রূপান্তরের গল্প ২২৫ | Rupantorer Golpo 225

সাগর বাহিনীর আস্তানায় প্রশাসনের ব্রাশফায়ার | রূপান্তরের গল্প ২২৫

সাগর বাহিনীর আস্তানায় প্রশাসনের ব্রাশফায়ার | রূপান্তরের গল্প ২২৫ | Rupantorer Golpo 225 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২২৫ : প্রচুর গুলি হচ্ছে। ব্রাশফায়ারের শব্দ আসছে সুন্দরবন থেকে। পশুর নদীর পশ্চিমের বন সংলগ্ন জনপদ ঢাংমারীর লোকজন আতঙ্কিত। সুন্দরবনের করমজলের ভিতরে কোথায় জানি দস্যুদের সাথে আইন শৃংখলা বাহিনীর গোলাগুলি হয়েছে। রাতেই সেই গোলাগুলির খবর পেলাম। মনে মনে ভাবছি, সাগর বাহিনী না তো?

ফোন করলাম। কিন্তু যাচ্ছে না। অবশ্য রাতের বেলা ফোনে পাওয়ার কথাও না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। খুলনা’ দাকোপ উপজেলার ঢাংমারীর এক সোর্সকে ফোন দিলাম। তার ফোনও বন্ধ। গোলাগুলির কথা বলছে অনেকেই। কিন্তু কার সাথে কার গোলাগুলি চলছে কেউ বলতে পারছে না। অনেক রাত পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম।

ভোরবেলা অনেকগুলো ফোন এসেছে ওদিক থেকে। খেয়াল করিনি। ফোন করেছে সেই সোর্স। মিসড কল তালিকায় দেখি সাগরের ভাই-ও ফোন করেছে অসংখ্য বার। একে একে ফিরতি ফোন করলাম। সাগর বাহিনীর সাথেই ঘটেছে গোলাগুলির ঘটনা। ঢাংমারীর সেই সোর্স বললো, অভিযানে সে নিজেও ছিলো।

খোঁজ নেওয়া থেকে অভিযান পর্যন্ত পুরো দায়িত্ব ছিলো তার। পথ দেখিয়ে জায়গা মতো পৌঁছে গেছিলো তারা। কিন্তু গুলি’র রেঞ্জ-এ যাওয়ার আগেই গুলি করে ফেলছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বললো, রাতের বেলা না গিয়ে দিনের বেলায় গেলে ওদের একজনও বাঁচতো না। জানতে চাইলাম, ওরা কি বেঁচে আছে? উনি বললেন, দুই একজনের গায়ে গুলি লাগলেও লাগতে পারে। তবে মনে হয় না কেউ মারা গেছে।

মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। এই দস্যুদলটি আত্মসমর্পণের জন্য তৈরি হচ্ছে। এমন সময়ে এই অভিযান সেই প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে ফেলবে না তো? চারপাশে খবর লাগালাম। সাগর বাহিনীর প্রধানের সাথে কথা বলতে চাই। অভিযানে কেউ হতাহত হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। কেউ কেউ ছড়াচ্ছে, গত রাতের অভিযানে সাগর বাহিনীর কয়েকজন মারা গেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে আশার কথাটি বলেছেন সেই সোর্স। সুন্দরবনে গুলির রেঞ্জ-এর বাইরে ছিলো দস্যুরা।

করমজলের শেষ মাথা দিয়ে জোংড়ার খালে যাওয়ার একটি ভাড়ানী আছে। সেটি বের হয়েছে টগিরবগির খালে। সেখানেই ছিলো সাগর বাহিনীর সদস্যরা। তাদের অবস্থানের খবর নিশ্চিত হয়ে তারা রওনা দেয়। কাছাকাছি গিয়ে আক্রমণ করে আইন শৃংখলা বাহিনী। ব্রাশ ফায়ার চলে বেশ কিছুক্ষণ।

হঠাৎ এই আক্রমণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় বনদস্যুরা। অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মাল-এ (জঙ্গলকে মাল বলে) নেমে পড়ে সবাই। দৌড়ে ঢুকে পড়ে গহীন বনে। গাছের আড়ালে অবস্থান নেওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। এদিকে আক্রমণ করেই দ্রুত ফিরে যায় আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। পুরো রাত জঙ্গলে পালিয়ে থাকে ওরা।

দুপুরের আগে ফোন আসলো সাগর বাহিনীর মূল নাম্বার থেকে। দস্যুনেতা আলমগীর নিজেই ফোন করেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জানলাম, অভিযানের জায়গাতেই ছিলো তারা। তবে কাছে আসার আগেই আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের দেখে ফেলেছিলো তারা। ওরা আসার অনেক আগেই দস্যুরা নৌকা থেকে নেমে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। চোখের সামনেই গুলি করে তারা। কিন্তু পাল্টা গুলি না করে আরও ভিতরে সরে যায় তার।

