ট্রলারটি পরিণত হয় সবুজ রঙ-এর ট্রলারে। এরপর দস্যুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাগরে। পর্যাপ্ত খাবার পানি, খাবার ও বেশি করে জ্বালানী তেল নিয়ে রওনা দেয় ট্রলার। সাধারণ মাছ ধরার ট্রলার পরিণত হয় ভয়ঙ্কর ট্রলারে।

১০/১৫ জন সশস্ত্র দস্যু বাছাই করে নেওয়া হয়। সাগরে টিকে থাকতে পারে, আবার দস্যুতায় পারদর্শ, সাহসীদের সমন্বয়ে এই ছোট দলটি দস্যুদলের ফ্রন্টলাইনার। সচরাচর এদের নেতৃত্ব দেয় দস্যুনেতা। আর সাগরে যাওয়া আসার পুরো দায়িত্ব থাকে মাঝি’র ওপর। এজন্য ট্রলার ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি মাঝির জন্য আলাদা সম্মানী দেয় দস্যুরা। এছাড়া দস্যুতার রোজগারেও ভাগ বসায় এই ট্রলারের মালিক ও মাঝি।

ভরা গোন, অর্থাৎ যখন পুরো সাগর জুড়ে জেলেরা মাছ ধরে তখনই নেমে পড়ে দস্যুরা। একদিন বা একাধিক দিন-রাত একটানা চালানো হয়। সুন্দরবন থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যায় দস্যুদের ট্রলার। সবুজ রঙ-এর মাছ ধরার ট্রলারটি রূপান্তরিত হয় দস্যু ট্রলারে।

এমনিতে সবুজ জাল বোঝাই সবুজ রঙ-এর ট্রলারটি কেউ সন্দেহ করবে না। কিন্তু একবার দস্যুতা শুরু করলে তারপর আর দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে না। সবুজ সেই মাছ ধরার ট্রলারটি তখন তখন সাগরের জেলেদের মুখে মুখে থাকে। দ্রুত খবর চলে আসে লোকালয়ে। এদিকে এক রাতের মধ্যে যতোগুলো ট্রলারে হামলা চালানো সম্ভব চালানো হয়্। মাঝি, ট্রলার আর মাছ অপহরণ করে নিয়ে দস্যুদের সেই সবুজ রঙ এর ট্রলার ঢুকে পড়ে সুন্দরবনে।

পরদিন খবর রটে যায়। প্রথম বেলা বুঝতে বুঝতে যায়। কারা অপহরণ করলো সেটা জানতে কখনও এক দুই দিনও লেগে যায়। তবে সবাই একটি সবুজ রঙ-এর নৌকার খোঁজ করতে থাকে। আড়তে আড়তে সোর্সরা দৌড়ায়, ঘাটে ঘাটে খবর নিতে থাকে আইন শৃংখলা বাহিনী। কিন্তু সবুজ রঙ-এর ট্রলার আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে জঙ্গলের গহীনতম খালে ঢুকে পড়ে সেই ট্রলার। অপহৃত ট্রলারগুলো রাখা হয় এক বা একাধিক খালে। তারপর সাগর থেকে ধরে আনা মাঝিদের নিয়ে আরও সরু খালের ভিতরে ঢুকে পড়ে। সেখানে বসে অপহৃত জেলেদের নিয়ে তাদের মহাজনদের সাথে দেন দরবার চলে ফোনে ফোনে। তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় দফারফা হয়। বহদ্দাররা টাকা পাঠিয়ে দেন। ধরে আনা ট্রলারগুলোও বড় অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া হয়।

কয়েক দিন ধরে চলে মুক্তিপণ আদায়ের কারবার। এসময় ব্যস্ত থাকে দস্যুনেতা ও দলের মুহুরিসহ গুরুত্বপূর্ণরা। আর যারা সাগরে দস্যুতা করে ফিরেছে তারা থাকে আরাম আয়েশে। এছাড়া ট্রলার সমাঝিদেরও এসময় কাজ থাকে না। সপ্তাহ খানেক শুয়ে বসে কাটায়। এসময় পুরোদমে হরিণ শিকার চলে। খাওয়া দাওয়া হয় ভরপুর।

এদিকে পুরো উপকূল গরম হয়ে যায়। সুন্দরবনের কোন দস্যু বাহিনী অপকর্মটি করেছে জানাজানি হয়। আইন শৃংখলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দস্যুদের ধরতে অভিযান শুরু করে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে চাপ আসে। অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে ছুটোছুটি চলে। ধরপাকড় হয়। কিন্তু ওই দস্যুদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ সুন্দরবনের কোন খালে আছে তারা, কেউ জানে না। অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারেও অভিযান চলে। কিন্তু এতো বড় বনে কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে অপহৃত জেলেদের নিয়ে দর কষাকষি শেষ হয়। দস্যুরা বলে- জেলে বেচাকেনা শেষ হয়। টাকা লেনদেন হয়। আরেক খালে দস্যুতায় ব্যবহার করা সেই ট্রলারের রঙ বদলে আবার ছাই রঙ-এর হয়ে যায়। ট্রলার ভাড়া আর মুক্তিপণের টাকার ভাগ নিয়ে রাতের বেলা সাগরে ভাসে সেই ট্রলার। বড়ফের কেবিনে কিছু মাছ বোঝাই করা হয়। যাতে কেউ ধরলে বলতে পারে যে তারা মাছ ধরতেই এসেছে। এছাড়া ছাই রঙ এর ট্রলারের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নাই। ট্রলার চলে যায় গন্তব্যে।

দস্যুবাহিনী জায়গা বদলায়। পরের কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকে গহীন বনের ভিতরে। অপহৃত জেলেরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে যায়। ধরে আনা ট্রলারগুলোও ছাড়া হয়। সেই ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় অপহৃত জেলেদের। এভাবে সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগর মিলিয়ে এক একটি দস্যুতার ঘটনা ঘটতে থাকে। জেলে অপহরণ হয়, মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসে। সুন্দরবনের দস্যুদের এই অপকর্ম প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু গহীন সুন্দরবন সম্পর্কে জানাশোনার ঘাটতি, দস্যুতার পিছনের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে না জানার কারণে প্রতিরোধের চেষ্টাগুলো খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না।

তার মানে কি দস্যুতা চলতেই থাকবে? অভিযানে অভিযানে কোণঠাসা হচ্ছে দস্যুরা। তারপরও চলছে অপকর্ম। তাদের অবৈধ রোজগারের ভাগ নিচ্ছে অনেকেই। পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতা ছাড়া দস্যুরা চলতেও পারে না। ক্রমাগত অভিযানে ডাকাত দলগুলো চাপে পড়ছে। তবে নেপথ্যের লোকগুলো অচেনাই থেকে যাচ্ছে। এদের চিহ্নিত করা আমার কাজ না। ওদিকে সময় নষ্ট না করে দস্যুদের সারেন্ডারের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সেই কাজ চলছে, চলবে। মধ্য সুন্দরবনের দস্যুদল সাগর বাহিনী যোগাযোগ শুরু করেছে। সময় সুযোগ বুঝে তাদের সাথে দেখা করতে যাবো শিগগিরি।

(২০১৬/২০১৭ সালের প্রেক্ষাপটে লিখা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top