রূপান্তরের গল্প ২২৪ | Rupantorer Golpo 224

টাকা উঠছে আমার নামে! বরাদ্দ হচ্ছে সুন্দরবনের খাল! | রূপান্তরের গল্প ২২৪

টাকা উঠছে আমার নামে! বরাদ্দ হচ্ছে সুন্দরবনের খাল! | রূপান্তরের গল্প ২২৪ | Rupantorer Golpo 224 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২২৪ : দস্যুনেতা আমতা আমতা করছে। বলছে, ডাকাতি না করলে চলবো কী করে? অস্ত্র কিনে ফেলছি মেলাগুলো। অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছে। বললাম, যার কাছ থেকে কিনছো দেনা কি তার কাছে? নাকী টাকা নিছো অন্য কারও কাছ থেকে?

নতুন দস্যুদল সাগর বাহিনীর প্রধান- আলমগীরের সাথে নিয়মিত কথা হয়। সে আত্মসমর্পণ করবে। তবে ডাঙ্গার বড় ভাইদের ভয়ে এগুনোর সাহস পাচ্ছে না। যারা অস্ত্র-শস্ত্র দিয়েছে, তাদের জন্যই ভয়টা বেশি। দস্যুনেতাকে বললাম, তোমার সেই বড় ভাইদের বলবে আমার কথা। বলবে, আর কোনো রোজগারের সুযোগ নাই। তারপরও চাপ দিলে বলবে, বিপদ সামনে।

শহরের এক বড় ভাই অবৈধ অস্ত্রের কারবারী। জেলখানায় পরিচয়। সেখানে বসেই দস্যুদল তৈরির পরিকল্পনা হয়। আগের এক মামলায় প্রায় বছর খানেক জেলখানায় ছিলো আলমগীর। দল চলবে কী করে, কারা কারা থাকবে, সবকিছুই চুড়ান্ত হয়েছিলো জেলখানায় বসে। জামিনে বের হয়ে এক বেলাও দেরি করেনি সে। সোজা ঢুকে পড়েছে সুন্দরবনে। দস্যুদলের নাম হবে- সাগর বাহিনী। নামটিও চুড়ান্ত হয়েছে জেলখানাতে বসেই।

অক্টোবর ২০১৬। পশুর বাওনে উৎপাত কমে গেলো। তার মানে সাগর বাহিনী কথা শুনেছে। এদের সাথে আমার কথাবার্তা ফোনে ফোনে। কখনও দেখা হয়নি। তাই শুরুতে আস্থার সংকট ছিলো। ওদের হুট করে বিশ্বাস করি না। কিছুদিন পর্যবেক্ষণের পর মনে হলো, এখন তাদের নিয়ে এগুনো যায়। এবিষয়ে বরিশাল RAB-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান-এর সাথে আলাপ সেরে নিলাম।

ঢাকা ফিরে RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কথা বললাম। বিস্তারিত জানালাম। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও কথা বলে নিলাম। সুন্দরবনের সাগর বাহিনী সপ্তম দস্যুদল হিসাবে আত্মসমর্পণ করবে। এর আগে এক দফা সুন্দরবনে যাবো। দেখা করবো তাদের সাথে। নিজের চোখে সবকিছু দেখে আসবো। তারপর ঠিক হবে চুড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন তারিখ।

দস্যুনেতা আলমগীরের ছোট ভাই ঢাকা থাকেন। শিক্ষিত যুবক। চাকরি করেন বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানে। ফোনে যোগাযোগ হয়েছে আগেই। এরপর অফিসে আসলেন দেখা করতে। জানলাম, তাদের পারিবারিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে বড় ভাই দস্যু জগতে চলে গেছে বলে সমাজে মুখ দেখানো যাচ্ছে না। ছোট ভাই বললেন, কোনো ভাবে সারেন্ডারটা করিয়ে দেন। বললাম, ওরা কথা রাখলে সারেন্ডার হবে। তবে এর মধ্যে কোথাও যেন কথা না বলে।

এই দস্যুদলের সাথে যোগাযোগ হয়েছে সরাসরি। মাঝে কোনো সোর্স নাই। আলমগীরের ছোট ভাইকে বললাম, এই আত্মসমর্পণ একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। এখানে কোনো খরচের কারবার নাই। কথাটি বার বার বলে দিতে হলো কারণ আমার নামে অনেকেই টাকা নিচ্ছে দস্যুদের কাছ থেকে।

কিছুদিন আগের ঘটনা। মংলা’র এক পুরনো সোর্স একটি অঘটন ঘটিয়েছেন। আরেক দস্যুদল জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আমার কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন তিনি। বিষয়টি কানে আসতেই ফোন দিলাম জাহাঙ্গীর বাহিনীর ফোন নাম্বারে। ওপাশে বাছের নামে এক দস্যু ফোন ধরলো। আমার ফোন পেয়েই বললো, মামা আপনার শরীর ভালো তো? বললাম, আমি তো সুস্থ্য আছি।

বাছের আমার পূর্ব পরিচিত। দস্যুনেতার বিশ্বস্ত, দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বললো, আপনার নাকী শরীর খারাপ? অপারেশন হবে নাকী? বললাম, পুরোটা বলো। কে তোমাদের কাছ থেকে টাকা নিলো? কতো টাকা নিলো? জানালাম, আমার কোনো অসুখ হয়নি। বাছের বললো, আপনার ওই সোর্স গত মাসে এক লাখ টাকা নিয়েছে দুই দফায়। ফোন করে বললো যে আপনার শরীর খুবই খারাপ। অপারেশন হবে। টাকার প্রয়োজন। বললাম, তাই তো বলি। ওই সোর্স-এর সঙ্গে যখন পরিচয়, তখন তার বাড়িটি ছিলো ছাপড়া ঘর। আর এখন সেখানে পাকা বাড়ি উঠেছে। ভাবতাম সুন্দরবনে তার ব্যবসা আছে। সেই টাকা দিয়ে উঠছে ঘর।