সাগর বললো, ভেবেছিলাম আমাদের নৌকাগুলো নিয়ে যাবে আইন শৃংখলা বাহিনী। কিন্তু তার আগেই ফিরে গেছে তারা। তার মানে এ যাত্রায় বেঁচে গেছে তারা। বললাম, কী করবে এখন তোমরা? দস্যুনেতা বললো, যতো তাড়াতাড়ি পারেন এসে নিয়ে যান আমাদের। বললাম, নিবো পরে। আগে দেখা করি।

গেলো চার মাসে একে একে পাঁচটি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করেছে। টানা কাজ করে কিছুটা ক্লান্ত। শারীরিক ভাবে যতোটা না, তারচেয়ে বেশি ক্লান্ত মানষিক ভাবে। ভাবছিলাম কয়দিন বিশ্রাম নিব। কিন্তু সেই সুযোগ কোথায়?

বনদস্যু সাগর বাহিনী দ্রুত দেখা করতে চায়। এখনই সময়। দেরি করা যাবে না। কারণ তার বড় ভাইরা অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষকরা যেকোনো সময় তাকে সরিয়ে দিবে। দস্যুনেতা কথা না শুনলে গডফাদাররা তাই করে। এর আগে বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। এবার যে অভিযান হলো, গোলাগুলি চললো তার সাথে আত্মসমর্পণ করতে না দেওয়ার সম্পর্ক থাকতেও পারে।

মংলার সিন্দুরতলার আলমগীর (দস্যুনাম সাগর)-এর সাথে কথা বলছি গত ককয়েক দিন ধরে। ঠিক করলাম অক্টোবর (২০১৬)-এর মাঝামাঝি সময়ে যাবো সুন্দরবনে। দিন তারিখ ঠিক করলাম।

অফিসে কথা বলে নিলাম। চুপচাপ দেখা করে চলে আসবো। এবিষয়ে আর কারও সাথে আলাপ করলাম না। কারণ ইদানিং দস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরোধীতাকারীরা একাট্টা হয়েছে। আমার গতিরোধ করার জন্য কয়েকজন সোর্স সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। তাই এবারের সফরটি অন্য ভাবে পরিকল্পনা করছি।

দস্যুনেতার ছোট ভাইকে ফোনে জানালাম। বললাম, তোমার ভাইকে অন্য কোনো নাম্বার থেকে আমাকে ফোন দিতে বলো। নতুন নাম্বার। ওদের ফোন কিন্তু ট্র্যাক হয়।

আমাদের এই সফরের কথা সর্বোচ্চ গোপন রাখতে হবে। যে কথা সেই কাজ। কয়েক মিনিটের মধ্যে আসলো ফোন। দস্যুনেতাকে বললাম, কাল রওনা দিচ্ছি। রাতে তোমাদের সাথে দেখা হবে। ওদিকে তোমাদের বিশ্বস্ত কাউকে বলবে, মেহমান আসবে। ডিঙ্গি নৌকা প্রস্তুত রাখতে বলবে। পুরো পথ ট্রলারে যাবো না।

দেশের বাইরে থাকায় এই সফরে আমার সাথে বায়েজীদ ইসলাম পলিন যেতে পারছেন না। আরেক সহকর্মী মেহেদী মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম।

ঢাকা থেকে রওনা দিলাম ভোরবেলা। সকাল সকাল ফেরি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। মাওয়া থেকে পদ্মা নদী পার হতে দুপুর হলো প্রায়। গোপালগঞ্জ-এ দুপুরের খাবারের বিরতি নিলাম। তারপর গাড়ির স্টিকারগুলো খুলে রওনা হলাম মংলার উদ্দেশ্যে। পথে দিগরাজ বাজারে নিলাম চা বিরতি। সেখান থেকে বাজার-সদা করলাম।

আমরা নামবো পশুর নদী দিয়ে। সফরটি গোপন রাখার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হলো। প্রথমত বেলায়েত সরদারকে সঙ্গে নিলাম না। সঙ্গে নিবো না অন্য কোনো সহকর্মীকেও।

মংলা’র বৈদ্যমারীতে খবির মামা নামে একজন মাছ ব্যবসায়ী আছেন, তিনি ট্রলার নিয়ে আসবেন মংলায়। সাধারণ মাছ ধরার ট্রলার। সেই ট্রলারে করে রাতে নেমে যাবো। সুন্দরবনের নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা থাকবে ডিঙ্গি নৌকা। নৌকায় করে পৌঁছাবো দস্যুদের ডেরায়। ঠিক কোথায় যাবো জানি না। তবে মনে হচ্ছে এই সফরটি সহজ হবে না।

(ছবি: সুন্দরবনের দস্যু, ২০১৮)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top