পশুর বাওনে নতুন দস্যু- সাগর বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ২২৩ | Rupantorer Golpo 223 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২২৩ : বন্দর নগরী মংলা। বাগেরহাটের একটি উপজেলা। বন্দর নগরী হলেও ঠিক সেই আবহ নাই। বরং মনে হয় শহরটি বেশ পিছিয়ে পড়া। সরাসরি সড়ক পথ নাই। মংলা খাল পার হতে হয় ফেরি দিয়ে। তাও শুধু জোয়ারের সময়। অবশ্য খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা আছে ২৪ ঘন্টা। মংলা থেকে দক্ষিণে গেলে পড়বে চিলা। আরও দক্ষিণে জয়মনির ঘোল। পশ্চিমে পশুর নদী। নদীর উল্টো পাশে সুন্দরবন। দক্ষিণে সেলা নদী।
বছর জুড়ে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপন নদীর সঙ্গে। এখান থেকেই শুরু সুন্দরবন। জঙ্গল আর নদীকে ঘিরে চলে এদিকের অসংখ্য মানুষের জীবিকা। দেশের আর সব অঞ্চলের সাথে মিলবে না। জীবন এখানে অনেক বেশি কঠিন, রূঢ়। জীবিকা এখানে বিপন্ন করে জীবন। লবণ পানির সাথে চলে নিত্যদিনের লড়াই।
চারপাশে পানি। কিন্তু খাবার পানি নাই। আনতে হয় দূর থেকে, কিনতেও হয়। প্রত্যন্ত এই জনপদ সংলগ্ন পশুর নদী দিয়ে মানুষদের চলাচল করে বিশাল বিশাল বাণিজ্যিক জাহাজ। নোঙ্গর করা জাহাজ থেকে লাইটারেজ জাহাজ-কার্গোতে মালামাল নামে।
এদিকে বন্দর ভিত্তিক ব্যস্ততারও শেষ নাই। বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যের হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার চলে চোখের সামনে। কিন্তু তার ছিঁটেফোঁটাও আসে না এদিকে। পশুরের তীর ধরে গড়ে উঠেছে শত শত শিল্প-কারখানা, ইপিজেড।
এদিকে লবণের দুনিয়ায় শুধু মাছের ঘের। লোণা পানি তুলে করা হয় বাগদা চিংড়ির চাষ। ফসল-সবজি হয় না বললেই চলে। মিঠা পানি না থাকায় গাছপালাও হয় না তেমন একটা।
চিংড়িকে বলা হয় সাদা সোনা। তবে সেই বাণিজ্যও অবস্থাসম্পন্নদের দখলে। কর্মসর্স্থান সীমিত। প্রতি বেলার খাবার জোগাতে হিমসিম খায় বন উপকূলের মানুষেরা।
সুন্দরবনের মানুষদের বসবাস এখানে। পশুর নদীর পূর্ব দিকে মংলা, রামপাল, ফকিরহাট, বাগেরহাট সদর, কচুয়া, মোড়েলগঞ্জ আর শরণখোলা উপজেলার অসংখ্য মানুষ এই নদী-জঙ্গল-সাগরের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকের মানুষদের কাছে সুন্দরবন হলো মা। পেট চলে এর সম্পদ দিয়ে। আবার সেই জঙ্গলই তাদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিসহ।
উভয় সংকট বোধ হয় একেই বলে। জঙ্গলে যেতে চায় না কেউ। কিন্তু না গেলে পেট চলে না। বাঘ-কুমির তো আছেই, তার ওপর বনদস্যু-জলদস্যুদের আক্রমণ, অপহরণ আর মুক্তিপণের আতঙ্ক তাদের জীবনকে করে তুলেছে অনেক বেশি স্পর্শ্বকাতর। পরিশ্রমী এই মানুষেরা সব ধরনের মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যায়। কিন্তু আহরণ করা মাছ-কাঁকড়ার দাম পায় না। দুঃখের শেষ নাই। সেই দুঃখের কথাগুলো বলারও কোনো জায়গা নাই। তাই শহর থেকে আমরা গেলে ঝেঁকে থরে তারা। কষ্ট আর বঞ্চনার কথাগুলো বলে মনকে শান্ত্বনা দেয়। আর কিছু না হোক, মনটা তো হাল্কা হয়।
আমি এই উপকূল ধরে হাঁটি, ভেসে বেড়াই নৌকায় নৌকায়, শুনি জঙ্গল করা মানুষদের জীবনের কথা।
সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে। মাস্টার, মজনু, ইলিয়াস, শান্ত, আলম ও খোকা বাবু বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু এর প্রভাব কি পড়ছে সুন্দরবনে?
কেউ বলছে প্রভাব পড়েনি। বরং ডাকাতি বেড়েছে, ডাকাত দলের সংখ্যাও বেড়েছে। আগে বড় দস্যুদলগুলো চাঁদা দিলে তারাই জেলেদের সুরক্ষা দিতো। চিলা বাজারের এক প্রবীন জেলে বলছেন, এখন খালে খালে ডাকাত হইছে কাকা। ভালো করতে যেয়ে কি খারাপ হয়ে গেলো? ঠিক বুঝতি পারতিসি না! এমন কথা শুনে মন ভেঙ্গে যায়। এতো বছরের কষ্ট-চেষ্টা কি তাহলে বিফলে যাবে?
