রূপান্তরের গল্প ২২২ | Rupantorer Golpo 222

মোবাইল-এর সিম ভর্তি টাকা! | রূপান্তরের গল্প ২২২

মোবাইল-এর সিম ভর্তি টাকা! | রূপান্তরের গল্প ২২২ | Rupantorer Golpo 222 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২২২ : সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ সব দস্যুনেতার সঙ্গে আমার কথা শুরু হতো মোবাইল ফোনে। সরাসরি কথা বলতাম। রাখঢাক না রেখে বলতাম আত্মসমর্পণ করেন। ওরা অবাক হতো। বলতো, আপনার এই নাম্বারে কি বিকাশ আছে? বলতাম, আমার কাছে টাকা পাঠানোর কোনো মাধ্যম নাই। বরং কাজের কথায় আসেন।

ডাকসাইটে সব দস্যুনেতার অবাক হতো আমার কথায়। বলতাম, আপনাদের সাথে আমার এতো প্রেম নাই। আপনাদের বাঁচিয়ে আমার কোনো লাভও নাই। বলতাম, আপনাদের সাথে কথা বলি শুধু মাত্র আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করতে। তখনকার দস্যুনেতারা ছিলো বেশ ডাকসাইটে।

প্রথম সুন্দরবনের কোন দস্যুনেতার সঙ্গে কথা হয় ২০১০ সালে। তিনি মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেব। ক্রসফায়ারে মোতালেবের মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নেন আল আমিন। কথা হতো তার সাথে। পরবর্তীতে মজনুর সাথেও কথা শুরু হয়। এর কিছুদিন পর মোবাইল ফোনে কথা হয় দুর্ধর্ষ দস্যুনেতা রাজু বাহিনীর প্রধান রাজুর সঙ্গে। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ফোনে তাদের পাওয়া যেতো। তখনও বুঝতাম না গহীন বন থেকে কী ভাবে তারা কথা বলত!

রাজুর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল তখন প্রথম সেই দৃশ্য দেখলাম। নেটওয়ার্ক থাকে সাধারণত ভরা জোয়ারের সময়। ভাটার সময় থাকে না। আবহাওয়া খারাপ হলেও যোগাযোগ থাকে বন্ধ।

দস্যুদের পুরো কারবারই চলে মোবাইল ফোনে। প্রতিটি দস্যুবাহিনীর একটি করে আনুষ্ঠানিক নাম্বার থাকে। থাকেন একজন মুহুরী বা ম্যানেজার। মূলত বাহিনী প্রধানের বিশ্বস্ত ও একটু আধটু লিখতে পারে, এমন ব্যক্তিই দস্যুদের মুহুরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি দিনের আয় ব্যয়ের হিসাব দলনেতাকে বুঝিয়ে দেয়া তার দায়িত্ব।

যখন বিকাশ-এর মতো টাকা আদান প্রদানের ব্যবস্থা ছিল না, তখন নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে হাতে হাতে চাঁদার টাকা নিতো দস্যুরা। তখন ফোন ব্যবহার হতো শুধু যোগাযোগের জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে দস্যুদের টাকা নেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে বিকাশ। চাঁদার টাকা বা মুক্তিপণের টাকা সরাসরি চলে আসতে থাকে দস্যুদের কাছে, বিকাশের মাধ্যমে। অবশ্য বড় অংকের টাকাগুলো হাতে হাতে লেনদেন হয় বেশি।

প্রতি দিন সকালে দস্যুবাহিনীর মুহুরী ও দলনেতা উঠে পড়েন উঁচু কোন গাছের ওপরে। মগডালে সাময়িক মাচা তৈরী করা হয়। আর মোবাইল ফোনগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হয় দড়ির সঙ্গে। নেটওয়ার্ক ভাল মতো পেতে হলে ফোন ঝুলিয়েই কথা বলতে হয়।

দস্যুরা লুকিয়ে থাকার জন্য এমন জায়গা নির্ধারণ করে, যেখানে নৌকার ওপরে বা বনে দাঁড়িয়ে কিছুতেই ফোন ব্যবহার করা যায় না। শুধুমাত্র গাছে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠলে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, বনের ভিতরের এমন জায়গা সবচেয়ে নিরাপদ তাদের জন্য। যাতে কোনো জেলে তাদের দেখে ফেললেও সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে কাউকে জানাতে না পারে।

