এবারের গন্তব্য জোংড়া খাল | রূপান্তরের গল্প ২২৬ | Rupantorer Golpo 226 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২২৬ : বৈদ্যমারী, চিলা, জয়মনিরঘোলের বাসিন্দাদের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। এ অঞ্চলের কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গেও বেশ সখ্য শুরু থেকে। খবর নিয়ে দেখলাম সাগর বাহিনীর দস্যুনেতা আলমগীরের সাথেও তাদের বেশ ভালো সম্পর্ক। খবির মামা তাদের মধ্যে একজন। আলমগীরকে বললাম, খবির মামা আমারও বিশ্বস্ত। এর বাইরে আর কেউ যেন আমাদের এই সফর সম্পর্কে না জানে। সে বললো, ওই অঞ্চলের এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারও জানেন পুরো বিষয়টি। তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। সুন্দরবনের ভিতরে তাদের অবস্থানের খবর তাঁর কাছেই থাকবে। তিনিই আমাদের পথ দেখাবেন।
দস্যুনেতা সাগর সরাসরি পরিচিত না হলেও তার দলের বেশ কয়েকজন সদস্য আমার পূর্বপরিচিত। হাসান, নান্না, কাবীরের সঙ্গে আমার অনেক বার দেখা হয়েছে, সময় কেটেছে, বনের খালে একসঙ্গে আমরা মাছও ধরেছি ২০১০ সালের দিকে। এদের সাথে সুন্দরবনে টানা দুই সপ্তাহও কাটিয়েছি। ডিঙ্গি নৌকায় করে সুন্দরবনের জোংড়া, ঝাপসি, ভদ্রা অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি, মাছ ধরা দেখেছি, থেকেছি।
এই দলে হাসান নামের যে দস্যু আছে সে আমাদের ট্রলার ও নৌকায় ঘুরেছে দিনের পর দিন। হঠাৎ করে সে কেন বনদস্যু হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো।
চিলা’র জামাল মেম্বারের সঙ্গে কথা বললাম। সোজা সাপটা কথা হলো। জানালাম পুরো পরিকল্পনার কথা। তিনিও আমার যাওয়ার বিষয়টি জানেন। এছাড়া পূর্ব পরিচিত হওয়ায় উনিও বেশ তৎপর ছিলেন। গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতাও করলেন।
আমাদের এই সফর গোপন রাখার জন্য মংলা যাইনি। ওদিক থেকে কাউকে সাথেও নিচ্ছি না। জামাল মেম্বারকে বললাম, সন্ধ্যার আগেই চলে আসবেন দিগরাজ বাজারে। আমরা নদীতে নামবো রাত দশটার পর। মাঝের কয়েক ঘন্টা সময়টা কাটাবো দিগরাজ ও এর আশেপাশে। মংলা’র খেয়া ঘাটে যাবো ঠিক রাত পৌনে দশটায়। সেখানে ট্রলার নিয়ে তার আগেই পৌঁছে যাবেন মাছ ব্যবসায়ী খবির মামা।
সাগর বাহিনীকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। এর আগে সারেন্ডারের আগের দিন শান্ত বাহিনীর ওপর আক্রমণটিও বেশ সন্দেহজনক ছিলো। আলমগীরের দস্যুদলটিতেও ঝামেলা হতে পারে ধারণা ছিলো। সেই দুর্ঘটনা ঘটেও গেলো গোলাগুলির মধ্য দিয়ে।
সন্ধ্যার আগে শেষ ফোন-এ আলমগীরকে বললাম, রাতেই দেখা হচ্ছে। দলের সবার দিকে নজর রাখবে। সদস্যদের কারও হাতে ফোন রাখা যাবে না। সন্দেহজনক কেউ থাকলে তার কাছ থেকে অস্ত্রটি নিয়ে রাখবে। আমি এসে বাঁকী কথাবার্তা বলবো।
জায়গা বদল করে নির্ধারিত খালের ভিতরে থাকবে সাগর বাহিনী। আমরা যাওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে দেখা দিবে। প্রয়োজনে আগাম একটি দল পাঠাবে তারা। কোনো রকম ঝুঁকি নিবো না এই দফায়। কারণ ফোনে আমাদের কথাবার্তা যদি কেউ জেনে যায় তবে আবারও অভিযান চলতে পারে। কয়েকটি ঘটনার পর সন্দেহটা আরও দানা বেঁধেছে মনে। এক জলদস্যুর কথা মনে পড়ে- গুলি কাউকে চিনে না।
সময় কাটানোর জন্য সাবেক বনদস্যু ফজলুকে খুঁজে বের করলাম। দিগরাজ বাজারে একটি দোকান দিয়েছেন তিনি। ভালো চলছে না। তবুও চেষ্টা করছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
সেখানেই দেখা হলো আরেক সাবেক বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর সদস্য সুলতান কাকা’র সাথে। বেশ ভালো আছেন তিনি। বয়স হয়েছে। নাতি-নাতনীদের নিয়ে সময় কাটছে তার। ওদের সাথে দেখা করে চললাম উল্টো দিকে। মানে দিগরাজ থেকে মংলা না গিয়ে গেলাম রামপালের দিকে। পথে ফয়লা, ভাগায় চা বিরতি নিলাম। রাতের খাবার খেলাম কাঁটাখালীর একটি রেস্টুরেন্ট-এ।