লোকটি সম্পর্কে বেলায়েত সরদার আমাকে সতর্ক করেছিলেন আগেই। বলেছিলেন, আমাকে সামনে রেখে সে নাকী বেশ ভালো রোজগার করছে। সেভাবে বিশ্বাস করিনি শুরুতে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে সবকিছু।

ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখি, জাহাঙ্গীর বাহিনীর কাছ থেকেই সে আমার নামে মাসে মাসে টাকা নিতো। দশ থেকে বিশ হাজার টাকা নিতো নিয়মিত। সবশেষ অসুস্থ্যতার কথা বলে আগের মাসে এক লাখ টাকা নিয়ে ফেলেছে। অন্য কোনো দস্যুদলের কাছ থেকে সে টাকা নিয়েছে বা নিচ্ছে কী না জানি না।

সোর্স ব্যবস্থাপনা সহজ কাজ না। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো দুর্বোধ্য জায়গায় সোর্স ছাড়া চলবো কী করে? জাহাঙ্গীর বাহিনীর দস্যু বাছের বললো, সুন্দরবনের ঝাপসী-জোংড়া ও মরাপশুর খালের ভিতরে ওই সোর্স-এর বেশ কয়েকটি জেলে নৌকা মাছ ধরে। সবগুলোই নাকী চলে আমার নামে।

অঞ্চলটি অভয়াশ্রম। বন বিভাগের লোকজন আমার বেশ পরিচিত। তাঁদের বলা হয়েছে, এই মাছের ব্যবসাটি নাকী আমারই। এছাড়া সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে কাজ করার জন্য অন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর ক্ষমতাও ব্যবহার করে সেই সোর্স।

বাছেরকে বলেছিলাম, আমার নামে দেওয়া সব টাকা ফেরত নিতে। একই সাথে টাকা আদান প্রদানের তথ্য-প্রমাণ ও ফোন রেকর্ড থাকলে পাঠাতে বললাম। এরপর ওই সোর্সকেও ফোন করলাম। বললাম, টাকাগুলো ফেরত দিবেন। প্রথমে টাকা নেওয়ার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে। তবে তথ্য-প্রমাণের কথা বলতেই সব স্বীকার করলো সে। বললো, টাকা ফেরত দিবে। বনরক্ষীদের বলে তার জঙ্গলের ব্যবসাগুলো বন্ধ করালাম। যে কয়টি দস্যুদলের সাথে যোগাযোগ আছে, তাদের সবাইকে সতর্ক করে দিলাম।

এখানে শেষ হলে ভালো হতো। সমস্যা শুরু হলো অন্য দিক দিয়ে। এতো দিন যে ব্যক্তি আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে, সেই ব্যক্তি চলে গেলো বিপক্ষে। মানে পুরো বিষয়টি আমি জেনে গেছি বলে এখন উল্টে গেছে সবকিছু।

এমনিতে বেশ কয়েকটি পক্ষ্য আমাকে অপছন্দ করে। তারা এই সোর্স-কে পাশে ভিড়িয়ে ফেলে। জানার চেষ্টা করে আমার বিষয়ে। সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম দুর্নীতি করে কী না? করলে কী ভাবে, কার কার কাছ থেকে টাকা নেয় এসব বিষয়ে ব্যাপক খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করে। ওই সোর্সও প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে। আমাকে অসম্মান করার সুযোগগুলো কাজে লাগায়।

এমনিতে অসম্মানের শেষ নাই। একটি কাজ করতে গেলে যে এতো রকমের প্রতিবন্ধকতা আসবে ধারণা ছিলো না। সবচেয়ে বড় কথা দস্যু দমনের এই প্রচেষ্টায় যাঁদের খুশি হওয়ার কথা তাঁদের অনেকেই বেশ নাখোশ। ধন্যবাদ দেওয়া দূরের কথা বরং আমাকে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণ করতে ব্যস্ত তাঁরা। সব খবরই পাই। কিন্তু এদিকে সময় দিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। সামনে অনেক কাজ।

সাগর বাহিনীর দস্যুনেতা আলমগীরের ছোট ভাইকে বললাম- তোমার ভাইকে বলো, আমি না বলা পর্যন্ত তার চেহারা যেন কেউ না দেখে। একটি দস্যুতার ঘটনাও যেন না শুনি। শিগগিরই দিন তারিখ ঠিক করবো। দেখা করতে যাবো ওদের সাথে।

সামনে বসেই ফোন করলো সে। বললো, আমি যেভাবে বলছে, সেভাবেই চলবে তারা।
মেজর আদনানকে বিস্তারিত জানালাম। উনি বললেন, সোর্সদের নিয়ে ঝুট ঝামেলা চলবেই। এগুলোকে পাশ কাটিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সোর্সরা সাধারণত বেশ চতুর হয়।

আদনান বললেন, সোর্সদের সামাল দিতে আপনাকে তাদের চেয়েও চতুর হতে হবে। বললাম, চতুরতা শিখিনি ছোটবেলা থেকে। তবুও চেষ্টা করবো। চেষ্টা করতেআ হবে।

(ছবি: সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top