বনদস্যুদের ভাষায় অপহরণ করে নিয়ে আসা জেলেদের বলা হয় ‘ধরা লোক’। গাছের মগডালে উঠে যেখান থেকে মোবাইল ফোনে কথা বলা হয়, তাকে ‘টাওয়ার’ বলে। মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে বলা হয় ‘জামিন’ হয়েছে, তাদের ছেড়েও দেওয়া হয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে।

দিনের বেলা এই ধরা লোকদের একে একে তোলা হয় টাওয়ারে। সেখান থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায়ের জন্য সেই ধরা জেলের মহাজন বা পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলানো হয়। কোন কোন দস্যুবাহিনী এসময় জেলেদের মারধর করে তার পরিবারকে ভয় দেখায়। যাতে দ্রুত পণের টাকা দিতে বাধ্য হয় তারা। আবার কোন কোন বাহিনী মারধর করে না। কিন্তু ফোনে কথা বলানোর সময় ধরা লোকটিকে কান্নাকাটি করতে বলে। এসময় আশেপাশে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। যাতে অন্যপাশ থেকে মনে করে যে প্রচুর মারপিট চলছে।

এমনিতে যারা কান্নাকাটি করতে পারে তাদের ওপর অত্যাচার কম হয়। দস্যুদের কাছে যাওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমনটাই দেখেছি। বনদস্যুরা বলে, জেলেদের ভয় দেখাই, মারপিটও করি। কিন্তু এমন অত্যাচার করি না যাতে ভয়ে মাছ ধরতে আসা বন্ধ করে দেয় তারা। দস্যুনেতারা বলে, এই জেলেরাই আমাদের চালিয়ে রাখে। ওদের মেরে ফেললে তো আমাদেরও চলবে না।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। মুক্তিপণের টাকার পরিমান এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম থাকে। আর সেই টাকা একসঙ্গে একটি বিকাশ নাম্বারে তো পাঠানো সম্ভব না। তবে সেই ব্যবস্থাও আছে। প্রায় একই সিরিয়াল এর ২০/২৫ বা ৩০টি বিকাশ নাম্বার থাকে। থাকে এজেন্ট নাম্বার ও পার্সোনাল নাম্বার। অর্থাৎ দু’চার লাখ টাকা বনের ভেতরের সেই মগডালে বসেই তারা নিতে পারে বা কোথাও পাঠাতে পারে।

কয়েক মাস আগে এক দস্যুবাহিনীর প্রধান বলছিলেন, জেলেদের কাছ থেকে তারা জোর করে টাকা নেয়। সেখান থেকে অনেককেই ভাগ দেয় তারা। সেই তালিকায় আমাদের মত সাংবাদিকও আছে, আছে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের নাম।

প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি তবে পরের দিকে বুঝলাম যে গাছের ওপরে সিরিয়াল ধরে ঝুলিয়ে রাখা ফোনগুলো আসলে বিকাশ নাম্বার। সেই সিমগুলোই তাদের টাকা রাখার সিন্দুক বা ভোল্ট। সিমগুলোতেই টাকা থাকে। আর বিকাশের পাসওয়ার্ড হচ্ছে সিন্দুকের পাসওয়ার্ড। যা শুধুমাত্র মুহুরী আর দলনেতার জানা থাকে।

একটা প্রশ্ন অনেক দিন ধরে মাথায় ঘুরছে… নির্দিষ্ট কিছু নাম্বার বিকাশ নম্বর জলদস্যুরা ব্যবহার করে। সেই নাম্বারগুলো আবার সবাই জানে। সেই বিকাশ নম্বর ধরে কাজ করলেই বোধ হয় অনেক কিছুর সুরাহা করে ফেলা সম্ভব হতো। সেই কাজ কী করছেন সংশ্লিষ্টরা? আর কিছু না হোক, আইনগত পথ অনুসরণ করে তো সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব।

প্রতিটি দলের অফিসিয়াল নাম্বারগুলো উপকূলের সবারই জানা থাকে। সেই নাম্বারগুলো ধরেও দস্যুদের প্রতিরোধে কাজ করে আইন শৃংখলা বাহিনী।

বর্তমান সময়ে এসে আমাদের একটি মোবাইল ফোনের সিম নিতে হলে সব নিয়ম মেনে নিতে হয়। ফোনে বিকাশ চালু করতে হলেও নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। টাকা ওঠানো বা জমা দেয়ার সময়ও ন্যাশনাল আইডির ফটোকপি জমা দিতে হয়। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, দস্যুদের এতগুলো ফোন নাম্বার, এতগুলো বিকাশ নাম্বার কী বেনামে দেয়া হচ্ছে?