চা-এর দোকানে বসলাম। পাশ থেকে এক তরুণ বললো, কে বললো কাজ হচ্ছে না? ওই সেলার দিকে এখন কোনো ডাকাত নাই। শরণখোলার ওদিকেও ডাকাত নাই বললেই চলে। বড় পার্টিগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে দেখবেন জঙ্গলের ডাকাতরা সব উঠে আসবে। ওই জঙ্গলে কে থাকতে চায়?
সুন্দরবনে এক ধরনের রূপান্তর চলছে। দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সময় লাগবে, সহজ হবে না। ৬টি দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করিয়েও মনে হচ্ছে কাজ এখনও শুরুই হয়। আবার শেষ করতে না পারলে হতে পারে হিতে বিপরীত।
মংলা এসেছিলাম দুই দিন আগে। বেশ কিছুদিন ধরে এই উপকূলে হঠাৎ করেই দস্যুতা বেড়েছে। সাগর বাহিনী নামের দস্যুদলটি মাঝে মাঝে পশুর নদী পেরিয়ে লোকালয়ের কাছে চলে আসছে। পোণার জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
জেলে অপহরণ দুশ্চিন্তার। কিন্তু এই অঞ্চলে দস্যুদের আনাগোণা অন্য দিক দিয়ে বেশি উদ্বেগের। বন্দর পাশেই। মার্চেন্ট শিপগুলোও নোঙ্গর করা থাকে এদিকটায়। তাই সংশ্লিষ্টরা একটু বেশিই তৎপর। কোস্টগার্ডের পাহাড়া বেড়েছে। বনরক্ষী, নৌ পুলিশের তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।
সারা রাত পাহাড়া থাকছে মংলা থেকে হাড়বাড়িয়া পর্যন্ত। কিন্তু এতো বড় পশুর নদীকে নিশ্ছিদ্র করা কি সম্ভব? বনদস্যু সাগর বাহিনীর প্রধান আলমগীরকে ফোন দিলাম। পরিচয় পেয়েই বিনয়ে গলে গেলো সে। বললো, আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি কয়েক দিন ধরে। কিন্তু নাম্বার পাইনি। ভালোই হলো। দস্যুনেতা বললো, আপনি আমাকে চিনবেন ভাই। আমি ডাকাত ছিলাম না। মামলায় পড়ে ডাকাত হইছি। এখন আমাদের বাঁচান। সারেন্ডার করবো।
আমি বললাম, মামলায় পড়ে থাকবেন জেলখানায়। জঙ্গলে আসছো কেন? বললো, সে অনেক কথা ভাই। দেখা হলে বলবো। আমি বললাম, তোমরা মন চাইলে দস্যুতায় নামবে, আর আমাদের কাজ তোমাদের সারেন্ডার করানো?
সাগর ওরফে আলমগীরকে বললাম, জেলেদের ওপর উৎপাত বন্ধ করো। তোমাদের কারণে বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। সে বললো, কোনো জাহাজের আশেপাশে আমরা যাই না ভাই। বললাম, তা যাও না। কিন্তু জাহাজের পাশ দিয়েই তো যাওয়া আসা করো। সে বললো, আর পশুর নদী পাড়ি দিবো না ভাই।
এই মুহুর্তে ছোট দস্যুদলটির ওপর নজরদারি বেড়েছে। অভিযানও চলছে। কিন্তু তাদের ধরতে পারছে না। লোকালয়ের এতো কাছে থাকে তারা। তারপরও খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এবিষয়ে যোগাযোগ করছেন। তাঁকে বললাম, পুরো সুন্দরবনটাই গভীর জঙ্গল। আর এরা ২৪ ঘন্টা সতর্ক থাকে। আপনাদের অভিযানের খবর তারা কেমন করে জানি পেয়ে যায়। আগে থেকে না জানলেও অভিযানকারীদের তারা আগেই দেখতে পায়, সরে যায়। এদের সহজে ধরা গেলে তো আর সারেন্ডারের সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো না।
সাগর বাহিনীর অবস্থান পশুর নদীর পশ্চিমে। করমজল থেকে মরাপশুর পর্যন্ত বনের ভিতরে ছোট ছোট খালের আগায় থাকে সারাদিন। সদস্য সংখ্যা ১২/১৩ জন। অস্ত্র আছে ২০টির মতো। সবগুলোই সচল অস্ত্র, একনলা ও দোনলা বন্দুক। গুলি আছে পাঁচ শতাধিক।
শুরুতে ভেবেছিলাম সাগর বাহিনী মনে হয় খুব ছোট দস্যুদল। কিন্তু ২০টি বন্দুক এই জঙ্গলে অনেক বড় ব্যাপার। হুট করে তাদের নিরস্ত্র করা সহজ হবে না কারও পক্ষ্যে। দস্যুনেতা সাগরকে ফোন দিয়ে বললো, তার পরিবারের লোকজন দেখা করতে চায়। বললাম, এখন না। আমি ঢাকা ফিরবো। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবো। তারপর জানাবো। সে পর্যন্ত কোনো অকাজ করবেন না। মানে কোনো রকম চাঁদাবাজি, অপহরণ বা মুক্তিপণ আদায়ের খবর যেন না শুনি।
(ছবি : পশুর নদী, বাম পাশে লোকালয়। ডান পাশো সুন্দরবন)