বনদস্যুদের ফোন বন্ধ সন্ধ্যা থেকে। জামাল মেম্বার ও ভিডিওগ্রাফার মিরাজকে নিয়ে রওনা হলাম মংলার উদ্দেশ্যে। ওদিকে জয়মনি থেকে ট্রলার নিয়ে রওনা দিয়েছেন খবির মামা। দশটার মধ্যে আমরা পৌঁছাবো খেয়া ঘাটে, একই সময়ে পৌঁছে যাবে ট্রলার।
গাড়ি রাখলাম মংলা খেয়া ঘাট থেকে একটু দূরে। বাজার-সদা ও আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে রাখা হলো ফেরি ঘাটের ওদিকে। নদীর পাড়ে একটু অন্ধকার জায়গা দেখে দাঁড়ালো সবাই। আমি এক কাপ দুধ চা খাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম। খুঁজে খুঁজে অপরিচিত দোকানে গিয়ে বসলাম। জামাল মেম্বারকে নিয়ে চা খেয়ে হাঁটা দিলাম। ট্রলার চলে এসেছে।
ট্রলার ভিড়লো ঘাটে। খবির মামা উঠে আসলেন। অনেক দিন পর দেখা। তাই জড়িয়ে ধরলেন। বললাম, এখন বেশি আওয়াজ করা যাবে না মামা। ট্রলার ছাড়েন, তারপর গল্প হবে। এদিকে মালপত্র সব উঠানো হলো। মংলা খাল থেকে বের হয়ে পড়লাম পশুর নদীতে। ট্রলার ছাদে মেম্বার ও খবির মামার সাথে বৈঠকে বসলাম। কখন, কোথায়, কী ভাবে যাবো আমরা সেবিষয়ে পরিকল্পনা করে নিলাম।
ঢুকতে হবে জোংড়া খাল দিয়ে। আপাতত এটুকুই জানি। সেই খাল ধরে আগাতে থাকবো। দস্যুরা সিগন্যাল দিয়ে আমাদের ডেকে নিবে। কিন্তু এখনই জোংড়ায় ঢুকতে পারবো না। লুকিয়ে চোরের মতো ঢুকতে হবে। খালের মুখেই আছে ফরেস্ট অফিস। তাদের চোখ এড়িয়ে খালে ঢোকা অসম্ভব। কী ভাবে ঢুকবো তাহলে? খবির মামা বললেন, সে যাওয়া যাবে মামা, টেনশন কইরেন না।
জোয়ার চলছে। গোন (ভরা কাটাল/ জোগা) চলছে পশুর নদীর পানি বেশ ফুলে উঠেছে। জোংড়া খালে আমাদের ঢুকতে হবে পুরো জোয়ার হওয়ার ঘন্টা দুই আগে। তখন বাজবে রাত ১২টার মতো। তার মানে মাঝের দুই ঘন্টা আমাদের নদীতেই থাকতে হবে। এমনিতে দুশ্চিন্তার শেষ নাই। এখন এই দুই ঘন্টা সময় সবার চোখ এড়িয়ে কাটানোটা বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। কারণ সাগর বাহিনীকে নিয়ে প্রশাসন বেশ তৎপর। আর বন্দর এলাকা হওয়ায় এদিকে সাধারণ একটি ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটাও সন্দেহজনক।
আপাতত পশুর নদী ধরে মংলা থেকে নিচের দিকে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। জোয়ারের স্রোত ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মাঝ নদী ধরে। চিলা পেরিয়ে জয়মনিরঘোল বরাবর গিয়ে নোঙ্গর করলাম। আমরা আছি পশুর নদীর পূর্ব দিকে। এদিকটা লোকালয়। আমাদের বিপরীতে অর্থাৎ পশ্চিমে সুন্দরবনের জোংড়া খাল।
এখন পর্যন্ত কারও নজরে পড়িনি। হয়তো গোন-এর সময় বলে মাছের ট্রলারের চলাফেরা কেউ সন্দেহের চোখে দেখছে না। নিরিবিলি গল্প করে কাটছে সময়। শুনলাম মংলা’র বৈদ্যমারী, চিলা, জয়মনি, সিন্দুরতলা গ্রামের কয়েকজন তরুণ এই দস্যুদলে যোগ দিয়েছে। এরা সবাই সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরতো।
এদের অনেকেই আমার পরিচিত। সম্ভবত সেই কারণেই দস্যুনেতা আমাকে একটু বেশি ভরসা করছে। এছাড়া জামাল মেম্বারসহ তার বিশ্বস্তরাও আমার কাছের মানুষ। সেজন্যই দস্যুনেতা অপরিচিত হলেও সবকিছু বেশ সময় মতো হচ্ছে। সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে এটি হবে আমার মাধ্যমে সপ্তম সারেন্ডার। ধারাবাহিকতা রক্ষায়, আরও দস্যুনেতাদের এই আত্মসমর্পণ উদ্বুদ্ধ করবে।
রাত সাড়ে এগারোটায় ট্রলার ছাড়লাম। সোজা পশ্চিমে পাড়ি দিবো। নি:শব্দে ঢুকতে হবে জোংড়া খালে। কিন্তু ইঞ্জিনচালিত এই ট্রলার নিয়ে সেটা কী করে সম্ভব? খবির মামা বললেন, আপনাকে টেনশন করতে না করছি না? বললাম, ফরেস্টাররা দেখলে আটকে দিবে না? উনি বললেন, এখানকার ফরেস্টাররা সব আমার পরিচিত। দেখলে কোনো সমস্যা হবে না। বললাম, সমস্যা তারা করবে না। কিন্তু এখান থেকে অন্য প্রশাসনকে জানিয়ে দিলে বড় সমস্যায় পড়বো আমরা। এমনিতে সাগর বাহিনীর ওপর নজরদারি চলছে।
ঘটঘট শব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রলার। এই সফরে বেলায়েত সরদার নাই। উনি থাকলে একটু ভরসা পাই। তবুও যেতে হবে। যেতেই হবে। সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে হবে বনদস্যুদের ডেরায়।