তা যদি না দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে কারও না কারও নামে নেয়া হয়েছে সিমগুলো। সেই মানুষদের কী চিহ্নিত করা হয়েছে এত বছরে? আমার তো মনে হয় সেই অনুসন্ধানটি করলেই বনদস্যুদের লোকালয়ের সহযোগী বা বড় ভাইদের খুঁজে পাওয়া যাবে। আর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে সুন্দরবন বা উপকূলে দস্যুদের তৎপরতা প্রায় শুণ্যে নেমে আসবে, সন্দেহ নাই।

বিকাশের মাধ্যমে আসা মোবাইল সিম ভর্তি যে টাকা, তা অন্যায় আর অপরাধের রাস্তায় কামানো টাকা। সেই টাকা কেউ স্ত্রীর হাতের বালা বন্ধক রেখে, কেউ বা চড়া সূদে ঋণ নিয়ে দিয়েছে। কেউ বা মহাজনের কাছে থেকে পণের টাকা নিয়ে আবার নতুন করে দাদনের জালে আটকা পড়েছে।

বনদস্যুদের ধরতে, তাদের অস্ত্র উদ্ধার বা আটক করতে সারা বছরই তোড়জোড় চলে। কিন্তু সেই প্রান্তিক জেলে-বাওয়ালীদের কথা কী কেউ ভাবছি আমরা? অনেক দস্যু বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে, অনেকেই গ্রেফতার হয়ে আছে জেলখানায়। মামলা হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু জেলেদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা কী ফেরত দেওয়া হয়েছে?

দস্যুরা জানে, ফোনে ফোনে বা সিম-কার্ড এ রাখা টাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তেমন কিছু ঘটনাও ঘটেছে। তবে সেগুলো আইনগত ভাবে বন্ধ করা হয়নি। নিজেদের মধ্যেই কেউ টাকাগুলো উঠিয়ে নেয়। এনিয়ে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনাও ঘটেছে দস্যু জগতে। টাকাগুলো নিরাপদ করতে তারা বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে তুলিয়ে নেয়। তারপর সেগুলো রাখা হয় পরিবারের কারও কাছে। আবার পরিবারের সবাইকেও বিশ্বাস করে না দস্যুনেতারা। কাকে তারা বিশ্বস্ত মনে করে সেবিষয়ে বিস্তর লিখা সম্ভব। কিন্তু এই আলোচনা এখানেই সীমাবদ্ধ রাখছি।

দস্যুদের টাকা যে তাদের কাছে শেষ পর্যন্ত থাকে না তার অসংখ্য প্রমাণ আছে। তাই সশস্ত্র ও ফেরারি এই মানুষগুলোর জন্য মাঝে মাঝে মায়াও লাগে। কারণ শেষ পর্যন্ত টাকাগুলো বেহাত হয়ে যায়। কখনও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা খেয়ে ফেলে, কখনও নিজের পরিবার।

দুর্ধর্ষ দস্যুদের জীবন জঙ্গল অথবা জেলখানায় শেষ হয়। পালিয়ে থাকলে শেষ হয় আতঙ্কে। কখনও ধরা খেয়ে জীবনটা যায়। অথবা হতে হয় দেশান্তরী। তাই দস্যুদের বলি, ছাড়েন এসব। সারেন্ডার করেন। আমি মধ্যস্ততা করবো। এরই মধ্যে ছয়টি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করেছে। তারা ভালো আছে। আপনারাও ফিরুন। কারণ আপনারা নিজেরাও ভালো নাই। আপনাদের কারণে এই উপকূলের লাখ লাখ মানুষ বিপদে।

সাগর বাহিনী নামের দস্যুদলটি আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। শিগগিরি দেখা হবে তাদের সাথে। তারাও নাকী আত্মসমর্পণ করতে চায়।

(ছবিটি ২০১৭ সালের। বড় ভাই বাহিনীর টাওয়ার)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top